শুক্রবার, ১৬ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

অহংকার সম্পর্কে ইমাম গাজ্জালির বিশ্লেষণ

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

অহংকার সম্পর্কে ইমাম গাজ্জালির বিশ্লেষণ

শরীরের মতো মানুষের আত্মারও অসুখ হয়। শরীরের অসুখের চেয়ে আত্মার অসুখ বেশি ভয়ঙ্কর। শরীরে অসুখ হলে মানুষ নিজে ভোগে, তার যারা সেবা করে তাদের ভোগায়। কিন্তু যখন আত্মার অসুখ হয় ওই মানুষটির সংস্পর্শে যে আসবে সেও ভুগবে এবং তার দুনিয়া-আখিরাত ইমান-আমল সবকিছু নষ্ট হয়ে যাবে। আত্মার একটি জঘন্যতম রোগ হলো অহংকার। অহংকার কত বেশি জঘন্য হতে পারে তা প্রমাণ করার জন্য রসুল (সা.)-এর এ হাদিসটি যথেষ্ট। তিনি বলেছেন, ‘যার অন্তরে একটি শর্ষের দানা পরিমাণ অহংকার থাকবে সে জান্নাতে প্রবেশ তো করবেই না, জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না; অথচ ৫০০ বছরের রাস্তার দূরত্ব থেকেই জান্নাতের সুঘ্রাণ পাওয়া যাবে।’ তিরমিজি। অহংকারের ভয়াবহতা বোঝানোর জন্য আরেকটি প্রসিদ্ধ হাদিস উল্লেখ করা যেতে পারে। হাদিসে কুদসিতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘অহংকার হলো আমার চাদর। যে এ চাদর নিয়ে টানাটানি করবে, আমি তাকে দুনিয়া ও আখিরাতে লাঞ্ছিত-অপমানিত করব এবং কঠিন শাস্তি ভোগ করাব।’ আত-তারগিব ওয়াত-তাহরিব।

অহংকার কী বা কাকে বলে- এ প্রশ্নের জবাবে স্বয়ং রসুলে করিম (সা.) বলেন, ‘অহংকার হলো সত্যকে গোপন করা এবং মানুষকে নিকৃষ্ট মনে করা।’ তিরমিজি। হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালি (রহ.) অহংকারের বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, অহংকারী ব্যক্তি দুনিয়ায় তিন ধরনের শাস্তি পায়। প্রথমত, একজন অহংকারী ব্যক্তি মানসিক অপূর্ণতা-অতৃপ্তি এবং অশান্তিতে ভোগে। অহংকারী ব্যক্তি চায় সবাই তাকে সম্মান করবে, মান্য করবে; বিপরীতে মানুষ তাকে অমান্য করে, অসম্মান করে এবং ঘৃণা করে। দ্বিতীয়ত, হেদায়াত থেকে অহংকারী ব্যক্তি দূরে থাকে। সুরা আরাফের ১৪৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা অন্যায়ভাবে জমিনে অহংকার করে বেড়ায়, আমার আয়াতসমূহ থেকে তাদের আমি অবশ্যই ফিরিয়ে রাখব।’ অহংকারী ব্যক্তির তৃতীয় আজাব বা শাস্তি হলো, আল্লাহর সব ধরনের নিয়ামত থেকে তাকে বঞ্চিত করা হয়।

ইমাম গাজ্জালি লিখেন, ‘পরকালের অনন্ত জীবনেও অহংকারীকে আল্লাহ কঠিন শাস্তি দেবেন। রসুল (সা.) বলেছেন, কিয়ামতের দিন তিন ধরনের অপরাধীকে কোনো বিচার-বিশ্লেষণ-ফয়সালা না করেই সরাসরি জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। সর্বপ্রথম অহংকারীকে আল্লাহ ডাক দিয়ে তাকে সরাসরি জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। অহংকারী আল্লাহর চাদর নিয়ে টানাটানি করে। আল্লাহর সঙ্গে ধৃষ্টতা দেখানোর অপরাধের শাস্তি সরাসরি জাহান্নাম। একজন অহংকারী ব্যক্তির জাহান্নামের উপযুক্ত হওয়ার জন্য এ কারণটিই যথেষ্ট। দ্বিতীয়ত, আল্লাহ ওই ব্যক্তিকে সরাসরি জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর কোনো হুকুমন্ডআহকাম নিয়ে সন্দেহ পোষণ করত। যে ব্যক্তি আল্লাহর সীমাহীন রহমত থেকে নিরাশ হয়েছিল কিয়ামতের দিন তাকে আল্লাহ ডাকবেন এবং সরাসরি জাহান্নামে ফেলে দেবেন।’ আল-আদাবুল মুফরাদ। এ ছাড়া বিভিন্ন হাদিস থেকে জানা যায়, অহংকারী ব্যক্তি কিয়ামতের দিন রসুল (সা.)-এর কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত হবে এবং অন্য সবার চেয়ে তাঁর থেকে বহু দূরে অবস্থান করবে। আরেকটি হাদিসে বলা হয়েছে, ‘কিয়ামতের দিন অহংকারীর ওপর আল্লাহ প্রচ- রেগে থাকবেন।’

অহংকার থেকে বাঁচার উপায় সম্পর্কে ইমাম গাজ্জালি আমাদের কয়েকটি পরামর্শ্ব দিয়েছেন। তিনি বলেন, মানুষ তখনই অহংকার করে যখন সে নিজের অবস্থা-যোগ্যতা-সম্পদ এসব বিষয়কে বড় করে দেখে। এ ক্ষেত্রে মানুষ যদি আল্লাহর বিশালত্ব সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে তাহলে সে বুঝতে পারবে মহাবিশ্বের তুলনায় সে একটি ক্ষুদ্র বিন্দুও নয়। তখন এমনিতেই তার মন থেকে অহংকারের ভাব চলে যাবে। অহংকারী যেসব সম্পদন্ডসৌন্দর্য নিয়ে অহংকার করে তার ভেবে দেখা উচিত এসব বস্তু-সম্পদন্ডসৌন্দর্য কি তার নিজের সৃষ্টি নাকি আল্লাহর সৃষ্টি? এভাবে ভাবলেও মানুষের মনে অহংকার থাকতে পারে না। অহংকার থেকে বাঁচা কিংবা অহংকারমুক্ত জীবন যাপন করার সবচেয়ে কার্যকর পরামর্শ্ব হলো, মহান আল্লাহর কাছে কাকুতি-মিনতি করে দোয়া করা- হে আল্লাহ! আপনি আমার অন্তরের এ কঠিনতম ব্যাধি দূর করে দিন এবং আমার অন্তরকে বিনয় দিয়ে ভরপুর করে দিন। কোনো মানুষ যদি এভাবে অহংকার থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে আশা করা যায়, আল্লাহ তাকে অহংকারমুক্ত বিনয়ের জীবন দান করবেন। হে আল্লাহ! আপনি আমাদের বিনয়ে ভরপুর অহংকারমুক্ত জীবন দান করুন।

লেখক : মুফাস্সিরে কোরআন।

সর্বশেষ খবর