বাংলার প্রকৃতিতে এখন চলছে বর্ষা ঋতু। বর্ষা মানেই বৃষ্টি। বৃষ্টি মানেই রিনঝিন ছন্দে ভাবুক মনকে জাগিয়ে তোলা। কবিকে আরও কবি এবং বিরহী প্রেমিককে আরও বিরহী করে তোলাই বর্ষার কাজ। পৃথিবীর সব দেশের জলবায়ু এক নয়। তাই উপমহাদেশ ছাড়া আর কোথাও বর্ষার ছায়া পড়েছে কিনা বলা মুশকিল। কোথাও এখন প্রচণ্ড গরম, আবার কোথাও তুমুল শীত। ভিন্ন ভিন্ন ঋতুবৈচিত্র্যের এই পৃথিবীতে একই সময় একই ঋতু হওয়াটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এটা বৈজ্ঞানিক সত্য। তবে সত্যের আরেকটি দিক আছে। তাই আমি বলতে চাই, ঋতুবৈচিত্র্যের এই পৃথিবীতে একই সময় একটি ঋতুর ফুল ফুটতে পারে। বইতে পারে একটি সুরের হু হু বাতাস। সেই ঋতুর নাম হজ ঋতু। হ্যাঁ পাঠক! পৃথিবীজুড়ে বইছে এখন হজের হাওয়া। দুনিয়ার এ প্রান্তে-ও প্রান্তে চলছে এখন হজ ঋতু।
বসন্ত এলে যেমন কোকিল ডাকে, নানা রঙের ফুল ফোটে, শীত এলে যেমন অতিথি পাখিরা এসে ভিড় জমায় ভিনদেশ থেকে, তেমন হজের মৌসুমেও আল্লাহপ্রেমী বান্দারা নানান দেশ থেকে নানা রং মেখে কাবা শরিফের চারপাশে ভিড় জমায় লাব্বাইকের গান গাওয়ার জন্য। কণ্ঠে তাদের কোকিলের সুর ফোটে। আশ্চর্য মধু মাখিয়ে প্রত্যেক হাজী গাইতে থাকেন হজ ঋতুর অমীয় সংগীত— লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক। লাব্বাইক লা শারিকালাকা লাব্বাইক। পৃথিবীর ৭৫০ কোটি মানুষ থেকে বাছাই করে অল্প কিছু মানুষ কাবার ছায়ায় নিজেকে মেলে ধরে। এটা কি চাট্টিখানি কথা? না। এটা বড়ই সৌভাগ্যের বিষয়। এ বছর যারা আরাফাতের ময়দানে রোদে পুড়বেন, রহমতের বৃষ্টিতে ভিজবেন, তারা তাদের জন্মের হাজার হাজার বছর আগে লাব্বাইক বলেছিলেন ইবরাহিম আলাইহিস সালামের ডাকে সাড়া দিয়ে। তাই তো আজ তারা সত্যিকার কাবার ছায়ায় নিজেদের জায়গা করে নিতে পেরেছেন পরম যত্নে। হাজার হাজার বছর আগে ইবরাহিম আলাইহিস সালাম তাঁর প্রিয় পুত্র ইসমাইল আলাইহিস সালামেরকে নিয়ে কাবাঘর তৈরি করেছেন। আল্লাহ নিজেই তাদের এ ঘর বানানোর নির্দেশ দিয়েছেন। যখন তাঁরা কাবাঘরের পিলার ওঠাচ্ছিলেন তখন তাঁরা আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন। পিতা-পুত্রের এই প্রেমময় দৃশ্য আল্লাহর কাছে এত ভালো লেগেছে যে, অক্ষরের তুলি দিয়ে কোরআনের পাতায় এঁকে দিয়েছেন। কোরআনের ভাষায়, ‘ওয়াইজ ইয়ার ফায়ু ইবরাহিমুল কাওয়াইদা মিনাল বাইতি ওয়া ইসমাইল। রব্বানা তাকাব্বাল মিন্না ইন্নাকা আনতাস সামিউল আলিম। হে পৃথিবীর মানুষ! স্মরণ কর, যখন ইবরাহিম-ইসমাইল কাবাঘরের ফাউন্ডেশন করছিল, তখন তারা বলছিল, হে প্রভু! আমাদের পক্ষ থেকে এ ঘরকে কবুল করুন। নিশ্চয় আপনি সব শোনেন। সব দেখেন।’ সূরা বাকারাহ : ১২৭। বুখারিতে ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘একদিন ইবরাহিম আলাইহিস সালাম তাঁর ছেলেকে ডেকে বলছেন, প্রিয় পুত্র আমার! আল্লাহতায়ালা আমাকে আদেশ করেছেন তাঁর বান্দাদের ইবাদতের জন্য একটি ঘর বানাতে। তুমি কি আমাকে এ কাজে সাহায্য করবে? ইসমাইল আলাইহিস সালাম বললেন, অবশ্যই করব হে পিতা আমার। তখন তাঁরা বাপ-বেটা মিলে বায়তুল্লাহ বানানোর কাজে লেগে যান। ইসমাইল আলাইহিস সালাম পাথর এনে দেন আর ইবরাহিম আলাইহিস সালাম তা গাঁথেন। এ সময় তারা দোয়া করছিলেন। সূরা বাকারায় আল্লাহতায়ালা সে কথাই তুলে ধরেছেন।’ বুখারি।
যখন ঘর বানানো শেষ হলো, তখন আল্লাহতায়ালা ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে ডেকে বললেন, ‘ওয়া আজ্জিন ফিন্নাসি বিল হাজ্জিয়া তুকা রিজালান ওয়া আলা কুল্লি দামিরিন ইয়াতিনা মিন কুল্লি ফাজ্জি আমিক। হে আমার প্রিয় বন্ধু ইবরাহিম! তুমি মানুষের মাঝে হজের আজান দিয়ে দাও। এ ঘোষণা শুনে তারা তোমার কাছে আসবে হেঁটে, জীর্ণ উটে চড়ে, দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে।’ সূরা হজ : ২৮। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘যখন আল্লাহ ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে বললেন, তুমি হজের ঘোষণা দাও তখন তিনি বললেন, হে আল্লাহ! এই নির্জন এলাকায় আমি কার জন্য ঘোষণা দেব? এখানে তো আমরা ছাড়া আর কাউকে দেখছি না। তখন আল্লাহ বললেন, তোমার দায়িত্ব ঘোষণা দেওয়া আর আমার দায়িত্ব মানুষের কানে পৌঁছে দেওয়া। তখন ইবরাহিম আলাইহিস সালাম আবু কুবাইস পাহাড়ে উঠে দুই কানে আঙুল চেপে প্রচণ্ড জোরে হজের আজান দিলেন। ডানে-বাঁয়ে, ওপরে-নিচে মুখ ঘুরিয়ে তিনি হজের ঘোষণা দিলেন। আল্লাহতায়ালা এ ঘোষণাকে পৃথিবীর মানুষের কানে কানে পৌঁছে দিলেন। এমনকি রুহের জগতে যারা ছিল, তাদের কানেও। যারা ইবরাহিম আলাইহিস সালামের এ ঘোষণা শুনেছেন, তারা সঙ্গে সঙ্গে লাব্বাইক বলে সাড়া দিয়েছেন। কিবতাব বলছে, যারা ইবরাহিম আলাইহিস সালামের মুখে হজের আজান শুনেছেন, শুধু তারাই পৃথিবীতে হজের ময়দানে গিয়ে লাব্বাইকের কোকিল হয়ে প্রেমের গান গাওয়ার সৌভাগ্য পেয়েছেন।’ তাফসিরে তাবারি।হে আমার প্রিয় হাজী ভাইয়েরা! এই যে হজের সফরের জন্য আপনি নির্বাচিত হলেন, তার মানে রুহের জগতেও আপনি লাব্বাইকের গান গেয়েছেন। তাই আপনি আর ১০ জন সাধারণ মানুষের মতো নন। আপনি আল্লাহর নির্বাচিত একজন অনন্য মানুষ। আমরা কামনা করি, আপনি সুস্থ-সুন্দরভাবে হজ করে এসে আমাদের সমাজে হজের সুবাস ছড়িয়ে দেবেন। আর ১০ জন হাজীর মতো আপনি নিজেকে পাপের স্রোতে ভাসিয়ে দেবেন না— এ শপথ এখনই করে যান।
লেখক : বিশিষ্ট মুফাসিসরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব। চেয়ারম্যান : বাংলাদেশ মুফাসিসর সোসাইটি।
www.selimazadi.com