বুধবার, ৯ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

সংবিধানে বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র উপেক্ষিত

শহীদুল্লাহ ফরায়জী

সংবিধানে বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র উপেক্ষিত

বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি রক্তের তলদেশ থেকে উত্থিত রাষ্ট্র, করোটির ক্যানভাসে যার মানচিত্র অঙ্কিত। অথচ এ রাষ্ট্রটিতে জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তির সংবিধান প্রণয়ন করতে রাষ্ট্র বারবার ব্যর্থ হচ্ছে, বরং সংবিধানের প্রশ্নকে বাদ দিয়ে বিমূর্তভাবে বাংলাদেশ নির্মাণের স্বপ্ন দেখা হচ্ছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ‘ঘাটতি’-‘সীমাবদ্ধতা’-‘স্ববিরোধিতার’ বাইরে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের সঙ্গে সংবিধানের সামাঞ্জস্যহীনতার প্রশ্নটি খুবই তাত্পর্যপূর্ণ।

তিনটি ভয়াবহ ভুল নিয়ে ৭২-এর সংবিধানের অভিযাত্রা শুরু হয়েছে : ১. ৭২-এর সংবিধানে বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা বা কোনো ধরনের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা হয়নি। এমনকি বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি সংরক্ষণের জন্য কোনো বিধানও সংবিধানে সংযোজন করা হয়নি। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের স্বাধীনতা অর্জনে বঙ্গবন্ধুর অপরিসীম অবদান ও নেতৃত্বের কথা সংবিধানের কোথাও একটিবারও উচ্চারিত হয়নি। বরং বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণার ঐতিহাসিক ন্যায্যতা সংবিধান কেড়ে নিয়েছে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করার বিষয়টি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে নিশ্চিত করার পরও সংবিধানে বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার ঘোষণাকারী হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান না করা; ২. স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ‘সাম্য’, ‘মানবিক মর্যাদা’ ও ‘সামাজিক সুবিচার’ নিশ্চিত করণার্থে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা এ অঙ্গীকার ঘোষণার পরও এ ত্রয়ী আদর্শকে রাষ্ট্রীয় আদর্শ না করা;

৩. শোষণ-নির্যাতন-নিপীড়নের রাষ্ট্র কাঠামো বিলুপ্ত করে, উচ্চতম মানবিক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের পরিবর্তে আবারও হানাদারি ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা পুনর্বহাল করা; এ তিনটি ত্রুটির কারণেই রাষ্ট্র থেকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ অপসারিত হয়ে যায়, আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্র ও মানবিক সমাজ বিনির্মাণের সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায় আর জাতি মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে। এ বিচ্যুতির সুযোগ নিয়েই সামরিক-অসামরিক কর্তৃত্ব সংবিধান কেটে-ছিঁড়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ইচ্ছেমতো প্রয়োগ করে প্রমাণ করছে যে, রাষ্ট্র এখন আগের চেয়ে নগ্ন নির্দয় প্রতিষ্ঠান। ঘোষণাপত্রের ঘোষিত ‘নেতৃত্ব’ ও ‘আদর্শ’ বাদ দিয়ে সংবিধান প্রণয়ন ঘোষণাপত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীনতার শামিল।  

৭২-এর সংবিধানের ভিত্তি হচ্ছে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র আর সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। ১০ এপ্রিল ৭১ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র (The Proclamation of Independence) জারি করা হয়। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি বাংলাদেশে প্রথম অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান। স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ার সর্বোচ্চ দলিল। এ সর্বোচ্চ দলিলের আলোকেই সংবিধান রচিত হবে। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণা এবং ত্রয়ী আদর্শ কোনো সংবিধান, কোনো সংসদ বা কোনো আইন পরিবর্তন করতে পারবে না, ঘোষণাপত্র অপরিবর্তনযোগ্য। কারণ ঘোষণাপত্র হচ্ছে শহীদের রক্তের সঙ্গে জনগণের সম্পাদিত চুক্তি। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, ... ‘বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ’৭১ সালের ২৬ মার্চ তারিখে যথাযথভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন’, আর ৭২-এর সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ‘আমরা, বাংলাদেশের জনগণ, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতার ঘোষণা করিয়া... অর্থাৎ ঘোষণাপত্রের ঘোষণাকারী বঙ্গবন্ধু আর সংবিধানে জনগণ এমন ঘটনা রাষ্ট্রীয় ইতিহাসে বিরল। সংবিধান কোনো ইতিহাস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান নয়। 

৭২-এর সংবিধানে একটি প্রস্তাবনাসহ ১৫৩ অনুচ্ছেদ ও চারটি তফসিলের কোথাও বঙ্গবন্ধুর নাম একবারও উচ্চারিত হয়নি। কোনো অবদানেরও স্বীকৃতি মেলেনি। ৭২-এর সংবিধান প্রণয়নের সময় বঙ্গবন্ধু হিমালয়ের উচ্চতা নিয়ে দণ্ডায়মান, যিনি ফাঁসির দড়ি বুক পকেটে নিয়ে পাকিস্তান কারাগার থেকে স্বদেশে ফিরে এসেছিলেন অথচ জীবিত অবস্থায় তার প্রাপ্য মর্যাদাটুকু সংবিধান দিতে পারেনি। ৭২-এর সংবিধানে বঙ্গবন্ধুকে যেভাবে উপেক্ষা, অস্বীকার এবং আড়াল করা হয়েছে তাতে মনে হয়, নিজ রাষ্ট্র ও নিজ জাতির কাছেই বঙ্গবন্ধু বহিরাগত, নিজ জন্মভূমিতেই নির্বাসিত।

যারা স্বাধীনতাহীন, অধিকারহারা, বঞ্চিত মানুষের অধিকার ফিরিয়ে দিতে রাষ্ট্র নির্মাণ করার জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম বা সশস্ত্র যুদ্ধ সংঘটিত করেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন, স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেছেন সেসব মহান নেতাদের নাম স্ব স্ব দেশ তাদের রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মূল্যবান দলিল সংবিধানের প্রস্তাবনায় অন্তর্ভুক্ত করে তাদের কালের বক্ষে অবিনশ্বর আসন করে দিয়েছে। মহান নেতাদের নাম সংবিধানের প্রস্তাবনায় অন্তর্ভুক্ত করায় সেসব দেশ ও সংবিধান নক্ষত্রসম উজ্জ্বলতা পেয়েছে। অবিনশ্বর নেতাদের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ কোথাও স্বাধীনতার জনক বা Father of the Nation কোথাও Founder of Independence কোথাও Father of the Fatherland কোথাও Father of the Homeland কোথাও Leader of the Nation কোথাও Visionary of the State উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া সাইমন বলিভারকে Honorific title “Liberator” নামে অভিহিত করা হয়েছে। ৭২-এর সংবিধানের প্রস্তাবনায় স্বাধীনতার স্থপতি বা জাতির জনক তো দূরের কথা সংবিধান প্রণেতারা বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণের প্রয়োজনীয়তাই মনে করেননি।

অথচ তুরস্কের সংবিধানের Preamble বলা হয়েছে The Founder of the Republic of Turkey, Ataturk, the immortal leader and the unrivalled hero. ভিয়েতনামের সংবিধানের Preamble মহান নেতা Ho Chi Minh এর নাম দুই দুবার উচ্চারিত হয়েছে। একবার ১৯৩০ সালের সংগ্রামের ভূমিকার জন্য, আরেকবার Announced the Declaration of Independence এর জন্য। মিসরের সংবিধানে Mohamed Ali founded the modern Egyptian State এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। চীনের সংবিধানে

 

The Revolution of 1911, led by Dr. Sun Yat-sen...the Communist party of China with Chairman Mao Zedong as its leader Ultimatly... উত্তর কোরিয়ার সংবিধানের Preamble জনগণের মহান নেতা Comrade Kim Il Sung এর নাম বারবার উচ্চারিত হয়েছে।  তার চিন্তা-চেতনা-স্বপ্ন ও সংগ্রামের অবদানকে কয়েকবার উদ্ভাসিত করা হয়েছে সংবিধানের প্রস্তাবনায়। যেমন The Great leader Comrade Kim Il Sung is the sun of the nation...।  আর ভেনেজুয়েলার সংবিধানের Preamble বলা হয়েছে... The Historic Example of our Liberator Simon Bolivar. ভেনেজুয়েলা, বলিভিয়া, কলম্বিয়া, ইকুয়েডর, পেরু, পানামা স্বাধীনতার প্রশ্নে সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে Simon Bolivar-কে সম্মান প্রদান করা হয়। 

আর বঙ্গবন্ধু হচ্ছে স্বাধীনতার সমার্থক-স্বাধীনতার সমকক্ষ। বঙ্গবন্ধু ছিলেন সাড়ে সাত কোটি মানুষের চেতনার প্রতিনিধিত্বকারী নেতৃত্ব। স্বাধীনতার প্রশ্নে সদা-সর্বদা-সর্বাগ্রে বঙ্গবন্ধুর নামই উচ্চারিত হবে। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চে হাজার বছরের শৃঙ্খল ভেঙে, দৈন্য গ্লানি অতিক্রম করে আজন্ম সাধনার ধন স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে আনতে সব বিরোধ ছাপিয়ে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। যা বাঙালির ইতিহাসে বিরল। সে কারণেই রক্তের উত্তরাধিকার বাংলাদেশের সংবিধানে একটি নামও যদি বহন করতে হয় তা বঙ্গবন্ধুর নাম বহন করতে হবে।

মুক্তি-সংগ্রামের মাধ্যমে জনগণের আকাঙ্ক্ষা, উদ্দেশ্য ও রাষ্ট্রের লক্ষ্য কী তা নির্ধারিত করা আছে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে। ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, “বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করণার্থে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্ররূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করিলাম”... অর্থাৎ এ ত্রয়ী আদর্শ বাস্তবায়ন করার জন্য বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করা হয়েছে। এটাই বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় দর্শন। এটা জাতির অঙ্গীকার, ঘোষণা, সংকল্প, প্রতিশ্রুতি। এ ত্রয়ী আদর্শ মানেই স্বাধীনতা বা বাংলাদেশ। স্বাধীনতাকে এ ত্রয়ী আদর্শ থেকে আলাদা করা যাবে না, পৃথক করা যাবে না। এ তিন আদর্শকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, বাধাগ্রস্ত করতে পারে এমন আইনই প্রণয়ন করা যাবে না। এ তিন আদর্শকে নিরাপদ করতে হবে, সুরক্ষা দিতে হবে। এ আদর্শ তিনটি স্বাধীনতাকে হিরন্ময় দ্যুতি প্রদান করেছিল, এ প্রতিশ্রুতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে জনগণ আত্মদান করেছেন। কিন্তু সংবিধানে এ তিন আদর্শকে সম্পূর্ণভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে। ’৭২-এর সংবিধানে গভীর গোপনীয়তার সঙ্গে সত্যকে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকেই আমাদের সর্বনাশের শুরু। আমরা অসত্য এবং বিকৃতিকে বয়ে চলছি সংবিধানের ভিতরে।

সংবিধানের প্রস্তাবনায় প্রতিফলিত হয়ে থাকে জাতির ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত, জাতীয় পরিচয়ের স্বরূপ, জাতির গন্তব্য, সামাজিক-আর্থিক ও রাজনৈতিক প্রসঙ্গ এবং জাতীয় প্রেরণামূলক উপাদানসমূহ। কিন্তু ৭২’ সালের সংবিধানে এসবকিছু ঠাঁই পায়নি। স্বাধীনতার বীজ বপন করা হয়েছিল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। এর সূত্র ধরেই ২ মার্চ, ৩ মার্চ, ৭ মার্চের ভাষণ এবং ২৬ মার্চ চূড়ান্তভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা।

যে সংবিধানের প্রস্তাবনায় বঙ্গবন্ধুর কোনো স্বীকৃতি নেই-৫২’র ভাষা আন্দোলনের কথা নেই, ৭ মার্চের কথা নেই, ত্রিশ লাখ শহীদের কথা বা ২৫ মার্চে সংঘটিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণহত্যার কথা নেই, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের আদর্শ সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের কথা নেই, সেই সংবিধান কীভাবে মুক্তি-সংগ্রামের সংবিধান হবে। বঙ্গবন্ধুর শাসনকালও নিঃসন্দেহে বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। রক্ষীবাহিনী গঠন, চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় শাসন, প্রথম সংসদের মেয়াদ বৃদ্ধি, প্রত্যক্ষ নির্বাচনের বিধান উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ এমন কার্যকলাপের দায় অবশ্যই বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগকেই বহন করতে হবে। কিন্তু সেজন্য স্বাধীনতা নির্মাণে বঙ্গবন্ধুর অপরিসীম অবদানকে কোনোকিছুতেই খর্ব করা যায় না।

রক্তের নদীতে উদ্ভাসিত রাষ্ট্রের সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে বঙ্গবন্ধুকে, ভাষা আন্দোলনকে, ৭ মার্চকে এবং ত্রয়ী আদর্শকে সুকৌশলে নির্বাসনে দেওয়া হয়েছে। তা গত ৪৪ বছরে কেউ প্রতিবাদ করেনি। সংবিধানের ভয়াবহ ভুল অনুধাবনের পরও কেউ কেউ ইনিয়ে বিনিয়ে যুক্তি তুলে ধরবে-অর্থহীন ঔদ্ধত্য দেখাবে, মিথ্যার জন্য আকুলতা প্রকাশ করবে কিন্তু সত্যের পক্ষে অবস্থান নেবে না এমনটি দুর্ভাগ্যজনক। ফ্রান্স বিপ্লবের মূলমন্ত্র ছিল ‘Liberty’, ‘Equality’ and ‘Fraternity’ মুক্তি, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব। এ ত্রিমন্ত্র আধুনিক যুগের সব বিপ্লবের প্রেরণা হয়ে আছে। ফরাসি বিপ্লবের নারী প্রতীক হচ্ছে ‘Liberty’। ১৭৯২ সালে যখন ফরাসি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয় তখন ‘Liberty’কে প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করা হয়। পরবর্তীতে ত্রিমন্ত্রকে ‘Liberty’র প্রতিকৃতিতে খোদাই করে স্থান করে দেওয়া হয়েছে। এখন ‘Liberty’ বিশ্ব রাজনীতিতে খুবই প্রভাবশালী। অথচ এত গণহত্যা, হত্যার উন্মত্ততা, নিষ্ঠুরতা, অগ্নিসংযোগ এবং লজ্জাহানির বেদনা নিয়ে যে রাষ্ট্রের জন্ম সেই রাষ্ট্রে কোনো আদর্শ নেই-রক্তে নিমজ্জিত জাতির দ্রোহ প্রকাশিত করার কোনো প্রতিকৃতি নেই। সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার ছিল সবচেয়ে উচ্চতম আদর্শ। আমরা ঔপনিবেশিক রাজনীতির মোহগ্রস্ততায় তা পরিত্যাগ করেছি। আর ত্রিশ লাখ শহীদের রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় প্রতীক করেছি শাপলা, ধানগাছ, পাটগাছ দিয়ে। বাহাত্তরের সংবিধান ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা, নিপীড়ন, দুঃশাসনের বিলোপ না করে আবার তা পুনর্বহাল করেছে। জনগণের মুক্তি ও সমাজব্যবস্থা রূপান্তরের নির্দেশনা দিতে ব্যর্থ হয়েছে এবং সমাজের মৌল কাঠামোতে অর্থবহ পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়েছে। ‘অবিসংবাদিত নেতা’ বঙ্গবন্ধুকে বিতর্কিত করার বঙ্গবন্ধুর হাতে ঔপনিবেশিক শাসনের হাতকড়া পরিয়ে বঙ্গবন্ধুকে চিরকালীন বিদায়ের আয়োজন করেছে। এসব গভীর সত্য অনুধাবন করতে না পারলে এবং রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক দলিল সংবিধানকে মুক্তি-সংগ্রামের আদর্শভিত্তিক না করলে আমরা ক্রমাগত মুক্তি-সংগ্রামের চেতনা থেকে বিচ্যুত হতেই থাকব আর ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মা আমাদের ঘৃণা, তিরস্কার ও ভর্ত্সনা দিতে থাকবে।  বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসেবে বা কোনো ধরনের সাংবিধানিক স্বীকৃতি না দেওয়ার কারণ এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অস্বীকার করে কেন ৭২-এর সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছিল তার কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা আওয়ামী লীগ আজও দেয়নি। মার্টিন লুথার কিং বলেছিলেন, ‘মানবতা খুব বেশি দিন বর্ণবাদ এবং যুদ্ধের নক্ষত্রহীন অন্ধকার রাতে দুঃখজনকভাবে বাধা থাকতে পারে না’, তেমনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শও ঔপনিবেশিকতার নৃশংস রাজনীতিতে আবদ্ধ থাকবে না-স্বপ্ন কখনো হারায় না।

লেখক : গীতিকবি

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর