বগুড়ায় সড়কে পরিবহন খাত থেকে চাঁদা উত্তোলন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জনমনে স্বস্তি ফিরে এসেছে। নামে বেনামে পরিবহন সংক্রান্ত সমিতির কমিটি গঠন করে টানা কয়েক দশক ধরেই চাঁদা উত্তোলন হয়ে আসতো। প্রতি বছর অর্ধশত কোটি টাকার চাঁদা উত্তোলন করা হতো। এই চাঁদা ভাগ হয়ে যেতো বগুড়ার বাস মিনিবাস মালিক সমিতি, ট্রাক পরিবহন শ্রমিক ও মালিক সমিতি, মোটর শ্রমিক ইউনিয়ন, সিএনজি মালিক ও শ্রমিক ইউনিয়নে, কার মাইক্রো চালক সমিতি, মোটর শ্রমিক এর কুলি শ্রমিকসহ বিভিন্ন নামে। এই চাঁদা উত্তোলনের পর পুরো চাঁদার টাকা খরচ হতো শ্রমিক নেতাদের পারপাসে। গত কয়েকদিন ধরে পরিবহনের কোন সেক্টরেই চাঁদাবাজি না থাকায় ভাড়া কমে যাওয়ায় সাধারণ জনগণ বাড়তি খরচ থেকে রেহাই পেয়েছে।
জানা যায়, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগ মিলিয়ে ১৬ জেলার মধ্যে ১২ টি জেলার সকল প্রকার যানবাহন বগুড়া হয়ে চলাচল করে। বগুড়া দিয়ে চলাচলের কারণে বগুড়া জেলায় পরিবহন খাত থেকে চাঁদা উত্তোলনের হার সবচেয়ে বেশি। সিএনজি থেকে আন্তঃজেলা মিনিবাস, বাস, ট্রাক, ঢাকাগামী বাস, কার মাইক্রোকে প্রতিদিন চাঁদা দিতে হতো। নিম্নে ৭০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা হারে চাঁদা প্রদান করতে হতো। কথিত চেইন মাস্টার বসিয়ে প্রতিদিন শহরের বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে পরিবহন খাত থেকে চাঁদা তোলা হতো। এসব চাঁদা তোলার ক্ষেত্রে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের কারসাজি ছিলো।
চাঁদাগুলো উত্তোলনের পর এই বিপুল পরিমান টাকা কথিত নেতারা ভাগবাটোয়ারা করে নিতো। বগুড়া জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পরপরই তার নামে অবৈধ আয় থাকায় দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে একাধিক মামলা হয়েছে। সেই মামলায় তার আলীশান ও স্বেত পাথরের বাড়ি থেকে মালামাল ক্রোক ও জেলহাজতে যাওয়ার ঘটনা রয়েছে। কয়েকজন পরিবহন খাতের মালিক শ্রমিক চাঁদার টাকা দিয়ে বাড়ি গাড়ী গড়ে দিব্যি দিন পার করছেন। প্রতিটি বাস ও ট্রাক থেকে গড়ে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা করে চাঁদা উত্তোলন করা হয়। সেই হিসেবে গড়ে ৫ হাজার যানবাহনের প্রতিদিন ৩০০ টাকা চাঁদা উত্তোলন ধরা হলে দিনে দাঁড়ায় ১৫ লাখ টাকা। আর মাসে ৪৫ লাখ এবং বছরে ৫৪ কোটি টাকা।
বগুড়ার সোনাতলা, সারিয়াকান্দি, দুপচাঁচিয়া, শিবগঞ্জ, শেরপুর, শাজাহানপুর, ধুনট, নন্দীগ্রাম, আদমদীঘি, কাহালু, গাবতলী উপজেলার প্রতিটি সড়কে চলাচলকারি হাজার হাজার সিএনজি চালককেও দিতে হতো নিয়মিত ৫০ থেকে ১০০ টাকা করে চাঁদা। এর সাথে ট্রাক ও বাসের কুলি শ্রমিকের নামে পণ্য উঠা নামানোর নাম করে জোর করে দাবি করা হতো ৫০ থেকে ২০০ টাকা করে। জেলার সকল বাসস্ট্যান্ডেই কুলি শ্রমিকরা সাধারণ যাত্রীদের হয়রানি করে এই টাকা আদায় করতো। মালামাল দেখলেই বাস থেকে নামালেই হাঁকা হয় লাগেজ প্রতি ৩০ বা ৫০ টাকা, বস্তা প্রতি ৭০ থেকে ১০০ টাকা।
কিন্তু ৫ আগস্টের পর বগুড়ায় পরিবহন সেক্টর থেকে কোন চাঁদা উত্তোলন হয়নি। চাঁদা উত্তোলন না হওয়ায় কোন কোন রুটে ভাড়া কমেছে। ভাড়া কমে যাওয়ায় জনমনে স্বস্তি ফিরে এসেছে।
বগুড়া জেলা বিআরটিএ কার্যালয় সুত্রে জানা যায়, বগুড়া জেলার উপর দিয়ে প্রতিদিন কমপক্ষে ১০ হাজার যানবাহন চলাচল করে। এরমধ্যে ট্রাক ও বাস মিলিয়ে প্রায় ৪ হাজার। বাদবাকি রয়েছে সিএনজি, কার মাইক্রোবাস। এসব পরিবহনের অর্ধেকেরই ফিটনেস সনদ নেই। হর্ণ বাজানো হয় ইলেকট্রিক এর। ক্ষমতা দেখিয়ে কেউ কেউ আবার লক্কর ঝক্কর মার্কা বাসও চলাচল করায়। এসব বিষয়ে বিআরটিএ সবসময় সোচ্চার থাকলেও ক্ষমতার দাপটে সমাধান করা সম্ভব হয়নি।
বগুড়া জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়ন, জেলা বাস মিনিবাস মালিক সমিতির কয়েকজন সদস্য জানান, দৈনিক কয়েক লাখ টাকা চাঁদা উত্তোলন হয়ে থাকে। বগুড়া সীমানা হয়ে গেলে এই চাঁদা দিতে হয়। কিন্তু কয়েকদিন ধরে কোন চাঁদা উত্তোলন হচ্ছে না। যে পরিমান চাঁদা উঠতো সেই চাঁদা মালিক শ্রমিকরা নিজেদের জন্য ব্যয় করতো। এসব টাকার ভাগ যেত মালিক-শ্রমিক সংগঠনের নেতা, ক্ষমতাসীন দলের নেতা, স্থানীয় সন্ত্রাসী ও কতিপয় পুলিশ ও অসাধু চক্রের পকেটে। চালকরা একরকম বাধ্য হয়েই চাঁদা দিয়ে সড়কে চলাচল করেছেন। টাকা দিলেই ঘুরত গাড়ির চাকা। কিন্তু এখন চাঁদা দিতে হচ্ছে না।
মামুন হোসেন নামের এক বাস চালক জানান, দিনে ৩০০ টাকার মতো চাঁদা দিতে হতো। কিন্তু এখন সেই চাঁদা দিতে হচ্ছে না। এখন চাঁদা ছাড়াই যানবাহন চলাচল করছে। আর আগে চাঁদা না দিলে বাস চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হতো।
বগুড়া জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম জানান, পরিবহন সেক্টর থেকে কোথাও কোনো চাঁদা উত্তোলনের উপায় নেই। অবৈধ এ কাজের প্রমাণ পাওয়া মাত্রই অভিযান পরিচালনা করা হবে।
বিডি প্রতিদিন/হিমেল