সোমবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

মানবতার মুক্তির দিশারি রসুল (সা.)

মুফতি আমজাদ হোসাইন হেলালী

মানবতার মুক্তির দিশারি রসুল (সা.)

জাহেলি যুগ। তখন সমাজব্যবস্থা ছিল বড় নাজুক। চারদিক বিভীষিকাময় অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। মুমূর্ষু মানবতা অর্থাৎ মানবতা-ইনসানিয়াত বলতে কিছুই ছিল না। মানুষের পাপে যেমন বিধ্বস্ত ছিল পৃথিবী তেমন বিপর্যস্ত ছিল সমাজ। মানবতার জন্য চারদিকে ছিল শুধু হাহাকার আর হাহাকার। জুলুম, নির্যাতন, নিষ্পেষণ, লাঞ্ছনা, আর গঞ্জনায় ক্ষতবিক্ষত ছিল সৃষ্টির সেরা আদমসন্তান। অন্নহীন, বস্ত্রহীন, নির্যাতিত মজলুম জনতার সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে। জুলুমের চিত্র এত ভয়াবহ ছিল যা স্মরণে মানবাত্মা কেঁপে ওঠে। সব মজলুমের হৃদয় থেকে আওয়াজ ওঠে- শান্তি চাই, মুক্তি চাই, চাই এমন একজন আদর্শবান ব্যক্তি, যার অসিলায় সব নির্যাতন, জুলুম ও শোষণ থেকে মুক্তি মিলবে। বিধ্বস্ত জনপদও মুক্তি পাবে। মজলুমের দোয়া সব সময় মহান রব্বুল আলামিন কবুল করেন। এ সম্পর্কে অনেক হাদিসও বর্ণিত হয়েছে। রব্বুল আলামিন দয়া করে দুনিয়ার বুকে পাঠালেন রহমাতুল্লিল আলামিন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মজলুম মানবতার মুক্তির দূত হিসেবে। তাঁর আগমন ধ্বনিতে সমগ্র দুনিয়া আনন্দে ও খুশিতে হাসতে থাকে। শিহরিত বাতাস, জোনাকিতে আলোর বন্যা, জেগে ওঠে প্রভাতরবি। তখন কিন্তু হজরত ঈসা আলাইহিসসাল্লাম, হজরত মূসা            আল্লাইহিসসাল্লাম ও অন্য নবী-রসুলদের তাওহিদের শাশ্বত আদর্শ প্রায় নিভুনিভু। তাদের উম্মতদের মাঝে কেউ বা স্রষ্টাকে অস্বীকার করে কাফির হয়ে গেছে, কেউ বা ধর্মের নামে পাথরপূজা, কিংবা মাটির আরাধনায় লিপ্ত। একদিকে স্রষ্টাকে অস্বীকার করার মতো অহমিকা, অন্যদিকে সৃষ্টিকেই স্রষ্টা বা প্রভু মনে করার মতো হীন মানসিকতা। এভাবেই সেদিন সমাজে বিরাজ করছিল সামাজিক নৈরাজ্য। আধ্যাত্মিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক প্রতিটি ক্ষেত্রে শোষণ-বঞ্চনা, অবিচার-অনাচার ও ব্যভিচার হয়ে উঠেছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এরই ফলে মানবসমাজে সুখ-শান্তি ও প্রগতির আশা-আকাক্সক্ষা হয়ে গিয়েছিল সুদূরপরাহত কিন্তু মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর মুক্তির বাণীতে মানুষকে আন্দোলিত করে প্রতিষ্ঠিত করলেন মহামর্যাদায়। মানুষকে দিলেন তার আসল পরিচয়, কর্মপথ ও পাথেয়। যে মানুষ স্রষ্টাকে ভুলে গিয়ে সৃষ্টিকে স্রষ্টার মর্যাদা দিয়ে অসার অরাধনায় লিপ্ত ছিল তাদের আধ্যাত্মিক অবক্ষয়ের তিমিরাচ্ছন্নতা থেকে মুক্তি দিলেন এই বলে যে, সব সৃষ্টির স্রষ্টা একমাত্র আল্লাহ। তিনি ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই। আল্লাহ ছাড়া আর কারও ইবাদত নয়। ইবাদত তো একমাত্র আল্লাহর জন্যই। সাহায্য একমাত্র আল্লাহর কাছেই চাইতে হবে। রহমাতুল্লিল আলামিন মানুষকে বোঝালেন, মানুষ যেমন কারও ¯্রষ্টা হতে পারে না, তেমনি মানুষ আল্লাহ ছাড়া কারও ইবাদতও করতে পারে না। সব কামিয়াবি আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মানার মধ্যেই নিহিত রয়েছে। তাই তো মানুষ অসংখ্য বানোয়াট মূর্তির উপাসনা বর্জন করে লাভ করল তার সত্যিকার পরিচয়। এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, রসুল, কোরআন, ফেরেশতা ও ইসলামের মূল আকিদা-বিশ্বাস মানুষকে নিমিষেই মুক্তি দিল সব হীনমন্যতা থেকে। মানুষ মর্যাদা লাভ করল সৃষ্টির সেরা বা ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ রূপে। আল্লাহর একাত্মবাদের ওপর বিশ্বাস করার কারণে মানুষের মাঝে আত্মপরিচয় ফিরে এসেছে। জেগে উঠেছে শোষিত-বঞ্চিত মজলুম জনতা। চারদিকে দীপ্ত তেজে জ্বলে উঠল সত্যের উজ্জ্বল মশাল। সত্যের এই আলোকরশ্মি অন্ধকারতর ধূসর মরু আরবের সব অন্ধকার দূর করতে ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্র। অত্যাচারীর রাজপ্রাসাদ ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। বিলুপ্তি ঘটতে লাগল সব তাগুতি শক্তির। সত্যের এ প্রদীপশিখা ছড়িয়ে পড়ল বিশ্বব্যাপী। তাই অতিদ্রুত গোটা পৃথিবীবাসীর প্রতি বর্ষিত হলো রহমতের বারিধারা। দলে দলে লোক ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে এসে নিল স্বস্তির নিঃশ্বাস। নববী আদর্শে মরু আরবের অধঃপতিত জাতি হয়ে উঠল পরবর্তিতে সর্বকালের সব মানুষের আদর্শ শিক্ষক। তাঁরই আদর্শ অনুসরণের ফলে পৃথিবীর মানচিত্রে সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিল মুসলিম জাতি। শুরু হলো জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মানুষের অগ্রযাত্রা। তিনি আমির-ফকির ও ধনী-নির্ধনের ভেদাভেদ শতধাবিভক্তির অবসান ঘটিয়ে ঘোষণা করলেন আল কোরআনের আয়াত। রব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের মাঝে আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাপেক্ষা সম্মানিত যে অধিক আল্লাহওয়ালা।’ সূরা হুজুরাত, আয়াত ১৩। রসুলের এ ঘোষণায় রক্ত, বর্ণ ও বংশগত আভিজাত্যের সব গরিমা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল। আরব-অনারব, সাদা-কালোর পার্থক্য টুটিয়ে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা দিলেন, মানুষ এক আদম থেকে সৃষ্টি। আর আদমের সৃষ্টি মাটি থেকে সুতরাং এখানে উঁচু-নিচুর প্রশ্ন নিতান্তই  অবান্তর। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শ্রমের যথাযথ মর্যাদা দিলেন। শ্রমিককে ন্যায্য পাওনার অধিকারী করলেন। ‘ঘাম শুকানোর আগে শ্রমিকের ন্যায্য পাওনা বুঝিয়ে দাও।’ রসুলের আদর্শে মুক্তি পেল নারীসমাজ। তিনি জানালেন, তারা মায়ের জাতি, তাদের মর্যাদা সুুউচ্চে। এভাবে নির্যাতিত-নিষ্পেষিত মানবতাকে তিনি আল্লাহর রহমতে সব জুলুম ও অত্যাচার থেকে মুক্তি দিলেন। প্রিয় পাঠক! রহমাতুল্লিল আলামিন সর্বক্ষণ এক ধ্যান ও ফিকিরে ছিলেন কীভাবে মানুষের উপকারে কাজ করা যায়। মানুষের ইমানি চেতনা বাড়ানো যায়। চলুন, আমাদের বাকি হায়তাকে গনিমত মনে করে নববী আদর্শে এক আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়ার জন্য বেশি বেশি মানবতার খেদমত করি।             আল্লাহর কাছে বেশি বেশি দোয়া করি তিনি যেন আমাদের সবাইকে সেই তাওফিক দান করেন।

            লেখক : মুহাদ্দিস, মুফাসসির, খতিব, টিভি উপস্থাপক।

সর্বশেষ খবর