প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ যেন মাদকের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। গ্রাম-শহর সর্বত্রই মাদকের ছড়াছড়ি। আজ থেকে ১০ বছর আগেও এত ভয়াবহ অবস্থা ছিল না। শৈশবে যাদের সঙ্গে হাসি খেলা ছিল গ্রামে গেলে তাদের এখন নেশায় বুঁদ হয়ে পড়ে থাকতে দেখি। ওদের কেউ মামাতো ভাই, আবার কেউ বন্ধুও। এদের করুণ জীবন দেখে প্রথমে ভিতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। তারপর দুচোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে। হে আল্লাহ! আমাকে হেফাজত করেছেন সাথীরা কেন বিপথগামী হলো। তাদেরও ফিরিয়ে আনুন কোরআনের পথে। দেশব্যাপী মাদকের ভয়াবহতা যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তা কল্পনার চেয়েও মারাত্মক। আর এ কারণে পরিবার ও সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে প্রতিনিয়ত। অন্যদিকে একশ্রেণির রাজনৈতিক নেতা, এগুলোকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন। তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে সীমান্তপথ উন্মুক্ত রয়েছে। ভারত, মিয়ানমার প্রভৃতি দেশ থেকে এসব নিষিদ্ধ দ্রব্য আমাদের দেশে বিনা বাধায় প্রবেশ করছে। বাংলাদেশের সীমান্তে এক ডজনেরও বেশি ফেনসিডিল ও মাদক কারখানা স্থাপন করা হয়েছে। যার উৎপাদিত প্রায় সবটুকুই এদেশে সরবরাহ করা হয়।
সরকারি মাদক অধিদফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট মাদকাসক্তের ৯০ শতাংশই কিশোর, যুবক ও ছাত্রছাত্রী। যাদের ৫৮ ভাগ ধূমপায়ী এবং ৪৪ ভাগ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। মাদকাসক্তদের গড় বয়স এখন ১৩ বছরে এসে ঠেকেছে। আসক্তদের ৫০ শতাংশের বয়স ২৬ থেকে ৩৭ বছরের মধ্যে। বিস্ময়কর তথ্য হলো- দেশের মোট মাদকসেবীর মধ্যে অর্ধেকই উচ্চশিক্ষিত। দিনমজুর, রাজমিস্ত্রি, রডমিস্ত্রি, বাস-ট্রাক, বেবিট্যাক্সি ও রিকশাচালকদের মধ্যেও বহু মাদকাসক্ত রয়েছে। বিশ্বের প্রায় ১০০ কোটি তামাকসেবীর মধ্যে শতকরা ২০ ভাগ হলো নারী। আবার বাংলাদেশের ৪৩ ভাগ লোক তামাকসেবী। মাদক সেবনের ক্ষতিকর দিক উল্লেখ করে বিশিষ্ট অমুসলিম গবেষক ‘মার্ক এস গোল্ড’ লেখেন, মাদক সেবনে ব্যক্তি শারীরিক ক্ষতির শিকার হয় বেশি। লিভার প্রসারিত হওয়া, মুখ ফুলে ও বিকৃত হওয়া, হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়া, বুক ও ফুসফুস নষ্ট হওয়া, যৌনশক্তি কমে যাওয়া, স্ত্রীর গর্ভে ঔরসজাত সন্তান বিকলাঙ্গ হওয়াসহ প্রায় ২০ ধরনের মারাত্মক ক্ষতি হয় মাদক সেবনে। ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য গ্রহণের ফলে ফুসফুস ও মুখগহ্বরে ক্যান্সারসহ ২৫ ধরনের রোগ সৃষ্টির সম্ভাবনা থাকে বলে উল্লেখ করেছেন ওই গবেষক। শারীরিক ক্ষতি ছাড়াও মাদক সেবনের ফলে মানসিক, পারিবারিক ও আর্থিক ক্ষতি হয়ে থাকে। হয় সামাজিক ক্ষতিও। বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা সড়ক দুর্ঘটনা। এ সমস্যার প্রত্যক্ষ কারণ ড্রাইভারদের মাদক সেবন।
এতসব ক্ষতির কথা বিবেচনায় রেখেই আল কোরআন মাদক সেবন সম্পূর্ণ নিষেধ তথা হারাম ঘোষণা করেছে। তবে মাদক একদিনে হারাম হয়নি। যেহেতু এটি মানুষের দীর্ঘদিনের নেশা ছিল। তাই হঠাৎ করে মাদক ছাড়া সম্ভব নয়। তাই তিনটি পর্বে আল্লাহতায়ালা মাদক নিষেধ করেছেন। আজকের দিনেও কেউ যদি মাদকের অন্ধকার জগৎ থেকে আলোর জগতে ফিরে আসতে চায় তার ক্ষেত্রে ক্রমান্বয়ে ফিরে আসার সুযোগ রয়েছে। শর্ত হলো ফিরে আসার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করতে হবে তাকে। চলুন জেনে নিই মদ নিষিদ্ধ করার কোরআনিক পলিসি।মুসলমানরা রসুল (সা.)-এর কাছে এসে মদপানের বিধান সম্পর্কে জানতে চাইলে আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহি নাজিল হয়, ‘হে নবী! তারা আপনার কাছে মদপান ও জুয়া সম্পর্কে জানতে চায়। আপনি বলুন, এ দুটোতেই রয়েছে বড় গোনাহ। তবে কিছু উপকার অবশ্যই আছে।’ (সূরা বাকারাহ : ২১৯)। এ আয়াত নাজিল হওয়ার পর একদল লোক গোনাহের কথা চিন্তা করে মদ ছেড়ে দিল বা কম পান করতে লাগল। আর যারা এখনো পান করা ছাড়েনি তারা ছেড়ে দেওয়ার মানসিক প্রস্তুতি নিতে লাগল। হজরত ওমর (রা.) দোয়া করলেন, হে আল্লাহ! এ আয়াতে তো আপনি মদ পান করব— না ছাড়ব এ বিষয়ে স্পষ্ট কিছু বলেননি। আমাদের স্পষ্ট নির্দেশ দিন। এদিকে এক রাতে আলী (রা.) মদপান করে এশার নামাজে দাঁড়ালেন। নেশার ঘোরে তিনি সূরা কাফেরুন ভুল পড়লেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহতায়ালা নাজিল করলেন, ‘ওহে ইমানদারগণ! তোমরা নেশা অবস্থায় নামাজের কাছেও এসো না, যতক্ষণ না তোমরা যা বল তা বুঝতে না পার।’ (সূরা নিসা : ৪৩)। এর পর লোকেরা নামাজের কারণে দিনের বেলায় আর মদপান করতে পারত না। সন্ধ্যায় এশা পড়ে পান করত ফজরের আগে নেশা কেটে যেত। এ অবস্থা দেখে ওমর (রা.) আবার আগের মতো দোয়া করলেন আল্লাহর দরবারে। এবার মদের ব্যাপারে চূড়ান্ত নির্দেশ নাজিল হলো। আল্লাহ বলেন, ‘হে ইমানদারগণ! জেনে রাখ, মদ, জুয়া, ভাগ্য নির্ণয়ের জন্য হাত গণনা— এগুলো সবই নোংরা এবং শয়তানি কাজ। তোমরা এগুলো বর্জন কর, তবেই সফলকাম হবে।’ (সূরা মায়েদা : ৯০)।
ঠিক কবে থেকে মানব সমাজে মাদকের বিস্তার ঘটে এ সম্পর্কে বলা কঠিন। তবে প্রকাশ্যে মাদক সেবনের ইতিহাস আমাদের অজানা নয়। ঐতিহাসিক পিকে হিট্রির লেখা থেকে জানা যায়, জাহেলি যুগে আরবদের প্রিয় ও নিত্য ব্যবহার্য তিনটি বস্তুর একটি ছিল মদ। আমাদের যেমন ভাত না হলে চলে না, তেমনি তাদেরও মদ না হলে চলত না। দিনরাত আকণ্ঠ মদে ডুবে থাকাকে ফ্যাশন এবং আভিজাত্যের চিহ্ন মনে করত আরবরা। সেই অন্ধকার সমাজে আলোর ফোয়ারা হয়ে এলো আল কোরআন। মদপ্রিয় সেই জাতি থেকেই তৈরি হলো ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সন্তানগুলো। বিশ্বব্যাপী যদি আবারও আল কোরআনের হেদায়েত মানবজীবনে ফোকাস করা যায় তবে মাদক সমস্যাসহ যে কোনো সমস্যা সহজেই দূর হয়ে শান্তির পায়রা ওড়বে মানবজীবনে।
লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব
www.selimazadi.com