কয়েক দিন ধরে বনের রাজা সিংহ বেশ চিন্তিত সিংহী রানি অনেক চেষ্টা করে জানতে পারল চিন্তার কারণ। কিছুক্ষণ ভেবে সিংহী রাজাকে পরামর্শ দিল শেয়াল পণ্ডিতের শরণাপন্ন হতে। সিংহ তখনই হুংকার ছেড়ে পদাতিক খরগোশকে পাঠালো রাজদরবারে শেয়ালকে হাজির হতে। কিছুক্ষণের মধ্যে হাঁপাতে হাঁপাতে রাজ দরবারে উপস্থিত হলো শেয়াল। রাজার কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখে শেয়াল পণ্ডিত সিংহকে প্রণাম করে অপরাধীর মতো হাঁটু গেড়ে বসল। এবং বলল ‘বেয়াদবি মাফ করবেন রাজামশাই, আপনার হুকুমের অপেক্ষায় প্রস্তুত।’ শেয়ালের বিনয়ী আচরণ দেখে সিংহ মুচকি হেসে বলল- ‘আজ কোনো অপরাধের শাস্তির জন্য ডাকিনি, আজ ডেকেছি জরুরি প্রয়োজনে। যদি তুমি উপায় খুঁজে দিতে পারো তবে তোমার জন্য আছে পুরস্কার। আর যদি উপায় খুঁজে বের করতে না পারো তাহলে তোমাকে এক বছরের জন্য বন থেকে বহিষ্কার করা হবে।’ রাজার কথা শুনে শেয়াল পড়ে গেল মহা মুশকিলে! ভয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় শেয়াল বলল ‘জি রাজামশাই, আপনার হুকুম শিরধার্য।’ শেয়ালের কথা শেষ না হতেই সিংহ বলে উঠল ‘শোনো পণ্ডিত, তোমার বুদ্ধির প্রশংসা মুখে মুখে, রাজকার্যের জটিল সিদ্ধান্তেও তোমার মতামতের গুরুত্ব প্রাধান্য দিয়েছি। আজ আবার তোমার বুদ্ধির তারিফ করতে রাজদরবারে ডেকেছি। আশা করি, তুমি পুরস্কৃত হয়ে হাসতে হাসতে রাজদরবার ত্যাগ করবে। বেশ কিছুদিন ধরে আমি খুব চিন্তায় আছি, তা হলো নিরক্ষর মুক্ত বন। যেন আমাদের ছেলেমেয়েরা খাদ্য শিকার, আত্মরক্ষা এবং শিকারির ফাঁদ থেকে রক্ষা ও সাধারণ জ্ঞানে শিক্ষিত হতে পারে। সিংহের কথা শুনে শেয়াল পণ্ডিত রাজা মশাইকে অনুরোধের সুরে পাঠশালা তৈরির পরামর্শ দিল এবং মতামতের জন্য বনের সব পশুপাখিকে নিয়ে একত্র করার অনুরোধ করল। শেয়ালের পরামর্শে পরেরদিন বিকালে বনের সব পশুপাখিকে রাজ দরবারের মিটিংয়ে উপস্থিত হতে বলা হলো।
পরেরদিন দুপুর না হতেই রাজ দরবারে এক এক করে উপস্থিত হলো বাঘ, হাতি, হরিণ, ভাল্লুক, বানর, শেয়াল, জেব্রা, খরগোশ, কাঠবিড়ালী, অজগর। দূর থেকে ডানা মেলে উড়ে এলো কাঠঠোকরা, কাক, শালিক, ময়ূর এবং নাম না জানা আরও অনেক পাখি। এমনকি বনের বুক চিড়ে বয়ে যাওয়া নদীতে বসবাসরত কুমির, কচ্ছপ, ঘড়িয়ালও উপস্থিত হলো। সবশেষে লম্বা গলা উঁচিয়ে যোগ দিল জিরাফ। সময়মতো সবাইকে উপস্থিত হতে দেখে বনের রাজা সিংহ খুব খুশি হলো। কুশল বিনিময় করে সিংহ সবাইকে বলল, ‘অনেক ভেবেচিন্তে আমি একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি, তা হলো নিরক্ষর মুক্ত বন গড়তে চাই। যেন আমাদের বাচ্চারা সুশিক্ষিত হতে পারে। নিরক্ষর মুক্ত বন গড়ে তুলতে তোমরা অবশ্যই বাচ্চাদের পাঠশালায় পাঠাবে। উক্ত বিষয়ে তোমরা সবাই নির্ভয়ে তোমাদের মতামত দাও।’ সভায় বনের রাজার উদ্যোগের কথা শুনে উপস্থিত সবাই করতালির মাধ্যমে রাজাকে সমর্থন জানালো। সবার পেছন থেকে লম্বা গলা উঁচিয়ে জিরাফ জিজ্ঞাসা করল ‘রাজা মশাই, পাঠশালার নাম কী হবে?’ সিংহ তৎক্ষণাৎ কোনো উত্তর না দিয়ে সবার উদ্দেশে বলল, ‘সভায় যেহেতু সবাই উপস্থিত, সেক্ষেত্রে সবার মতামতের ভিত্তিতে পাঠশালার নামকরণ হবে।’
সিংহের এমন উদারতা দেখে সবাই এর ওর দিকে তাকিয়ে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। কিছুক্ষণ পর নীরবতা ভেঙে কান চুলকাতে চুলকাতে বানর বলে উঠল, ‘রাজ দরবারের পাঠশালা’। তারপর হাতি তার শুঁড় উঁচিয়ে বলল, ‘বনশিশুর পাঠশালা’। পর্যায়ক্রমে বাঘ, ভাল্লুক, অজগর, ময়ূর, কচ্ছপ, ঘড়িয়াল সবাই একটি করে নাম পেশ করল। শেয়াল তখনো বসে কী যেন ভাবছে। সবার নাম প্রস্তাবনা শেষে গলা ঝেড়ে শেয়াল বলে উঠল, ‘রাজা মশাই, আপনার সদয় অনুমতি পেলে আমি একটি নাম পেশ করব’। সিংহ বলল, ‘বলো বলো, এতক্ষণ ভেবে কী নাম তুমি খুঁজে পেলে।’ শেয়াল পণ্ডিত সবাইকে যুক্তি দেখিয়ে বলল, ‘‘এই স্কুলে যেহেতু বনের সব পশুপাখির শিশুরা লেখাপড়া করবে সেহেতু স্কুলটির নামকরণ ‘পশুপাখির পাঠশালা’ হলে ভালো হয়।’’ শেয়ালের উপস্থিত বুদ্ধি ও যুক্তিনির্ভর নাম শুনে রাজার খুব পছন্দ হলো। সবাই শেয়ালের দেওয়া নামকরণের পক্ষে মতামত জানাল। সন্ধ্যার আগেই মতামত ও আলোচনা সভার সমাপ্তি ঘোষণা করল সিংহ। সভা শেষে সবাই যার যার বাড়ি ফিরে গেল। পরেরদিন সকালে সবাই নিজের সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে এসে ভর্তি করল পশুপাখির পাঠশালায়। কয়েকদিনের মধ্যে প্রত্যেকেই নিজের নাম লেখা শিখল। রাজার উদ্যোগ, শেয়ালের পরামর্শ আর সবার সহযোগিতায় কয়েক বছরের মধ্যে বনের সব পশুপাখি হলো নিরক্ষর মুক্ত। দূর হলো রাজার চিন্তা। পূরণ হলো নিরক্ষর মুক্ত বন গড়ে তোলার স্বপ্ন।