অটিজম এক বিশেষ ধরনের মানসিক প্রতিবন্ধকতা যা শুরু হয় শৈশবে কিন্তু স্থায়িত্ব প্রায় সারা জীবন। সাধারণভাবে মানসিক প্রতিবন্ধী বলতে মানসিকভাবে পিছিয়ে পড়া বা অপরিপক্ব বুদ্ধিসম্পন্ন শিশুদেরই বোঝানো হয়। কিন্তু অটিজম এমন এক বিশেষ ধরনের প্রতিবন্ধকতা যা জড়োবুদ্ধি বা কমবুদ্ধি থেকে পৃথক। এই শ্রেণির প্রতিবন্ধকতার বৈশিষ্ট্য হলো শিশুর ইন্দ্রিয়গুলোর গঠনমূলক গুণ অক্ষুণ্ন থাকলেও কার্যক্ষমতা ক্রমশ কমে যায়। অর্থাৎ ইন্দ্রিয় সচেতনতা কমতে থাকে। যার ফলে বাকি মানসিক এবং সামাজিক গুণগুলোও প্রকাশিত হয় না। যেমন— একজন অটিস্টিক শিশুর শ্রবণযন্ত্র স্বাভাবিক থাকলেও শিশু শ্রবণ সংবেদনের সঠিক ব্যাখ্যা করতে পারে না। তাই শিশু ডাকলে সাড়া দেয় না বা শব্দে প্রতিক্রিয়া করে না। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় যে শিশু বধির। দৃষ্টি সংবেদনেও একই রীতি অনুসরণ করে। সামনে উত্তেজক ব্যক্তি বা বস্তু থাকলেও শিশু প্রতিক্রিয়া দেখায় না। এর ফলে সামাজিক শিক্ষা বা সাধারণ শিক্ষা কোনোটাই হয় না বা মাত্রাভেদে নিম্নমানের হয়। ডা. মল্লিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অটিজম’ বইতে অটিস্টিক শিশুর কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো— ১. সবার মাঝে থেকেও একাকিত্ব। ২. অস্বাভাবিক খেলা, যেমন—জড়োবস্তু নিয়ে তাৎপর্যহীন খেলা। ৩. যে কোনো বস্তু নিয়ে ঘোরানো বা পাক খাওয়ানো; যেমন—খেলনা গাড়ি হাতে পেলে সেটি উল্টে চাকাটা হাত দিয়ে ঘোরানো ইত্যাদি। ৪. অন্য ব্যক্তি বা বস্তুর প্রতি ঔদাসীন্য। ৫. অদ্ভুত গতিবিধি এবং মুদ্রাদোষ, যেমন—অপ্রয়োজনীয় হাঁটা, অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে মুখে শব্দ করা ইত্যাদি। ৬. অস্বাভাবিক শিখন পদ্ধতি আয়ত্ত করতে না পারা। ৭. অস্বাভাবিক সামাজিক আচরণ। ৮. বাকহীনতা বা বাকস্বল্পতা। ৯. স্থান, কাল বা ব্যবহারের পরিবর্তনে অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া। ১০. দৃষ্টি বিনিময়ের অভাব—মানুষের সঙ্গে অথবা বস্তুর সঙ্গে। ১১. অর্থহীনভাবে শব্দের প্রতিধ্বনি করা। ১২. বিশৃঙ্খল আচরণ। ১৩. কখনো কখনো কোনো বিষয়ে বিশেষ দক্ষতা, যেমন—গান, অঙ্ক ইত্যাদি। ১৪. বুদ্ধ্যাঙ্ক স্বাভাবিক বা উচ্চমানেরও হতে পারে। মনে রাখতে হবে, সবগুলো লক্ষণই একটি শিশুর মধ্যে থাকবে না। লিও ক্যানারের আবেগজনিত অক্ষমতার তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে, অর্থাৎ ‘সর্বাঙ্গসুন্দর শিশু একটি কাচের বক্সের মধ্যে’—এই বর্ণনার ওপর ভিত্তি করে এবং এই কাচের দেওয়াল ভাঙতে হবে এই উদ্দেশ্য নিয়ে—১৯৫০ সাল থেকে পরিচালনা পদ্ধতির গবেষণা শুরু। মনোশিক্ষণের ওপর ভিত্তি করে বেটেলহেম (১৯৬৭), ভাষাবিজ্ঞানের তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে রাটার এবং স্কপলার (১৯৭৮); আচরণ সম্বন্ধীয় চিকিৎসা তত্ত্ব, বৌদ্ধিক তত্ত্ব এবং শিখনের বিভিন্ন তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে লোরনা উইং (১৯৭৬), আইভার লোভাস (১৯৭৭) এবং আরও অনেকে কিছু কিছু অত্যন্ত কার্যকরী পরিচালন পদ্ধতির কথা বলে গেছেন। সত্তরের দশকে গবেষণার ভিত্তি হলো বুদ্ধি ও ভাষা প্রকাশের অক্ষমতা থেকেই আসে আবেগজনিত অক্ষমতা। আইভার লোভাসের পরবর্তী কাজে (১৯৮৭) মূলত বুদ্ধি এবং বিদ্যালয় শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়েই পরিচালন পদ্ধতি নির্দেশ করা হয়েছে। এর পরবর্তী অর্থাৎ আশির দশকের শেষ এবং নব্বই দশকে আবার ক্যানার তত্ত্ব পরিচালন পদ্ধতি প্রাধান্য পেয়েছে। ডয়সন (১৯৮৯) এবং ফ্রিথ (১৯৮৯) অটিজমের এক সামগ্রিক ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করেছেন— যাতে আছে সামাজিক আবেগজনিত এবং বৌদ্ধিক প্রতিবন্ধকতার পারস্পরিক সম্বন্ধ। আধুনিক গবেষণায় কোনো একটি লক্ষণকে প্রাধান্য না দিয়ে দুটি বা তিনটি মূল লক্ষণের পারস্পরিক সম্বন্ধের ওপর ভিত্তি করে পরিচালন পদ্ধতি নির্ধারণ করা হয়েছে (কোহেন এবং বোল্টন, ১৯৯৩)। সূচনা ফাউন্ডেশন, নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার (এনডিডি) এবং মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে অ্যাডভোকেসি, গবেষণা, দক্ষতা বৃদ্ধির কাজে নিয়োজিত অলাভজনক বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠান। সূচনার লক্ষ্য হচ্ছে এনডিডি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের সদস্যদের জীবনে কার্যকর সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত করা। মানসিক স্বাস্থ্য ও এনডিডি সংক্রান্ত নীতিমালা ও কার্যক্রম সমূহকে একত্রীভূত ও বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে সায়মা ওয়াজেদ হোসেনের প্রচেষ্টায় ২০১১ সালে (অটিজম স্পিকস এবং WHO-এর যৌথ উদ্যোগে) গ্লোবাল অটিজম পাবলিক হেলথ ও ২০১২ সালে গ্লোবাল অটিজম বাংলাদেশের জন্ম হয়। এরই ধারাবাহিকতায় প্রতিষ্ঠিত হয় আজকের সূচনা ফাউন্ডেশন। সায়মা ওয়াজেদ হোসেনের অক্লান্ত চেষ্টার ফলশ্রুতিতে ‘নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজেবিলিটি সুরক্ষা আইন-২০১৩’ পাস হয়। এর পাশাপাশি WHO-এর রেজুলেশন নং-SEA/RC65/R8 & WHA 67.8 গৃহীত হয়। এর ফলে বাংলাদেশের জাতীয় নীতিমালা এবং জাতিসংঘের উন্নয়ন পরিকল্পনায় মানসিক স্বাস্থ্য, অটিজম ও অন্যান্য এনডিডিযুক্ত ব্যক্তিদের কার্যকর সেবা ও সহায়তা প্রদানের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
UNISDR প্রণীত আন্তর্জাতিক নির্দেশিকাগুলোর মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য এবং বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সমস্যাগুলোর অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করার জন্য সায়মা ওয়াজেদ হোসেন বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাবিষয়ক মুখপাত্র হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন। সম্প্রতি সায়মা ওয়াজেদ হোসেন
WHO-এর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের অটিজমবিষয়ক শুভেচ্ছাদূত হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন। সূচনা ফাউন্ডেশনের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে, মানসিক স্বাস্থ্য এবং নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পথচলায় সহযোগিতা করা, যেন তারা আর্থিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সমাজের উন্নয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়ে শুধু তাদের ডিজঅর্ডার বা সমাজ কর্তৃক কোনো বৈষম্যের কারণে। সূচনা ফাউন্ডেশন এমন একটি সমাজের কথা চিন্তা করে, যেখানে যে কোনো ধরনের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য সহায়ক এবং উপযুক্ত পরিবেশ বিদ্যমান যেন তারা একটি কার্যক্ষম ও অর্থবহ জীবনযাপন করতে পারে। সূচনার লক্ষ্য হচ্ছে এমন কর্মসূচি গ্রহণ করা, যা অভিনব, কার্যকরী এবং স্বল্প ব্যয়ের ফলে তা বর্তমান রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোয় সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ের অংশীদারিত্বের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।