বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা
ইতিহাস

বক্সারের যুদ্ধ

নবাব মীর কাসিম ও তাঁর মিত্রশক্তির সঙ্গে ইংরেজদের যুদ্ধ হয় বক্সারের প্রান্তরে ১৭৬৪ সালে। পলাশীর যুদ্ধের (১৭৫৭) পর ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লোকেরা মনে করত বাংলার ঐশ্বর্য অফুরন্ত। ফলে তাদের লোভ-লালসার মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। সে কারণেই কোম্পানির পরিচালকরা আদেশ দেন, বাংলার আয় থেকে বোম্বাই ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির ব্যয় নির্বাহ এবং এর রাজস্ব দ্বারা ভারত  থেকে কোম্পানির রপ্তানি পণ্য কিনতে হবে। বাংলার সম্পদ পাচারের উদ্দেশ্যে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার নবাবের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় দৃঢ়সংকল্প ছিল। বাংলার নতুন নবাব মীর জাফর বুঝতে পারেন, তাঁর পক্ষে ইংরেজ কোম্পানি ও এর কর্মচারীদের দাবি সম্পূর্ণরূপে পূরণ করা সম্ভব নয়। এদিকে কোম্পানির কর্মকর্তারা তাঁদের দাবি পূরণে নবাবের ব্যর্থতার সমালোচনা করতে থাকেন। কাজেই কোম্পানি নবাবকে তাঁর জামাতা মীর কাসিমের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য করে। মীর কাসিম কোম্পানির কর্মকর্তাদের প্রচুর অর্থ প্রদান করেন। কিন্তু তিনি ইংরেজদের প্রত্যাশা পূরণের বিষয়টি কৌশলে পরিহার করেন এবং অচিরেই বাংলায় ইংরেজদের অবস্থান ও উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার পথে হুমকি হয়ে দাঁড়ান। তাঁর বিশ্বাস ছিল, যেহেতু তাঁকে বাংলার মসনদে বসানোর জন্য তিনি কোম্পানি ও এর কর্মকর্তাদের যথেষ্ট উপঢৌকন দিয়েছেন, কাজেই তাঁরা তাঁকে স্বাধীনভাবে বাংলার শাসনকার্য চালানোর সুযোগ দেবেন। ইংরেজ কোম্পানির কর্মকর্তা কর্তৃক ১৭১৭ সালে বাদশাহি ফরমানের অপব্যবহার রোধে নবাবের প্রয়াসকে ইংরেজরা মোটেও পছন্দ করেনি। এই ইংরেজ কর্মকর্তারা বিদেশে রপ্তানিযোগ্য কিংবা অভ্যন্তরীণ ব্যবহারের জন্য তাঁদের মালামাল শুল্কমুক্ত করার দাবি জানান। ইংরেজ বণিকরা শুল্কমুক্ত ব্যবসার অনুমতিপত্র বা ‘দস্তক’ বন্ধুপ্রতিম ভারতীয় ব্যবসায়ীদের কাছে অবৈধভাবে বিক্রি করার ফলে ওইসব ব্যবসায়ী অভ্যন্তরীণ শুল্ক ফাঁকি দিতেন। এতে সৎ ভারতীয় ব্যবসায়ীরা অসম প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতেন। ফলে নবাবের সঙ্গে ইংরেজদের সংঘাত দানা বেঁধে ওঠে। নবাব কোম্পানির কর্মচারী কর্তৃক দস্তকের অপব্যবহার রোধে সক্রিয় হন। তিনি ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তা ও জমিদারদের কোম্পানির কর্মচারীদের উপহার ও ঘুষ প্রদানের চাপ থেকে রেহাই দেওয়ার চেষ্টা করেন এবং কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ থেকে নিজেকে মুক্ত করে বাংলাকে শক্তিশালী করে তুলতে সচেষ্ট হন।  ইংরেজদের এসব পছন্দনীয় ছিল না। বিদেশি ব্যবসায়ীরা স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সমপর্যায়ভুক্ত হতে কিছুতেই রাজি ছিল না। বাস্তব সত্য ছিল এই যে, বাংলায় দুই প্রভুর শাসন সম্ভব ছিল না। মীর কাসিম মনে করতেন, তিনি একজন স্বাধীন শাসক আর ইংরেজরা চাইত তিনি যেন তাদের হাতের ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করেন, যেহেতু তারাই তাঁকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। ফলে উভয় পক্ষে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে পড়ে।

সংঘর্ষের সূত্রপাত হয় পাটনায়। সেখানে এক ইংরেজ কর্মকর্তা ও নবাব পরস্পরকে উত্তেজিত করে নিজেদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটান। ১৭৬৩ সালের গ্রীষ্মে যুদ্ধ শুরু হয়। পরপর চারটি খ-যুদ্ধে নবাবের নতুন বাহিনী পরাজিত হয়। মীর কাসিম প্রথমে পাটনা ও পরে অযোধ্যায় পালিয়ে যান। অযোধ্যায় তিনি নবাব সুজাউদ্দৌলার সমর্থন লাভ করেন। এদের সঙ্গে মিলিত হন পলাতক মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম। ১৭৬৪ সালের শরৎকালে পুনরায় যুদ্ধ হয়। ২২ অক্টোবর বিহারের বক্সার নামক স্থানে সংঘটিত এ যুদ্ধে ইংরেজরা জয়লাভ করে। বাদশাহ দ্বিতীয় শাহ আলম পুনরায় ইংরেজ শিবিরে আশ্রয় নেন। সুজাউদ্দৌলা রোহিলাখন্ডে পালিয়ে যান এবং অযোধ্যা ইংরেজ বাহিনীর পদানত হয়। মীর কাসিম নিরুদ্দেশ হন এবং এরপর তাঁর সম্পর্কে আর কিছু জানা যায়নি।

বক্সার ছিল একটি চূড়ান্ত যুদ্ধ। এ যুদ্ধের পর বাংলা ইংরেজ কোম্পানির শাসনের অধীনে আবদ্ধ হয়। এত দিন পর্যন্ত ইংরেজরা ছিল ক্ষমতার ভাগাভাগি ও সুযোগ-সুবিধা আদায়ের জন্য শাসকের প্রতিদ্বন্দ্বী এবং তাদের ক্ষমতা লাভ ছিল নিতান্তই আকস্মিক ও অনিশ্চিত। বক্সারের যুদ্ধের পর ইংরেজদের ক্ষমতা হয়ে ওঠে অপ্রতিরোধ্য এবং তারা রাজকীয় স্বীকৃতি লাভের কাছাকাছি এসে পৌঁছে। এ যুদ্ধের পর অযোধ্যার ভাগ্যও কোম্পানির অনুকম্পার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে এবং বাংলায় ব্রিটিশদের চূড়ান্ত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়। বাংলার নবাব তাঁর অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নিরাপত্তার জন্য ইংরেজদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর