শুক্রবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

জিয়া সম্পর্কে যা বলেছিলেন জেনারেল শওকত

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

জিয়া সম্পর্কে যা বলেছিলেন জেনারেল শওকত

১৯৮৮ সালের আগস্টের কথা। আমি তখন যুক্তরাজ্য ইমিগ্রেশন অ্যাডভাইজরি সার্ভিসের আইনবিষয়ক উপপরিচালক। ১৯৬৯ সালের ব্রিটিশ ইমিগ্রেশন আপিল অ্যাক্টের বিধানবলে এ সংস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, যার কাজ ছিল ইমিগ্রেশন নিয়ন্ত্রণে ন্যায়বিচার হচ্ছে কি না তা তদারকি করা এবং উপযুক্ত ক্ষেত্রে আদালতে আপিল পরিচালনা করা। তখন সংস্থার প্রধান কর্মকর্তা তথা পরিচালক ছিলেন মাইকেল বার্নস, যিনি ১৯৭১ সালে ব্রিটিশ এমপি হিসেবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে শক্তিশালী ভূমিকা রেখেছিলেন এবং পরবর্তীতে ইউরোপীয় বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি হয়েছিলেন। সংস্থাটি চালানোর দায়িত্ব ছিল ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। সে সময়ই একদিন শ্রদ্ধেয় গাফ্ফার চৌধুরী সাহেব ফোন করে জানালেন তিনি লেফটেন্যান্ট জেনারেল মীর শওকত আলীকে নিয়ে আমার অফিসে আসতে চান। আমার বুঝতে বাকি রইল না কেন গাফ্ফার ভাই আসতে চাইলেন। কিছু দিন ধরেই খবর পাচ্ছিলাম তখনকার রাষ্ট্রপ্রধান জেনারেল এরশাদ সাহেবের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে এরশাদ সাহেব জেনারেল শওকতকে যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রদূত পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে তাকে দেশে তলব করেছেন, কিন্তু জেনারেল শওকত ভয় পাচ্ছিলেন দেশে ফিরলে এরশাদ সাহেব তাকে গ্রেফতার করবেন।

রাষ্ট্রদূতের পদ চলে যাওয়ার পর জেনারেল শওকত গাফ্ফার ভাইয়ের পাশের সড়কেই একটি বাড়ি কিনে সেখানে বসবাস করতেন। যথাসময়ে গাফ্ফার ভাই আমার দফতরে এলেন জেনারেল শওকতসহ। জেনারেল শওকত তার ভীতির কারণ ব্যাখ্যা করে বললেন, তিনি এ মুহূর্তে দেশে ফিরতে চান না। তাই আমার শরণাপন্ন হয়েছেন। আমি তাকে যুক্তরাজ্যে থাকার অনুমতির নিশ্চয়তা দেওয়ার পর গাফ্ফার ভাই এবং জেনারেল শওকতকে নিয়ে মাইকেল বার্নস-এর কক্ষে গেলাম, শওকত সাহেবকে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা বলে পরিচয় করে দেওয়ার পর চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলার সময় জেনারেল শওকত বললেন, জিয়াউর রহমান আসলে মন থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কখনো ছিল না, পরিস্থিতির চাপে সে ভারত গিয়েছিল। শওকত সাহেব বললেন জিয়া আসলে জাহাজ থেকে পাকিস্তানি সামরিক সরঞ্জাম খালাসের জন্য গেলে বাঙালি সৈন্যরা তাকে সতর্ক করে বলেছিল সে পাকিস্তানি জাহাজে গেলে বাঙালি সৈন্যরা তাকে হত্যা করবে। এ ভয়েই তখন জিয়া বাঙালিদের দলে এসে পরে ভারতে চলে যায়। এরপর বাঙালি সৈন্যদের চাপে বেতারে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা পাঠ করে। যদিও এর আগে হান্নান এবং বেলাল বেগ সাহেবগণ সেই ঘোষণা পাঠ করেছিলেন, তবু সবাই মনে করেছিলেন একজন সামরিক কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা পাঠ করলে সেটা বেশি ফলপ্রসূ হবে। শওকত সাহেব আরও বললেন, জিয়া কোনো যুদ্ধই করেনি। আমি শওকত সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম তাহলে মেজর রফিক যা বলছেন, এটা কি ঠিক। শওকত সাহেব বলেছিলেন, এটা ১০০ ভাগ সত্য। শওকত সাহেব আরও বললেন, সেদিন বাঙালি সৈন্যরা জিয়াকে ভয় না দেখালে জিয়া পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করত, হতো রাজাকার, কারণ সে পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ স্বাধীন হোক তা কখনো চায়নি। সে পাকিস্তানে বড় হয়েছে। তার বাবা-মার কবর পাকিস্তানে। সে বাংলার চেয়ে উর্দু ভালো জানে।

পরে গাফ্ফার ভাইয়ের সঙ্গে আলাপকালে বললাম, ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়া-মোশতাক সর্বাগ্রে বেতারমাধ্যমে বাংলাদেশকে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র ঘোষণার ব্যবস্থা করে, ‘জয় বাংলা’ স্লোগান যা ছিল মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান, পাল্টিয়ে পাকিস্তানি শব্দ ‘জিন্দাবাদ’-এর প্রচলন করে। ‘বাংলাদেশ বেতার’, ‘বিমান’ প্রভৃতি বাংলা শব্দ পাল্টিয়ে পরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণের স্মৃতি, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের স্মৃতি মুছে ফেলার জন্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নাম এবং বৈশিষ্ট্য পাল্টে ফেলেছিল, ইন্দিরা গান্ধী, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যাঁর অবদান ছিল অতুলনীয়, তাঁর নামে তৈরি ‘ইন্দিরা মঞ্চ’ গুঁড়িয়ে দিয়েছিল, কুখ্যাত রাজাকার শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ দিয়েছিল, রাজাকার কর্নেল মোস্তাফিজ, আলিম, সোলেমান, যাদু মিয়া প্রমুখকে মন্ত্রীপদে নিয়োগ দিয়েছিল। তার মন্ত্রিসভার ৮০ শতাংশই ছিল রাজাকারের দল। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়াকে ত্রাণকর্তা মেনে মুসলিম লীগ, নিজামে ইসলাম, জামায়াতে ইসলামী, চীনপন্থি সে অংশ যারা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ছিল এবং ধর্মব্যবসায়ীরা সবাই জিয়ার ছত্রচ্ছায়ায় একত্রিত হয়েছিল। এ কাজগুলো প্রমাণ করে জিয়া আসলে মুক্তিযোদ্ধা ছিল না, পাকিস্তানের বিভক্তিও চায়নি, পরিস্থিতির চাপে পড়ে, জীবনের ভয়েই সে সেদিন দিক পাল্টিয়ে ছিল, যে কথা জেনারেল শওকত বললেন, যা মেজর রফিকও লিখেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে সঙ্গে ভুট্টো সাংবাদিকদের বলেছিল, বাংলাদেশের সঙ্গে পুনরায় কনফেডারেশনের মাধ্যমে একত্রিত হওয়ার প্রচেষ্টা চলছে। ভুট্টো তৎক্ষণাৎ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এবং চীনকে খুনিদের স্বীকৃতি দিতে বলেছিল, খুনিদের জন্য পাঠিয়েছিল প্রচুর খাদ্য এবং বস্ত্র। সে সময় শীর্ষ রাজাকার উর্দুভাষী খাজা খয়েরউদ্দিনকে বিশেষ পদে নিয়োগ দেওয়ার কথা হচ্ছিল বাংলাদেশকে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশনভুক্ত করার জন্য, কিন্তু ভুট্টোর সঙ্গে খাজা খয়েরউদ্দিনের সুসম্পর্কের অভাবে তা করা হয়নি। পরবর্তীতে ৯০ দশকের প্রথমার্ধে প্রবাসজীবন ছেড়ে বাংলাদেশে ফিরলে জিয়ার মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এবং পাকিস্তানপ্রেমী আরও অনেক কিছু জানতে পারলাম। জেনেছিলাম কলকাতা অবস্থানকালেই জিয়া-মোশতাক ষড়যন্ত্রের কথা, যার কারণে জেনারেল ওসমানী জিয়াকে কোর্ট মার্শাল করতে চেয়েছিলেন, জেনেছিলাম জিয়া আসলে কোনো যুদ্ধেই যায়নি এবং আরও জানতে পেরেছিলাম কর্নেল বেগ নামক এক পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তা মুক্তিযুদ্ধের সময়ই জিয়াকে ধন্যবাদসূচক চিঠি লিখে বলেছিল পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ জিয়ার কর্মকান্ডে খুশি এবং তাকে আরও অধিক দায়িত্ব দেওয়া হবে।

গুরুত্বপূর্ণ মুুক্তিযোদ্ধাদের সবারই যুদ্ধকালীন বহু বীরত্বের কথা বিভিন্ন পুস্তকে, পত্র-পত্রিকায় ছাপা হলেও জিয়া কোথাও যুদ্ধ করেছে এমন কোনো খবর কখনো দেখা যায়নি। মুক্তিযুদ্ধকালে যুক্তরাজ্য প্রবাসী মুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত ছিলাম বিধায় প্রতিদিন বিলেতের বহু পত্রিকা পড়তাম, বিবিসির খবর শোনতাম। শফিউল্লাহ, খালেদ মোশাররফ, মেজর রফিক, কাদের সিদ্দিকী, আ ক ম মোজাম্মেল হক, সি আর দত্ত প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধার কথা প্রায়ই শুনতে পেতাম, কিন্তু জিয়ার কথা কখনো শুনিনি। কর্নেল তাহের হত্যা মামলার বিচারের সময় যেসব বীর মুক্তিযোদ্ধা আমার আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন, তারা সবাই বলেছেন জিয়া কোনো যুদ্ধ করেনি। গত সপ্তাহে জেনারেল শফিউল্লাহ এবং মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. হারুন-অর-রশিদও একই কথা বলেছেন।

ক্ষমতা জবরদখলের পর জিয়া যে পরীক্ষিত রাজাকারদের ক্ষমতায় বসানোর জন্য অস্থির হয়ে গিয়েছিলেন, সে কথা জিয়ার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন ক্যাপ্টেন নুরুল হক তার বই ‘হাই টাইড, হাই টাইম’-এ লিখেছেন। ব্যারিস্টার মওদুদও তাই-ই লিখেছেন। জিয়া তার অবৈধ শাসনামলে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ প্রচার বন্ধ করেছিল, সে কোনো দিনও বলত না পাকিস্তানিরা আমাদের দেশে দখলদার ছিল। পাকিস্তানের কাছে আমাদের পাওনা টাকা এবং সম্পদের হিস্সা, ধ্বংসের ক্ষতিপূরণ, ক্ষমা চাওয়া এবং বিহারিদের ফিরিয়ে নেওয়ার দাবিও জিয়া-মোশতাক ক্ষমতা দখলের পর স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশ ভরে গিয়েছিল পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই কর্মকর্তাদের দ্বারা। জঘন্য রাজাকার শর্ষিনার পীরকে দেওয়া হয়েছিল স্বাধীনতা পুরস্কার। গোলাম আযমসহ বহু যুদ্ধাপরাধীকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল বাংলাদেশে, তাদের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল বাংলাদেশে রাজনীতি করার, সুযোগ দেওয়া হয়েছিল সম্পদের পাহাড় গড়ার, যার কারণে সাকা এবং মীর কাসেম আলী এবং অন্য যুদ্ধাপরাধীরা এত সম্পদশালী। জিয়া ’৭২-এর মুক্তিযুদ্ধপন্থি সংবিধান ক্ষতবিক্ষত করে মুক্তিযুদ্ধের সব চেতনা সংবিধান থেকে মুছে ফেলেছিল, ধর্মীয় রাজনীতির প্রচলন করেছিল। এক কথায় জিয়া মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। এমনকি বর্তমানে বিএনপির শীর্ষ নেতা, প্রবাসী বীর প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, যিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনিও জিয়া কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজাকার এবং পাকিস্তানপ্রেমীদের ক্ষমতায় বসানোর বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় জিয়ার সমালোচনা করেছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জিয়ার প্রবেশের প্রতিবাদ করেছিলেন। এসব বিবেচনা করলে কোনো অবস্থায়ই জিয়াকে মুক্তিযোদ্ধা বলা যায় না। মুক্তিযুদ্ধের ছদ্মাবেশে তিনি ছিলেন একজন পাকিস্তানি চর। দেশ মুক্ত হওয়ার পর যখন জিয়াকে বীরউত্তম উপাধি দেওয়া হয়েছিল তখন জিয়ার সবকিছু জানা যায়নি। তার আসল রূপ এবং ভূমিকা ধরা পড়েছিল পরবর্তীকালে।

জিয়া শাসনক্ষমতা দখল করার পরই দালাল আইন বাতিল করে যে ১১ হাজার দালালকে বঙ্গবন্ধু আটক করেছিলেন, তাদের সবাইকে মুক্ত করে দিয়েছিল। কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা যথা ক্যাপ্টেন শহুদুল (গ্রেনেড হামলা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত), ক্যাপ্টেন ওয়াহেদ (বর্তমানে যুদ্ধাপরাধ মামলায় আটক)সহ বেশ কিছু সেনা কর্মকর্তা, যারা যুদ্ধাপরাধ করেছিল, যারা দেশ মুক্ত হওয়ার প্রাক্কালে পাকিস্তানে পালিয়ে গিয়েছিল, জিয়া তাদের ফেরত এনে পুলিশের উঁচু পদে চাকরি দিয়েছিল, যার ফলে তাদের একজন পরবর্তীতে পুলিশের আইজি (যে পরে আমার আদালত অবমাননার আদেশের ধারাবাহিকতায় চাকরিচ্যুত হয়েছিল) এবং আরেকজন জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান হতে পেরেছিল। জিয়া শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, সে প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে কমপক্ষে ১১ শ বীর মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেছে।

প্রশ্ন হচ্ছে যে ব্যক্তি স্বাধীনতার মাত্র তিন বছর পর ক্ষমতা জবরদখল করে সমস্ত মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কাজে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত চেতনা ধ্বংস করে দিয়েছিল, দেশকে পাকিস্তানের সঙ্গে পুনরায় একত্রিতকরণ প্রক্রিয়ায় ব্যস্ত হয়েছিল, পাকিস্তানি তোয়াজে লিপ্ত ছিল সে ব্যক্তি তিন বছর আগে মুক্তিযোদ্ধা ছিল, এটা বিশ্বাস করা বাতুলতা বই কিছু হতে পারে না। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ প্রতিদিনে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তমের লেখাটি পড়লাম। আমি যেসব মহান ব্যক্তিকে অতীব শ্রদ্ধার চোখে দেখি, কাদের সিদ্দিকী ভাই তাদের অন্যতম। শুধু বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন বলেই নয়, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তিনি বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে ভারত চলে গিয়েছিলেন হত্যাকারীদের শায়েস্তা করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার দৃঢ় শপথ নিয়ে। ভারতে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন না হলে তিনি হয়তো দেশকে নতুন করে রাজাকারমুক্ত করতে পারতেন সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে, বঙ্গবন্ধুর সত্যিকার অনুসারী হিসেবে। তার অসাধারণ পদক্ষেপ তাকে চিরস্মরণীয় করে রাখবে, আর তাই তিনি যখন কলকাতা থেকে লন্ডন গিয়েছিলেন ’৮০-এর দশকে তখন আমি এবং আমরা তার সঙ্গে অনেক সময় কাটিয়েছি। আমার স্ত্রী তখন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। তার পরও কাদের সিদ্দিকী ভাই আমার বাড়িতে আতিথেয়েতা গ্রহণ করে আমাদের ধন্য করেছিলেন, যে কথাগুলো কাদের ভাই বছর দুয়েক আগে বাংলাদেশ প্রতিদিনে লিখেছিলেন স্মৃতিচারণা করে, যার জন্য তাকে ধন্যবাদ। তিনি কলকাতায় ফিরে গিয়ে আমাকে যে চিঠিটি লিখেছিলেন, তা আমি যত্নসহকারে বাঁধিয়ে রেখেছি এক অমূল্য স্মৃতি হিসেবে। আমার বাড়িতে নৈশভোজের সময় কাদের ভাই বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তিনি মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার এ ধরনের গভীর আনুগত্য খুবই বিরল। সেদিন কিন্তু কাদের সিদ্দিকী ভাই জিয়া-মোশতাককে তুলাধোনা করতে কার্পণ্য করেননি, এরা দুজন যে বঙ্গবন্ধু হত্যার চাবিকাঠি, তাও বলেছিলেন। কঠোর ভাষায় নিন্দা করেছিলেন জিয়ার মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কার্যকলাপের, পাকিপ্রেম ভূমিকার। সে অনুষ্ঠানে সুলতান শরিফ ভাইও ছিলেন। সম্ভবত গাফ্ফার ভাইও ছিলেন। যাই হোক, অতি বিনয়ের সঙ্গে কাদের ভাইয়ের সাম্প্রতিক লেখার ওপর দুটি কথা বলতে চাই। তিনি বলেছেন, ‘বীরউত্তম জিয়াউর রহমান অবশ্যই বঙ্গবন্ধুর খুনের আসামি হতে পারেন, এ নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই’। আর এক জায়গায় লিখেছেন, ‘তাহলে যখন বঙ্গবন্ধু হত্যার মামলা হলো, বিচার হলো তখন কেন তাকে আসামি করা হলো না?’ শ্রদ্ধাভরেই কাদের ভাইকে জানাতে চাই আমাদের আইনে কোনো মৃত ব্যক্তিকে আসামি করা যায় না, যার জন্য আদিতে মোশতাককে আসামি করা হলেও পরে তাকে আসামির তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল এবং সম্প্রতি এরশাদ সাহেবের প্রয়াণের পর তাকেও জেনারেল মঞ্জুর হত্যা মামলায় আসামির তালিকামুক্ত করা হয়।

জিয়া মনেপ্রাণে মুক্তিযোদ্ধা ছিল না, বরং পরিস্থিতির চাপে ভারত গিয়েছিল, কোনো যুদ্ধই করেনি, বরং পাকিস্তানের চর হিসেবে কাজ করেছে এ অভিযোগের পক্ষে প্রমাণ অপরিসীম, বিশেষ করে ১৯৭৫-পরবর্তী জিয়ার ভূমিকা নিরঙ্কুশভাবেই এসব অভিযোগ প্রমাণ করে।

একবার খেতাব দেওয়া হলে তা কেড়ে নেওয়া যায় না বলে কাদের ভাই যা লিখেছেন, বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই তা ঠিক নয়। প্রথমত জিয়াকে এবং অন্যদের যখন খেতাব দেওয়া হয় তখন তাদের আসল রূপ ধরা পড়েনি বিধায় ভ্রান্ত ধারণার বশবতী হয়ে যা দেওয়া হয়, আইনের দৃষ্টিতে তা শুরু থেকেই অবৈধ (vitiated ab-initio), তা ছাড়া জেনারেল ক্লজেস অ্যাক্টের ১৬ ধারা প্রদানকারী কর্তৃপক্ষকে প্রদত্ত বিষয় বাতিল করার ক্ষমতাও দিয়েছে। যেমনটি হয়েছিল মিয়ানমারের সু চির ব্যাপারে। নোবেল পুরস্কার ছাড়া সু চিকে দেওয়া বহু সম্মাননা পরবর্তীতে তুলে নেওয়া হয়েছে। শুধু সু চিই নন, ব্রিটিশ রানী আমার দেখা মতেই ওবিই, এমবিই খেতাব তুলে নিয়েছিলেন (১) ঘোড়দৌড়ের বিখ্যাত জকি লেস্টার পিগটের (২) আর্ট অ্যাডভাইজার টনি ব্লান্টের (৩) মুষ্টিযোদ্ধা হামিদ নাসির এবং (৪) টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব রলফ হেরিসের। চিলটার্ন হানড্রেডের স্টুয়ার্ড হিসেবে চাকরি নেওয়ার পর ব্রিটিশ রানী জন স্টোন হাউসকেও ‘রাইট অনারেবল’ (প্রিভি কাউন্সিলদের জন্য প্রযোজ্য) পদবি থেকে বঞ্চিত করেছিলেন। যত দূর মনে পড়ে বিখ্যাত ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক, টরি নেতা জেফরি আর্চারের পিয়ারেজও বাতিল করা হয়েছিল। পাকিস্তান সরকার বিচারপতি ইব্রাহিমকে দেওয়া পদকও তুলে নিয়েছিল। সুতরাং জামুকা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা আইন দ্বারা পুরোপুরি সমর্থিত, মহামান্য রাষ্ট্রপতির নিশ্চিত ক্ষমতা রয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মহোদয়ের পরামর্শ অনুযায়ী জিয়া এবং অন্যদের খেতাব তুলে নেওয়ার, যা অবিলম্বে কার্যকর করা উচিত।

জিয়া যে বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল খলনায়ক ছিল তা বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ৯ নম্বর সাক্ষী কর্নেল হামিদ, ৪৪ নম্বর সাক্ষী কর্নেল শাফায়াত জামিল, ৪৫ নম্বর সাক্ষী জেনারেল শফিউল্লাহর সাক্ষী থেকে নিরঙ্কুশভাবে প্রমাণিত। তা ছাড়া লন্ডনে এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে ফারুক এবং রশীদও বিষয়টি পরিষ্কার করে বলেছে। ১৯৭৬-এর ৩০ মে লন্ডনের ‘সানডে টাইমস’ পত্রিকায় পৃষ্ঠাব্যাপী লেখায় কর্নেল ফারুক জিয়ার সম্পৃক্ততার কথা দ্বিধাহীন ভাষায় উল্লেখ করেছে। বহু বছর পালিয়ে থাকার পর ধরা পড়ে তার ফাঁসির আগে দেওয়া বক্তব্যে খুনি ক্যাপ্টেন মাজেদ বলেছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল চাবিকাঠি নেড়েছিল জিয়া, মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী, যিনি কোনো পক্ষের লোক নন, তিনি তার বই ‘এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য’তে লিখেছেন, তিনি জিয়ার বাড়িতে কর্নেল ফারুককে দেখে অবাক হয়ে জিয়াকে জিজ্ঞেস করলে জিয়া সদুত্তর দিতে পারেনি। তদুপরি খুনিদের বিচারের দায় থেকে রেহাই দেওয়ার আইন করে এবং সে আইন সংবিধানভুক্ত করার চেষ্টা করে, তাদের প্রত্যেককে পদোন্নতিসহ লোভনীয় কূটনৈতিক চাকরি দিয়ে জিয়া নির্ভুলভাবে প্রমাণ করেছে, সে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের মূল খলনায়ক ছিল। সুতরাং বীরউত্তম খেতাব তুলে নেওয়া অপরিহার্য।

            লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি।

সর্বশেষ খবর