যৌথ নেতৃত্ব ও সংলাপ মহান আল্লাহর আদেশ এবং প্রিয় নবী (সা.)-এর আদর্শ। আল্লাহ বলেন, ‘যেকোনো কাজে তোমরা পরস্পরের সঙ্গে পরামর্শ করো’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৫৯)। যৌথ নেতৃত্বের ধারণা তৈরিতে প্রিয় নবী (সা.)-এর দর্শন :
অগ্রবর্তী দল পাঠিয়ে মদিনায় হিজরতের পরিবেশ তৈরি, বিভিন্ন যুদ্ধ পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন, ওহুদের যুদ্ধে গিরিপথে পাহারার ব্যবস্থা, হুদাইবিয়ার সন্ধি ও বাইআতে রিদওয়ান, মক্কা বিজয় ও সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা, নেতার আনুগত্য ও খলিফা নির্বাচন।
যৌথ নেতৃত্বের তাৎপর্য প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, ‘স্মরণ করো, যখন তোমরা একে অপরের শত্রু ছিলে, অতঃপর আল্লাহ তোমাদের অন্তরে প্রীতি স্থাপন করে দিলেন, ফলে আল্লাহর অনুগ্রহে তোমরা হয়ে গেলে পরস্পর ভাই ভাই...’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১০২)।
শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের অনুকূল পরিবেশে বিঘ্ন সৃষ্টি করা পবিত্র কোরআনের শিক্ষার পরিপন্থী। আল্লাহ বলেন, “তোমরা তাদের মতো হইয়ো না, যাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট নিদর্শন আসার পরও তারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে এবং নিজেদের মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টি করেছে...” (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১০৫)।
কঠিন মুহূর্তে মূর্খের কুতর্ক নয়, বরং বিনয় হলো ঈমানের প্রকাশ। আল্লাহ বলেন, ‘দয়াময়ের বান্দারা তো তারাই, যারা বিনয়ের সঙ্গে চলাফেরা করে এবং যখন অজ্ঞ-মূর্খরা তাদের সম্বোধন করে তখন তারা বলে, সালাম (শান্তি)...’ (সুরা ফুরকান, আয়াত : ৬৩)।
আরো বলেন, ‘যদি তারা অহেতুক বিষয়ের সম্মুখীন হয়, তবে ভদ্রভাবে তা অতিক্রম করে যায়’ (সুরা ফুরকান, আয়াত : ৭২)।
দায়িত্বশীল ব্যক্তিত্বের অবর্তমানে কাজের সমন্বয়ের জন্য স্থলাভিষিক্ত নিয়োগ করা প্রিয় নবী (সা.)-এর শিক্ষা। তিনি (সা.) মদিনার বাইরে গেলে বিভিন্ন সাহাবিকে প্রশাসক নিযুক্ত করতেন। একবার তিনি আলী (রা.)-কে এবং আরেকবার আবদুল্লাহ বিন উম্মে মাকতুম (রা.)-কে মদিনার প্রশাসক বানিয়েছিলেন।
তাবুক যুদ্ধের সময় প্রিয় নবী (সা.) আলী (রা.)-কে মদিনায় রেখে গেলেন। তখন মুনাফিকরা নানা কটূক্তি করেছিল। আলী (রা.) সব কথা শুনে যুদ্ধসাজে সজ্জিত হয়ে প্রিয় নবী (সা.)-এর সামনে এসে বললেন, মুনাফিকরা এসব বলাবলি করছে। প্রিয় নবী (সা.) বললেন, ‘হে আলী! তুমি কি আমার জন্য এরূপ হতে সন্তুষ্ট নও, যেমন মুসা (আ.)-এর জন্য ছিলেন হারুন (আ.)?’
যৌথ নেতৃত্ব দর্শনের প্রতিফলন দেখা যায় মুতার যুদ্ধে প্রিয় নবী (সা.) কর্তৃক তিনজন সেনাপ্রধান নিয়োগে। তাঁরা হলেন জায়েদ বিন হারিসা, জাফর বিন আবি তালিব এবং আবদুল্লাহ বিন রাওয়াহা।
তাঁরা সবাই শাহাদাত বরণ করেন। তবে তাতে মুসলিমরা নেতৃত্বশূন্য হয়নি। যুদ্ধক্ষেত্রে নেতৃত্বের ধারাবাহিকতায় তখন ‘সাইফুল্লাহ’ বা আল্লাহর তরবারিখ্যাত খালিদ বিন ওয়ালিদ দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর নেতৃত্বেই আসে বিজয়।
খলিফা আবু বকর (রা.)-এর খিলাফতের সূচনায় এক কঠিন বাস্তবতা তৈরি হয়। কোরআনের হেফাজত নিয়ে শঙ্কা, স্বধর্ম ত্যাগ, মিথ্যা নবী দাবিদারের আবির্ভাব, জাকাত প্রদানে অস্বীকৃতি ইত্যাদি সমস্যা সামনে আসে।
খলিফা বলেছিলেন, ‘ধর্মের অবনতি হবে, অথচ আমি জীবিত! (অর্থাৎ আমি বেঁচে থাকতে ধর্মের ক্ষতি হতে দেব না)’ তিনি সুপরিকল্পিত যৌথ অভিযানের ব্যবস্থা করলেন, যা ইতিহাসে ‘রিদ্দার যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। তিনি ১১টি সেনাদল গঠন করেন এবং প্রত্যেকটির জন্য আলাদা পতাকা দেন। যৌথ নেতৃত্বের কারণে ইসলামের স্বার্থ নিরাপদ হয়। এ জন্য ইতিহাসে আবু বকর (রা.) পরিচিত হয়েছেন ইসলামের ত্রাণকর্তা হিসেবে।
ফেরাউনের অপশাসন মোকাবেলায় মুসা (আ.) ও হারুন (আ.)-এর যৌথ নেতৃত্ব প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,
‘আমি তোমার ভাইয়ের মাধ্যমে তোমার হাত শক্তিশালী করব এবং তোমাদের দুজনকে ক্ষমতা দান করব, ফলে তারা তোমাদের কাছে পৌঁছতে পারবে না...’ (সুরা কাসাস, আয়াত : ৩৫)।
পরিশেষে যৌথ নেতৃত্ব প্রসঙ্গে কোরআনে বলা হয়েছে,
‘মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসুল। আর তাঁর সঙ্গে যারা আছে তারা কাফিরদের প্রতি কঠোর, নিজেদের মধ্যে পরম সহানুভূতিশীল। আপনি তাদের রুকু-সিজদায় লিপ্ত দেখতে পাবেন...’ (সুরা ফাতহ, আয়াত : ২৯)।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, কাপাসিয়া, গাজীপুর।