সোমবার, ১৮ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

মাদক নির্মূলের রূপরেখা

খন্দকার ফারজানা রহমান

মাদক নির্মূলের রূপরেখা

বর্তমানে বাংলাদেশের গ্রাম ও শহর উভয় ক্ষেত্রে মাদকের অপব্যবহার সর্বত্র ছড়িয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে সমাজের সর্বত্র এ সমস্যায় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বেসরকারি সংগঠন মানাসের মতে ২০১৯ সালে দেশে মাদকাসক্ত মানুষ ছিল প্রায় ৮০ লাখ। কর্মহীন যুবকের প্রায় ৪০ শতাংশ মাদকসেবী আর মাদকসেবীর মধ্যে ৪০ শতাংশ নারী। মাদক পাচারকারীরা এখন ইয়াবাকে প্রাধান্য দিচ্ছে। ব্যবসায়ীদের কাছে ইয়াবা পছন্দের মাদক হওয়ায় এটি বাংলাদেশে ডি-ফ্যাক্টো ড্রাগ হিসেবে পরিণত হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বিজিবি ৯৮ লাখ ৬৩ হাজার ২৩৯ পিস ইয়াবা জব্দ করে। ধারণা করা হয়, প্রতিদিন ২ মিলিয়ন ইয়াবা বিক্রি হয় এ দেশে।

অন্যদিকে মাদকদ্রব্য নির্মূলে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ সরকার জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করে এবং তা কার্যকরে গিয়ে আমরা দেখেছি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা ও এসব ব্যবসায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে, অনেক মামলাও হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে যে তিনটি নীতি আমরা ব্যবহার করি মাদকদ্রব্য নির্মূলে যথা সরবরাহ হ্রাস, চাহিদা হ্রাস ও ক্ষতি হ্রাস- এসব ক্ষেত্রে এখনো কাজের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।

এ ক্ষেত্রে সরবরাহ হ্রাসে আমি বেশি গুরুত্ব দেব। কারণ ইয়াবা বা মেথামফেটামিন আমাদের দেশে উৎপাদন হয় না, অন্য দেশ থেকে এগুলো আমাদের দেশে ঢুকছে। সুতরাং সীমান্তরক্ষী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিতদের দায়িত্বশীলতার জায়গায় কিছু ঘাটতি থেকে গেছে এবং মাদকদ্রব্যগুলো ঢোকার পরও আমাদের ইনটেলিজেন্স এজেন্সি কী কারণে শনাক্ত করতে পারছে না তাও প্রশ্নবিদ্ধ এখন। আইনত পুলিশ মাদকাসক্তকে গ্রেফতার করতে পারে। তবে সাধারণত মাদকাসক্ত জামিনে থাকাকালে আবারও তার নেশা চালিয়ে যায়। তাই মাদক সরবরাহের পয়েন্টগুলো চিহ্নিত করা বা মাদকাসক্তদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ মাদকদ্রব্যের প্রবাহকে সাময়িকভাবে বাধা দিতে পারে, তবে এর নির্মূলের জন্য দীর্ঘস্থায়ী সমাধান দেয় না। সরকার একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে একজন আসক্ত ব্যক্তির চিকিৎসার জন্য গাইড করার ক্ষেত্রে নিয়োজিত করতে পারে। নতুন আইনে বাংলাদেশে বিচারব্যবস্থায় একজন বিচারককে চিকিৎসা কর্মসূচির প্রস্তাব দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, যা কারাগারের বিকল্প হিসেবে দীর্ঘস্থায়ী মাদকের ব্যবহার নিরাময় করতে পারে। একইভাবে চিকিৎসা প্রকল্পগুলো কারাগারেও দেওয়া যেতে পারে যা পরে আরও অপরাধের হারকে কমাতে সাহায্য করবে।

দ্বিতীয়ত, কার্যকর প্রতিরোধ কৌশল স্থাপনের জন্য একটি মূল পদক্ষেপ হলো সমন্বয়ব্যবস্থা স্থাপন এবং বাস্তবায়ন; যা আগেই বলা হয়েছে। এ জন্য অবৈধ মাদকদ্রব্যের সরবরাহ, চাহিদা এবং ক্ষতি হ্রাসের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তার ওপর ভিত্তি করে কাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সমন্বয় প্রক্রিয়াগুলো এমনভাবে তৈরি করা উচিত যেন সেগুলো সুশৃঙ্খলভাবে আসক্ত ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের মধ্যে দৃঢ় বন্ধন গঠন করতে পারে। অবশেষে জাতীয় কৌশল ও সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের গৃহীত পদক্ষেপ, অর্থায়ন ও তথ্যপ্রবাহ অবশ্যই সুচিন্তিত ও সময়োপযোগী হতে হবে। বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্টের মাধ্যমে মাদকের অবাধ প্রবাহ কোনোভাবেই বন্ধ করা সম্ভব হবে না যদি মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে ও জবাবদিহির আওতায় আসতে না পারে।

তৃতীয়ত, যেহেতু মাদকের অপব্যবহার অপরাধমূলক কাজ, তাহলে এটি সহজেই পরিমেয় যে মাদকাসক্ত একজন সমাজবিচ্যুত মানুষ। তবে যতক্ষণ না মাদক সেবনকারীরা হতাশা বা মানসিক চাপ এবং পরিবার থেকে সহায়তার অভাবে ভোগ না করে, মাদকাসক্তি থেকে পুনরুদ্ধার বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তাই মাদকাসক্ত থেকে নিরাময়ের মতো একটি বৃহত্তর অর্জন যেন পরিবার ও সমাজের নেতিবাচকতার কারণে বিঘিœত না হয় সে লক্ষ্যেই সরকারকে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এ ছাড়া চাকরির বাজার, গৃহহীনতা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থায় অসুবিধাজনিত চ্যালেঞ্জ দূর করে মাদকের মূল হোতা (গডফাদার) ও মাদকসেবীদের সন্ধান এবং তাদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসার মাধ্যমে প্রান্তিককরণ হ্রাস করার কথা ভাবা যেতে পারে।

চতুর্থত, মাদকদ্রব্য নির্মূল কৌশলটিতে বাস্তবায়িত কর্মসূচিগুলো প্রমাণভিত্তিক হওয়া আবশ্যক। অর্থাৎ পূর্ববর্তী ও বর্তমানে গৃহীত যেসব নীতিমালার কার্যকারিতা ও সাফল্যের হার বেশি সেগুলোর ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মাধ্যমে সীমিতসংখ্যক সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম সমন্বিত করা হলেও বাংলাদেশে স্কুল, পরিবার এবং সম্প্রদায়ের বিন্যাসের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের প্রতিরোধ ও সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক ওয়ার্কশপ করা যেতে পারে, বিশেষত মাদক ব্যবহারের সঙ্গে সম্পর্কিত ঝুঁকি সম্পর্কে সম্ভাব্য ব্যবহারকারীদের তথ্য সরবরাহ করা, এমন সব প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা যা মাদক ব্যবহারের সঙ্গে সম্পর্কিত সামাজিক চাপকে প্রতিরোধ করা সম্ভব করে।

মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার প্রতিরোধে বাংলাদেশের গৃহীত পদক্ষেপ, মাদকসেবী পুনর্বাসনের জন্য কর্মসূচিগুলোর প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব সরকারকে সঠিকভাবে আমলে নিতে হবে। প্রতিরোধ ও নিরাময়মূলক উভয় ইস্যুতে নীতিমালার মধ্যে মাদকাসক্তি প্রতিরোধের জন্য প্রশাসন, পরিবার ও সমাজ কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। তা ছাড়া অবৈধ মাদকের মোকাবিলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি দন্ডনীয় ও প্রতিশোধমূলক দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করে আসছে। গডফাদারদের বিরুদ্ধে মামলা ও মাদকদ্রব্যগুলোর সহজলভ্যতা রোধে আইন প্রয়োগকারী ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর জবাবদিহি নিশ্চিত করা সরকারের এজেন্ডার শীর্ষে থাকা উচিত। তবে একই সঙ্গে মাদকের সরবরাহ ও চাহিদা হ্রাস এবং মাদকাসক্তি প্রতিরোধের সক্রিয় উদ্যোগগুলো কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। মাদক নির্মূলে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।

লেখক : চেয়ারপারসন, অপরাধবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর