৪ ডিসেম্বর, বেনাপোল মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এইদিন মিত্রবাহিনীর সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে বেনাপোল এলাকা ছেড়ে পিছু হটতে থাকে পাক বাহিনী ও তাদের দোসররা। আশ্রয় নেয় শার্শার আমড়াখালি সদরে। ৪ ডিসেম্বর আঞ্চলিক সদর দপ্তর নাভারনে আশ্রয় নেয় পাক বাহিনী ও তাদের দোসররা।
এর আগে ৩ ডিসেম্বর রাতে মিত্রবাহিনীর সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে পাক সেনারা রঘুনাথপুর ইপিআার ক্যাম্প ছেড়ে রাতের আঁধারে পালিয়ে আশ্রয় নেয় প্রায় তিন কিলোমিটার পূর্বে পোড়াবাড়ি নারানপুর মাঠপাড়ার ব্যাটালিয়ন সদরে। ৩ ডিসেম্বর দুপুরের দিকে দুপক্ষের সম্মুখযুদ্ধে ও মুহুর্মুহু কামানের গুলিতে তছনছ হয়ে যায় নারানপুরে অবস্থিত পাক সেনাদের চৌকি।
সেদিন পাকসেনাদের পিছু হটার খবর পেয়ে বেনাপোলের ওপারে ভারতের বনগাঁর জয়ন্তীপুর থেকে সোজা রঘুনাথপুরের পাশের গ্রাম মানিকিয়া গ্রামে ছুটে আসেন মিত্র বাহিনীর ক্যাপ্টেন মি. রায়সহ দুই দেশের সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা। যশোরের পশ্চিম সীমান্তের বেনাপোল চৌগাছা এলাকায় মুক্তিবাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন হাফিজ এবং বেসামরিক কর্মকর্তা ছিলেন তৌফিক এলাহি চৌধুরী।
ভারত থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতে মিত্রবাহিনীর কাছে এমন খবর পৌঁছালে প্রতিরোধ ও প্রতিশোধের উন্মত্ত নেশায় দিনরাত অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন গ্রাম থেকে হাফিজুর রহমান, শামছুর রহমান, ঢেঙ্গা শামছুর, ঈশা খাঁসহ অনেক স্কুল কলেজপড়ুয়া যুবককে আটক করে নাভারন সদর দট্তরে নিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে এ খবর ছড়িয়ে পড়লে পরদিন ৪ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও রাজাকারদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিযোদ্ধারা। উভয়পক্ষের গোলাগুলিতে ৩/৪ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের কাঁধে করে নেওয়া হয় বঁনগা সদর হাসপাতালে।
এরপর রাতে সংগঠিত মুক্তিযোদ্ধারা ভারী অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত হন। তারা রঘুনাথপুর বিওপি ক্যাম্পের পাশ দিয়ে দুর্গাপুর নারানপুর গ্রাম দিয়ে ঢুকে বেলা ১১ টার দিকে অকস্মাৎ ঝাঁপিয়ে পড়েন পাক বাহিনীর ওপর। পাকসেনারা তখন গোসল-দুপুরের খাবারের প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি গ্রুপ দুই দিক দিয়ে কাগজপুকুর পশ্চিমপাড়া ছাউনি আক্রমণ চালায়। কাগজপুকুর গ্রামে পাক সেনাদের সদর দপ্তরে হামলা চালালে পাকবাহিনীও বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে থাকে। নারানপুর গ্রামের দুই কিলোমিটার দূরে তিন প্লাটুন সৈন্য নিয়ে মানিকিয়া গ্রামে তখন অবস্থান করছিলেন মিত্র বাহিনীর কমান্ডার মি. রায়ে। বেনাপোলের ওপারে জয়ন্তীপুরে তখন ৫নং সেক্টরের সাব সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্বে ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর বর্তমান জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক ই ইলাহী চৌধুরী। সেদিন তার নির্দেশে শুরু হয় প্রবল প্রতিরোধ যুদ্ধ। প্রচণ্ড গোলাগুলির খবরে ভিতসন্ত্রস্ত পাক বাহিনী পুটখালি, শিকড়ি বটতলা, বেনাপোল কাস্টমস হাউজ এলাকা ছেড়ে রাতের আঁধারে পিছু হটে। তারা আশ্রয় নেয় যশোর-বেনাপোল সড়কের আমড়াখালি কোম্পানির সদর দপ্তরে। পরে ১২ কিলোমিটার দূরের নাভারন সাব হেডকোয়ার্টার ক্যাম্পে।
৫ ডিসেম্বর এভাবেই শত্রুমুক্ত হয় বন্দরনগরী বেনাপোল। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে মুক্তির আনন্দে উচ্ছ্বসিত জনতার ঢল নামে বেনাপোলে। পাড়া মহল্লায়ও চলে খণ্ড খণ্ড আনন্দ মিছিল। মুক্তির আনন্দে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে ফেটে পড়ে গোটা বেনাপোলের মানুষ।
সংঘবদ্ধ মিত্রবাহিনীর সহযোগিতায় দ্বিগুণ সাহস নিয়ে চলতে থাকে একের পর এক অপারেশন। পরের দিন শার্শা ও নাভারন, ঝিকরগাছা দখলমুক্ত হয়। এদিন পাকসেনারা ঝিকরগাছা ছেড়ে আশ্রয় নেয় খুলনার শিরোমনি ক্যাম্পে। এভাবেই ৫ ডিসেম্বর বেনাপোল এবং ৬ ডিসেম্বর ঝিকরগাছা এলাকা দখলদার পাকবাহিনীর কাছ থেকে স্বাধীন হবার গল্প শোনাচ্ছিলেন স্থানীয় দুর্গাপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা বাহাদুরপুর ইউনিট কমান্ডার দীন মোহাম্মদ।
বিডি প্রতিদিন/জুনাইদ আহমেদ