শুক্রবার, ২৭ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

মণির কুকুর

এনাম রাজু

মণির কুকুর

ঝিকঝিক ঝিকঝিক শব্দেই যে মণির ঘুম আসছে না, তা নয়। মায়ের কোলে মাথা রেখে গত দুই-তিন বছরে এভাবে তার শোয়া হয়নি। আজ সেই সুযোগ পেয়েও মনের আনন্দে চোখ বন্ধ করতে পারছে না। মনের মধ্যে কালুকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা, সেটা ধীরে ধীরে লতা-পাতার মতো বেড়েই চলছে। কপালে ভাঁজ ফেলেছে। আর প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে চিকচিক করছে ঘাম। কখনো বাড়িতে পৌঁছবে, আর কখনই বা কালুকে দেখতে পাবে।

বারবার মায়ের কোল থেকে মাথা তুলে উঠে বসছে সিটে। যানজটের ঝামেলা থেকে রেহাই পেতে রীতিমতো যুদ্ধ করে ট্রেনের টিকিট পেতে হয়েছে তার মামাকে। ট্রেনে যাতায়াতের সুবিধা হলো, রোড ট্রাফিক নেই, এক্সিডেন্টের ভয়ও কম। ঘুমানোও যায়। কিন্তু ঘুম বাদ দিয়ে মনে মনে ভাবছে কেন যে মামার বাসায় বেড়াতে গেলাম।

এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ে তুলি। মা তার কষ্ট বুঝতে পারে। কেননা কালু যখন পাঁচ-ছয় মাসের বাচ্চা তখন স্কুল থেকে ফেরার পথে কালুকে রাস্তার পাশেই পেয়েছিল মণি। হয়তো কেউ বাচ্চাটিকে ইচ্ছে করেই ফেলে দিয়েছিল। বৃষ্টিতে ভিজে মৃত প্রায়। সে কালুকে বাড়িতে এনে পরম যতেœ গা মুছিয়ে দিয়ে খাবার খাওয়ায়। এ নিয়ে বাড়িতে কত ঘটনাই না ঘটেছে। মণির বাবা মিজানুর রহমান অফিস থেকে বাড়িতে ফিরে কালুকে দেখে তো রেগেমেগে একাকার। এটাকে কে এনেছে বাড়িতে? বাড়ি থেকে তাড়াও। মণি পাশের রুম থেকে এক দৌড়ে এসে কালুকে কোলে নিয়ে বলে- বাবা ওকে তাড়িও না, ওকে বের করে দিলে বৃষ্টিতে ভিজে মরে যাবে। তোমার কোনো সমস্যা হবে না বাবা, আমি ওকে দেখাশোনা করব। মিজানুর রহমান মেয়ের কথা শুনে আর কিছু বললেন না, মুচকি হেসে রুমে চলে গেলেন।

প্রায় দুই বছর হলো কালু বাড়িতে আছে। এখন সে আর বা চা নয়, রীতিমতো সুস্বাস্থ্যের অধিকারী দায়িত্বশীল ও মতাধর কুকুর। গায়ের রং কালো, মাথায় দুটো সাদা ডোরাকাটা দাগ। যা ওর চেহারাকে ভিন্নতা দিয়েছে। বাড়িয়েছে সৌন্দর্যও। তাই তাকে কালু বলে ডাকা হয়। একবার কালু ডাক শুনলেই সামনে এসে হাজির।

অনেক দিন পরে ছুটিতে মায়ের সঙ্গে মামা বাড়ি এসেছে তুলি। প্রথম ক’দিন ভালোই গেলো মণির। হঠাৎ সেদিন রাতে টিভিতে সংবাদ দেখে কুড়িগ্রাম শহর ও আশপাশের কিছু গ্রামে কুকুরের উপদ্রব বেড়ে যাওয়ায় প্রশাসন থেকে কুকুর নিধন শুরু করেছে। ইতোমধ্যে কিছু কুকুরকে মেরেও ফেলেছে। এই খবর শোনার পরই সে বাড়িতে যাওয়ার জন্য রীতিমতো কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। কথা ছিল কয়েকদিন মামার বাসায় থাকবে। কিন্তু তার কান্নাকাটিতে তা আর হলো কই?

হঠাৎ মণি ঘুম থেকে উঠে বলে আম্মু, আর কতক্ষণ? মা উত্তর দেওয়ার আগেই দেখল, ট্রেন স্টেশনে থেমে গেছে। মণিদের বাড়ি স্টেশনের কাছেই। দ্রুতই বাড়িতে ফিরে চিৎকার করতে থাকে- কালু! কালু! কেনো সাড়া শব্দ নেই। পাগলের মতো সারা বাড়ি ছুটতে থাকে মণি। আর কালু কালু চিৎকার করতে থাকে। মাও তার পিছু পিছু ছুটছে। সবাইকে জিজ্ঞেস করে, কালুকে দেখেছে কি না।

সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসে। কালুকে তখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে কান্নায় ভেঙে পড়ে মণি। হঠাৎ দৌড়ে এসে টেবিলের নিচে মাথা লুকিয়ে বসলো কালু। চিহ্বা মাটিতে লেগে যাচ্ছে। পায়ে রক্ত ঝরছে। এমন সময় প্রশাসনের কিছু লোক এসে মণির মাকে জিজ্ঞেস করে, এদিকে কোনো কুকুর আসতে দেখেছে কি না? তিনি মাথা নাড়িয়ে না বলেন। পরে ঘরে ঢুকে দেখেন কালুকে জড়িয়ে কান্না করছে মণি। তিনি অবাক হলেন, কালু কখন ফিরে এলো ভেবে। মা দুজনের মাথায় হাত বুলিয়ে হলুদ আর গরম তৈল মেখে এনে কালুর কাটা পায়ে লাগিয়ে দেয়।  দ্রুতই কালু সুস্থ হয়ে ওঠে। এরপর থেকে মণি কালুকে বাড়ির বাইরে একটু কমই যেতে দেয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর