বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

কলম্বাসের আমেরিকায়

আতাউর রহমান

কলম্বাসের আমেরিকায়

‘আঙ্কেল স্যাম’ তথা স্যাম চাচা বলতে সাধারণত আমেরিকানদেরই বুঝায়, যেমন করে ‘জন বুল’ বলতে ব্রিটিশদের বুঝায়। আমেরিকানদের আবার কখনো কখনো ইয়াংকি বলেও অভিহিত করা হয়, যদিও ঐতিহাসিকভাবে কেবল নিউ ইংল্যান্ড তথা আমেরিকার উত্তরাঞ্চলের মূল অধিবাসীরাই প্রকৃতপক্ষে অভিধাটির হকদার। একদা কোনো এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে জনৈক আমেরিকান প্রতিনিধি নাকি বলেছিলেন, ভাগ্যিস কলম্বাস (১৪৯২ সালে) আমেরিকা আবিষ্কার করেছিলেন আর এটা শুনে এশিয়ার কোনো একটি  দেশের প্রতিনিধি ফোড়ন কেটেছিলেন, না করলেই বোধহয় অধিকতর ভালো হতো। বাস্তবিকই আমেরিকা হচ্ছে একটি ছোট কামরার অভ্যন্তরে এমনই এক বন্ধুবৎসল সারমেয়, যেটা যখনই লেজ নাড়ায় একটি চেয়ার উল্টায়। এটা আমার কথা নয়, বিখ্যাত ইংরেজ ঐতিহাসিক আর্নল্ড টয়েনবির কথা। আর আমেরিকাকে এক সময় বলা হতো ‘দ্য নিউ ওয়ার্ল্ড’ (নতুন জগৎ) বর্তমানে বলা হয় ‘ল্যান্ড অব অপরচুনিটিজ’ তথা সুযোগ-সুবিধার দেশ। দেশটিকে আরও বলা যায় একটি ‘মেলটিং পট’ (দ্রব্য গলানোর পাত্র) কিংবা অ্যা অ্যান্ড অব ইমিগ্রেন্টস তথা অভিবাসীদের দেশ। দেশটির আদি অধিবাসী রেড ইন্ডিয়ানদের কোণঠাসা করে অভিযাত্রী/অভিবাসীরাই বর্তমানে সেদেশের মালিক। আমেরিকায় তাই আজকাল সবাই সম্ভাব্য ‘হাইফেনযুক্ত’ আমেরিকান- যেমন হিসপানিক-আমেরিকান, ইতালিয়ান-আমেরিকান, আইরিশ-আমেরিকান, এশিয়ান-আমেরিকান, আফ্রিকান-আমেরিকান, জাপানিজ-আমেরিকান ইত্যাদি  ইত্যাদি।

এবং আমাদের প্রায় ১৮ কোটি লোকসংখ্যার বিপরীতে আমেরিকা, যেটা বলতে আমরা আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্রকেই বুঝাচ্ছি, সেটার অধিবাসী সংখ্যা প্রায় ২৮ কোটি। অথচ দেশটির আয়তন আমাদের দেশের প্রায় ৬০ গুণ। তা আয়তন ও প্রাকৃতিক সম্পদের তুলনায় অধিবাসীর সংখ্যা এত কম বলেই বোধকরি দেশটি এতটা উন্নত। তাছাড়া আমেরিকা প্রতিভাবান ও আবিষ্কারকের দেশ- আমেরিকানরা কেবল মোটরযান, অ্যারোপ্লেন, টেলিভিশন ও কম্পিউটার ইত্যাদি আবিষ্কার ও চাঁদে নভোচারী পাঠিয়ে বসে থাকেননি, মহাশূন্যে মনুষ্যবসতিরও উদ্যোগ নিয়েছেন। এটাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আমেরিকাই পৃথিবীকে উপহার দিয়েছে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের মতো বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী রাজনীতিবিদ, আইনস্টাইনের মতো অভিবাসী বিশ্বখ্যাত বৈজ্ঞানিক, জর্জ ওয়াশিংটনের মতো বিজ্ঞ ও বিশ্ববরেণ্য নেতা, আব্রাহাম লিংকনের মতো দাস প্রথার উচ্ছেদকারী মানবতাবাদী মহাপুরুষ, মার্ক টোয়েনের মতো অনন্য প্রতিভার রস-স্রষ্টা, রবার্ট ফ্রস্টের মতো উঁচুমানের কবি ও সদ্য প্রয়াত পিটার সিগালের মতো মানবতাবাদী গায়ক।

তবে পৃথিবী নামক গ্রহের যে পিঠে আমরা বাস করছি তার ঠিক উল্টো পিঠেই আমেরিকার অবস্থান হওয়ায় বোধকরি আমেরিকানদের অনেক কায়-কারবার, অনেক রীতিনীতি আমাদের ঠিক বিপরীত। আমরা সাধারণত সন্তানের নাম রাখি পিতার পদবির সঙ্গে মিলিয়ে। ওরা রাখেন মায়ের পদবির সঙ্গে মিলিয়ে; আমরা ইলেকট্রিক সুইচ নিচের দিকে টিপে বিদ্যুতিক জ্বালাই, ওরা উপরের দিকে টিপে বাতি জ্বালান; আমরা গাড়ি চালাই ব্রিটিশদের অনুকরণে রাস্তার বাম পাশ ঘেঁষে, ওরা চালান ডান পাশ ঘেঁষে, আমরা বলি  পেট্রল ও পেট্রলপাম্প, ওরা বলেন যথাক্রমে গ্যাস ও গ্যাস-স্টেশন ইত্যাদি ইত্যাদি। আমেরিকায় বিমান আর বিমানবন্দরের সংখ্যাও অগণিত। আর মোটরগাড়ির কথা বলতে গেলে বলতে হয়, পরিসংখ্যান অনুসারে নাকি গড়ে আমেরিকার প্রতিটি পরিবারে মোটরগাড়ির সংখ্যা দুটো। ওদের চিন্তা-চেতনায় মোটরগাড়ির স্থান কতটুকু, সেটা বিলক্ষণ বুঝতে পারা যাবে নিম্নোক্ত হাসির গল্পটি থেকে।

দুই আমেরিকান ট্যুরিস্ট মিসরের রাজধানী কায়রোতে পিরামিড দেখতে গেছেন। কায়রোর বিখ্যাত মিউজিয়ামে ফারাওদের মমি দেখতে গিয়ে একজন দেখলেন, একটি মমির গায়ে প্ল্যাকার্ডে লেখা আছে ‘ইপ-২০০৫’ যেটা ছিল মমিটার প্রস্তুতির কাল। কিন্তু আমেরিকান ভদ্রলোক সেটা বুঝতে না পেরে সঙ্গীকে জিজ্ঞেস করতেই সঙ্গী বলে উঠলেন, কী জানি! এটা বোধহয় ওই ফারাও যে মোটরগাড়িটা ব্যবহার করতেন, সেটারই রেজিস্ট্রেশন নাম্বার হবে। হা-হা-হা। সে যা হোক। সুধী পাঠক, সরকারি চাকরির সুবাদে অনেকেই প্রশিক্ষণ, অধিবেশনে যোগদান ইত্যাদি উপলক্ষে সরকারি খরচে আমেরিকায় গিয়ে থাকবেন; কিন্তু আমার বেলায় সেটা ঘটেনি। প্রসঙ্গত, আমাদের দেশের এক যুবাবয়সী ছেলে চোরাইপথে মেক্সিকো হয়ে আমেরিকায় প্রবেশকালে ধরা পড়ে গেলে পর স্থানীয় আদালতের বিজ্ঞ বিচারক যখন তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, সে কোনো মনোভাব নিয়ে আমেরিকায় এসেছে, তখন ছেলেটি নাকি ঝটপট জবাব দিয়েছিল, ক্রিস্টোফার কলম্বাস যে মনোভাব নিয়ে আমেরিকায় এসেছিলেন, আমি সেই মনোভাব নিয়ে এসেছি। বিচারক তার ওই স্মার্ট উত্তরে হেসে ফেলে তাকে গ্রিন কার্ডের বৈধতা দিয়ে দেন। আমার বেলায় আমি টেলিভিশনের বিখ্যাত বিজ্ঞান-সিরিয়াল ঝচঅঈঊ১৯৯৯-এর সঙ্গে মিল রেখে ১৯৯৯ সালে ফ্রান্সে তিন সপ্তাহের প্রশিক্ষণ শেষে প্রশিক্ষণকালীন জমানো পয়সা দিয়ে টিকিট কেটে প্লেনে আটলান্টিক অতিক্রমপূর্বক যখন আমেরিকায় পা রাখলাম, তখন বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা আমার আগমনের উদ্দেশ্য টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত আত্মজ ও নিউইয়র্কে বসবাসরত নিকটাত্মীয়দের সঙ্গে কয়েক দিন কাটানো জানতে পেরে সহাস্যে আমার দেশে আপনাকে স্বাগতম কথাটা বলে প্রবেশাধিকার দিয়ে দিলেন।

টেক্সাস আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্রের সর্ববৃহৎ রাজ্য। রাজ্যের আলাদা পতাকা আছে এবং সেটাতে একটি মাত্র নক্ষত্র খচিত বিধায় সেটাকে সিঙ্গেল স্টার স্টেটও বলা হয়ে থাকে। টেক্সাসে জায়গার অভাব নেই বিধায় সবকিছুই বৃহদাকারে তৈরি-  সুপার মার্কেট সংলগ্ন পার্কিং, বিমানবন্দরের বিল্ডিং, বিফ-বার্গার, ড্রিংকসের বোতল, গ্লাস ইত্যাদির সাইজ এতটাই বৃহৎ যে, এ সম্পর্কে একটি মজার গল্পও আছে: টেক্সাসে একবার আমাদের প্রাচ্যদেশীয় একজন পর্যটক একদিন হোটেলে একটি বৃহদায়তন বিফ-বার্গার দ্বারা উদরপূর্তির পর তার টয়লেটে যাওয়ার প্রয়োজন দেখা দিল। হোটেলের বেয়ারাকে জিজ্ঞেস করে তিনি পথনির্দেশিত হয়ে টয়লেটের উদ্দেশে পা বাড়ালেন। কিন্তু লোকটির দৃষ্টিশক্তি খুব ক্ষীণ ছিল। তাই তিনি ভুল করে ভুল দরজা দিয়ে বের হয়ে পড়বি তো পড়-  একেবারে হোটেলের সুইমিং পুলে। আর সুইমিং পুলে পড়েই তিনি চিৎকার শুরু করে দিলেন, ডোন্ট ফ্লাশ। ডোন্ট ফ্লাশ। অর্থাৎ সুইমিং পুলটাকে তিনি টয়লেটের কমোড ভেবে বসেছিলেন এই আর কী!

তা আমেরিকায় সে যাত্রায় আমি দুই সপ্তাহ ছিলামÑ এক সপ্তাহ নিউইয়র্কে ও এক সপ্তাহ টেক্সাসের রাজধানী অস্টিনে। নিউইয়র্কে অবস্থানের ব্যাপারে বারান্তরে আলোকপাত করা যাবে খন। আপাতত অস্টিন প্রসঙ্গে আমার বিবেচনায় দুটো উল্লেখযোগ্য ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বিদায় নিতে চাই।

এক. অস্টিনে পৌঁছার পরদিন ভোরে আমি মসজিদে নামাজ পড়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করায় আত্মজ জাফর গাড়িতে করে মাইল তিনেক দূরের বড় মসজিদে নিয়ে গেল। আমেরিকার কিছু মসজিদে মিসরের সরকার নাকি বিখ্যাত আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের কতক শাইখকে ইমামতি করতে পাঠান। উক্ত মসজিদের ইমাম ছিলেন ওদেরই একজন। তো ফজরের জামাত শেষে কিছু আরবীয়, কিছু পাকিস্তানি ও আমরা বাপ-বেটাসহ জনাদশেক লোক গোল হয়ে বসলাম এবং শাইখ একজনের হাতে একটি কোরআন শরিফ তুলে দিয়ে সবাইকে পালাক্রমে ২/৩ আয়াত করে পড়ে যেতে অনুরোধ জানালেন। আমার পালা আসতেই আমি তো পড়লামই, আলহামদুলিল্লাহ পাশে উপবিষ্ট আত্মজও পড়ল। ওর কোরআন পাঠ শুনে শাইখ খুব প্রশংসা করলেন এবং আমাকে জিজ্ঞাস করলেন, আমি নিজে তাকে শিখিয়েছি কিনা। তদুত্তরে আমি বললাম না, প্রফেশনাল লোক দিয়ে শিখিয়েছি। আর মনে মনে ভাবলাম, তাকে যদি আমি না শিখাতাম তাহলে তখন সে মুখ কালো করে সরি বলত আর আমার মনে হতো ধরণী দ্বিধা হও ও আমি প্রবেশ করি। উপস্থিত অন্যদের কাছেও আমার দেশের ভাবমূর্তি খানিকটা হলেও ক্ষুণœ হতো। আমি তাই এই লেখাটির মাধ্যমে আমার দেশের মুসলিম ভাইবোনদের এই বার্তাটি পৌঁছে দেওয়ার প্রয়াস পাচ্ছি যে, ছেলেমেয়েদের বিদেশ পাঠানোর আগে কোরআন পাঠ ও নামাজ অবশ্যই শিক্ষা দেবেন। কারণ কখন কোনটার প্রয়োজন পড়বে, জানেন না। এমনিতেও মুসলমানের বাচ্চা হিসেবে কোরআন শরিফ জানা অবশ্য কর্তব্য বটে।

দুই. অস্টিন থেকে প্লেনে যেদিন বিকালে আমি নিউইয়র্ক ফিরি সেদিন রোজা রেখেছিলাম, যেহেতু পূর্বরাত্রি ছিল শবেবরাত। পথিমধ্যে প্লেনেই আমাকে ইফতার করতে হলো। সেদিন সূর্যাস্ত কয়টা কয় মিনিটে সেটা আমার জানা ছিল, কিন্তু যেহেতু আমি প্রায় ৩০ হাজার ফুট উচ্চতায় ছিলাম, তাই একটু দেরিতে ইফতার করলাম। ইদানীং পত্রিকায় পড়লাম, মুসলিম জাহানের আলেমরা ফতোয়া দিয়েছেন, দুনিয়ার উচ্চতম বিল্ডিং দুবাইর বুরজে খলিফার সর্বোচ্চ কক্ষে যারা বাস করবেন তারা যেন নির্ধারিত সময়ের ৫ মিনিট পর সিয়ামের ইফতার করেন। অতএব, দেখা যাচ্ছে, আমি যথার্থ কাজই করেছিলাম। ৪টি জিনিসে ইসলামী শরিয়ত সম্পূর্ণ- কোরআন, সুন্নাহ (হাদিস), ইজমা (অধিক সংখ্যক আলেমের মতামত) ও কিয়াস (বুদ্ধি-বিবেচনা)। আমি তাই কিয়াস প্রয়োগ করে ভুল করিনি এবং এটাও একটা শিক্ষণীয় ও অনুসরণীয় বিষয় বটে।

লেখক : রম্য সাহিত্যিক। বাংলাদেশ ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর