সারাটা রাত একনাগাড়ে বৃষ্টি হলো। মুষলধারে বৃষ্টি।
সেই যে সন্ধ্যায় শুরু হলো, আর থামাথামি নেই। এমন বৃষ্টির রাতে মিশুর চালভাজা আর বাদামভাজা-বেশি করে পিঁয়াজ, কাঁচামরিচ, সঙ্গে সরিষার তেল দিয়ে মেখে খেতে খুব পছন্দ করে। সাধারণত মিশুর মা রোকেয়া খুব একটা এসব খেতে দেয় না মেয়েকে। কিন্তু আজকে মিশুর মামা শফিক আসায়, বেশ জোড়তোড় দিয়ে মিশু মামাকে বলল, মাকে যেন চালভাজা মাখিয়ে দিতে বলে। শফিক ভাগ্নির আবদার ফেলতে পারল না।
বৃষ্টি পড়ছে, তাই কারেন্ট থাকার প্রশ্নই ওঠে না।
মিশুরা মোম জ্বালিয়ে বসে পড়ল-মামা এবার গল্প শুরু করবে।
মামা এলে সব সময়েই মিশু আর মিশুর ছোট ভাই মাসুদকে সন্ধ্যাবেলা গল্প শোনায়। ওরা বায়না না করলেও মামা নিজেই গল্প বলতে শুরু করে। কখনো ভূতের, কখনো অ্যাডভেঞ্চার, আবার কখনো সায়েন্স ফিকশন।
রোকেয়া প্রায়ই বলে, ‘ওরা এখনো ছোট, তুই এসব বললে কি ওরা বুঝবে?’
শফিক তখন হেসে বলে, ‘অবশ্যই বুঝবে। দেখো না কত মজা পায়! না বুঝলে কি আর এমন মজা পেত? আর ছোট থেকেই এসব ব্যাপারে বাচ্চাদের আগ্রহী করে তোলা ভালো।’
রোকেয়া আর কথা বাড়ায় না।
গল্প বেশ জমে গিয়েছে। চালভাজা খেতে খেতে যেন গল্পের স্বাদটাই অন্যরকম হয়ে গেছে আজ। সঙ্গে তো বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ আছেই।
শফিক দেয়ালে হেলান দিয়ে, কোলে একটা বালিশ রেখে আয়েশ করে বসে গল্প বলা শুরু করল।
মাঝখানে একটা কাচের কাপে অর্ধেকটা মোম থেকে বের হয়ে আসছে আগুনের শিখা, তা থেকে সোজা উপরের দিকে কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে কালো ধোঁয়া।
মামার দিকে মুখ করে মিশু আর মাসুদ বসে। অবশ্য এটাকে ঠিক বসা আবার শোয়া একটাও বলা যায় না।
মামা এবার শোনাচ্ছে-কীভাবে ঝড়ের দিনে কলেজ থেকে বাড়ি ফিরেছিল।
‘সে কী ঝড় উঠল! আমরা তখন কলেজ থেকে বের হয়ে অর্ধেক রাস্তা এসেছি, তখনই বাতাস শুরু। আমরা দৌড়াতে শুরু করলাম। আমার এক বন্ধু তো দৌড়াতে গিয়ে পড়ে গেল!’
এটা শুনে মিশুরা খুব হাসল। আসলে মামা যাই বলে ওদের এত ভালো লাগে!
হাসির পালা শেষ হলে আবার শুরু হলো গল্প-
‘এবার বাতাস থেমে গিয়ে শুরু হলো বৃষ্টি আর আকাশের গর্জন। আমরা তখন রাস্তার পাশ থেকে বড় বড় কচুপাতা মাথায় দিয়ে দৌড়!’
শুধু কলেজ থেকে বাড়ি আসার গল্পই চলল অনেকক্ষণ যাবৎ।
শফিক সত্য-মিথ্যা মিশিয়ে, মজা আর ভয় একসঙ্গে মিশিয়ে একটা দারুণ গল্প উপস্থাপন করল।
এবার মিশু বলল, ‘মামা, বৃষ্টি হলে কচুপাতা ভিজে না। কিন্তু অন্য সব পাতা ঠিকই ভিজে যায়। এমনটা কেন হয়?’
মামা হাসির ভঙ্গি করে বলল, ‘কচুপাতায় যে মোম লাগানো আছে, তাই ভিজে না।’
-‘ওমা! মোম কে লাগালো? আমি তো কাউকে দেখিনি মোম দিতে! শুধু কচুপাতাতেই কেন মোম দিলো, অন্য পাতা কী দোষ করেছে?’
-‘আরে মোম কেউ লাগায়নি। কচুপাতার ওপর মোমের মতো একটা স্তর আছে, যাকে বলে হাইড্রোফোবিক-মানে জলবিরোধী স্তর। জল বুঝো তো? জল মানে পানি। এই স্তরটা খুবই পাতলা থাকে। মূলত এর জন্যই কচুপাতায় পানি পড়লে ভিজে না।’
মাসুদ এতক্ষণ চুপ থেকে সব শুনছিল, হঠাৎ মামাকে বলে বসল,
‘আচ্ছা, এইটুকু ঠিক আছে, বুঝলাম। কিন্তু মামা, তুমি কী দেখেছ কচুপাতায় পানি দিলে কেমন গোল গোল বলের মতো হয়ে যায়? কী সুন্দর দেখায়, তাই না? গোলটা হয় কীভাবে, বলতো।’
-‘তুই এত কিছু খেয়াল করিস! আসলেই, কচুপাতায় পানি রাখলে সুন্দর দেখায়। তবে এর পেছনেও কাহিনি আছে। পাতার ওপরের দিকটা তৈরি হয় ছোট ছোট গর্ত ও খাঁজ নিয়ে, যাকে লোটাস ইফেক্ট বলে, যা আমরা সাধারণত চোখে দেখতে পাই না।
আর কচুপাতাটা কিন্তু অন্য পাতার মতো মসৃণ না, আবার অন্যসব পাতার মতো পানি শোষণও করে না। ফলে পানি গড়িয়ে না পড়ে, গর্তের জন্য গোল আকার ধারণ করে। এটা কচুপাতার এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য।’
মিশু আর মাসুদের চেহারায় বিস্ময়। কত কচুপাতা দেখেছে, পাতা নিয়ে খেলা করেছে, কিন্তু এই পাতার যে এত কাহিনি আছে, সেটা তো জানতো না।
মামা বিজ্ঞের মতো ভাব নিয়ে বলল,
‘বুঝলি মিশু, সবারই কিছু না কিছু বিশেষ গুণ আছে। আমার একটা গুণ আছে, দেখি তোরা বলতে পারিস নাকি?’
-‘মামা, তোমার গুণ হচ্ছে, নানাভাইয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে আমাদের বাড়ি চলে আসো কয়েক দিন পরপর!’
বলেই মাসুদ দৌড়!
রোকেয়া বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে হাসছে, মিশু মুখে হাত চেপে হাসি আটকাতে চাচ্ছে।
শফিক গলা তুলে বলতে লাগল,
‘এবার গেলে আর আসব না তোদের বাড়ি, বলে দিলাম!’