লেখাটা ছিল গত মঙ্গলবার। শবেবরাতের কারণে পত্রিকা বন্ধ থাকায় ছাপা হয়নি। আবার করোনার কারণে গতকাল থেকে সারা দেশে লকডাউন। প্রথম ধাপে কিছু কিছু জেলায় লকডাউন হলেও সারা দেশে তেমন ব্যাপক লকডাউন ছিল না। আল্লাহ জানেন সামনে কী হবে। তবে আশা করব সামনের দিনগুলো যাতে ভয়াবহ না হয়।
মুসলিম জাহানের সবচেয়ে বরকতময় রাত শবেবরাত পার করলাম। আর কদিন পর মুসলিম জাহানের পরম আরাধ্য মাহে রমজান। পরম করুণাময় প্রভু দয়াময় আল্লাহ আমাদের করোনা ও অন্যান্য বালামুসিবত থেকে নাজাত দান করুন, আমাদের মঙ্গলময় সুস্থিতির জীবন দান করুন। সমগ্র মুসলিম জাহান এবং তামাম দুনিয়ার মানব জাতির কল্যাণ প্রার্থনা করছি।
.jpg)
বছরটি আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একাধারে আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস, সব সত্তা ও অস্তিত্ব জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ঘিরে। আর তো সুবর্ণজয়ন্তী পাব না, বঙ্গবন্ধুর দ্বিশততমজন্মবার্ষিকী ভাগ্যে জুটবে না। তাই এটাই আমাদের জন্য এক মহা আনন্দ ও গৌরবের দিন। আগাগোড়াই জানি, যে কোনো বড় কাজের সঙ্গে যুক্তদের বেশিদিন বাঁচতে নেই। তাদের দীর্ঘ জীবন বিড়ম্বনার কারণ। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বেশ কয়েকজন পরম সম্মানী বিদেশি অতিথি এসেছেন। তাঁদের সরকারিভাবে যথাযথ সম্মানও দেখানো হয়েছে। কিন্তু কেন যেন মনে খুঁত থেকে যায়, জাতীয়ভাবে তাঁদের কি যথাযথ সম্মান দেখানো গেছে, বিশেষ করে ভারতের মান্যবর প্রধানমন্ত্রী শ্রীনরেন্দ্র মোদিকে। তাঁর বাংলাদেশ সফর নিয়ে ধর্মীয় দলগুলোর আপত্তি। অন্যান্য কিছু দলেরও ছিল। ব্যক্তি নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের সত্যিই কোনো মানে হয় না। ভারতে কৃষক নির্যাতন, এনআরসি করে আসামে লোক বিতাড়ন এমনি নানা বিতর্কিত কারণে শ্রীনরেন্দ্র মোদির সফর নিয়ে আপত্তি জানানো যেতেই পারে। আমার মনে হয় এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি নরেন্দ্র মোদির কোনো প্রাধান্য ছিল না, সফরে প্রাধান্য ছিল ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীনরেন্দ্র মোদির। যে যা-ই বলুন, সফরকালে সাতক্ষীরার শ্যামনগরের যশোরেশ্বরী কালীমন্দির পরিদর্শন ও পূজায় অংশগ্রহণ, টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিস্থলে শ্রদ্ধা নিবেদন, গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীর ওড়াকান্দিতে হরিচাঁদ ঠাকুরের মন্দির পরিদর্শন এবং মতুয়া সম্প্রদায়ের সমাবেশে তাঁর অসাধারণ বক্তব্য সবাইকে মুগ্ধ করেছে। যদিও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি তাঁর এ বাংলাদেশ সফরে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে প্রভাব ফেলার অভিযোগ এনেছেন। তাঁর অভিযোগ যেমন উড়িয়ে দেওয়া যায় না তেমনি শ্রীনরেন্দ্র মোদির অসাধারণ নেতৃত্বগুণ ভোলা যায় না, অস্বীকার করা যায় না। সরকারিভাবে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালনে ১৭ থেকে ২৬ মার্চ- ১০ দিনের কর্মসূচির শেষ দিনে প্যারেড গ্রাউন্ডে ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে অসাধারণ হৃদয়গ্রাহী বক্তৃতা করেছেন, বাংলাদেশকে যে উচ্চতায় তুলে ধরেছেন তা অস্বীকার করার কারোর কোনো উপায় নেই। কিন্তু দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে তেমন খুব একটা অগ্রগতি হয়নি, তিস্তার পানি বণ্টনে তো একেবারেই নয়। আর বিশেষ করে সুবর্ণজয়ন্তী এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালনে সব জাতিকে, দেশকে, দলমত সবাইকে এক মোহনায় শামিল করতে সরকার এবং আওয়ামী লীগ অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছে। যেভাবে যে বিনয়ী তৎপরতায় অনেককে পাশে পাওয়া যায় বা কাছে আনা যায় তার তেমন কিছুই করা হয়নি।
দেশ থাকলে দলাদলি থাকবে, মতের পথের ভিন্নতা থাকবে। কিন্তু জাতিগতভাবে কিছু কিছু বিষয়ে আমরা সব সময় ঐক্যবদ্ধ হব। দেশ রক্ষায়, জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষায়, মানুষের জীবন-সম্পদ ও সম্মান রক্ষায় আমাদের কখনো কোনো দ্বিমত থাকবে না, থাকার কথাও না। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমরা এসব ক্ষেত্রেও খুব একটা কাছাকাছি হতে পারি না। আমাদের কোথায় যেন দ্বন্দ্বের দেয়াল একত্র হতে দেয় না। কদিন থেকে হেফাজতের নামে হরতাল, গাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করা হচ্ছে। এত দিন আমরা জেনে এসেছি হেফাজত দিনে চিৎকার-চেঁচামেচি যা-ই করুক রাতে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে, সমঝোতা করে চলে। এটা যদি সত্য হয় তাহলে এসব কেন? বঙ্গবন্ধুর ছবির ওপর যখন হেফাজতের কর্মীরা ইট-পাটকেল ছোড়েন, লাঠি মারেন মন বড় বিক্ষুব্ধ হয়ে যায়। ছেলেবেলায় শুনেছিলাম, ‘কার কপালে খাও লো বান্দি মনিব চিন না’, ‘খাইটা মরে হাইলার চাষা, সুরীর ঘরে লক্ষ্মীর বাসা’- অনেকটা তেমনই। বাংলাদেশ না হলে হেফাজতের জন্ম হতো না, আজকের এ লাঠিসোঁটাও হতো না। সেই মানুষটা যে মানুষটা সারা জীবন ত্যাগ স্বীকার করেছেন, বাংলাদেশের জন্মের জন্য জীবন পাত করেছেন, ব্যক্তিগত সুখ-স্বচ্ছন্দ জলাঞ্জলি দিয়েছেন তাঁর ছবি ভাঙচুর-লাঞ্ছনা এসব ভালো লাগে না। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর নানা স্থানে বঙ্গবন্ধুর ছবি ভাঙা হয়েছিল, পায়ে মাড়ানো হয়েছিল, লন্ডন হাইকমিশনেও বঙ্গবন্ধুর ছবি ফেলে যারা পায়ে মাড়িয়ে ছিল তারা অনেকেই মন্ত্রী হয়েছেন, নেতা হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর ছবি যখন পায়ে মাড়িয়েছিলেন তখন ছিল খুনিদের সরকার, বঙ্গবন্ধুবিরোধী সরকার। এখন তো বঙ্গবন্ধুর কন্যার সরকার, এখনো বঙ্গবন্ধুর ওপর অমন আক্রোশ! এসব ভাবা যায়? একেবারেই যায় না। প্যারেড গ্রাউন্ডে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা গভীর মনোযোগের সঙ্গে শুনেছি। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে কতজনের নাম নিয়েছেন অথচ তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতার পর ২৪ জানুয়ারি, ’৭২ টাঙ্গাইলে গিয়ে আমার হাত থেকে কাদেরিয়া বাহিনীর অস্ত্র আনার কথা একবারের জন্যও মনে করেননি। মনে করেননি ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে এক শ কয়েকজন যোদ্ধা নিহত এবং চার শ জনের ওপর আহত হয়েছিল তাদের কথা। অথচ রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রপতিকে রক্ষা বা তাঁর নিরাপত্তার যে সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব ছিল কর্নেল জামিলের, সে দায়িত্ব পালন করতে না পারা ব্যর্থ জামিলের নাম নিতে প্রধানমন্ত্রী ভোলেননি। কিন্তু আমাদের ত্যাগ-তিতিক্ষা, রক্তদান মনে করতে বেমালুম ভুলে গেছেন! তাই এমন শুভক্ষণেও কষ্ট যে হয় না তা নয়। আজ যে যত আরামেই থাকুন, ১৬ আগস্ট ’৭৫-এ এক লিফলেটের মাধ্যমে বলেছিলাম, ‘খুনিরা কামাল-জামাল-রাসেলকে হত্যা করতে পারলেও বঙ্গবন্ধুকে নির্বংশ করতে পারেনি। আমি কাদের সিদ্দিকী তাঁর চতুর্থ সন্তান। পিতৃহত্যার বদলা আমরা নেবই নেব।’ আওয়ামী লীগ করি না বলে সেসব বেমালুম ভুলে গেছেন। আমি বর্তমানে আওয়ামী লীগ করি না সত্য, কিন্তু চরম সততা ও পরম পবিত্রতার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে অনুসরণ করি। যত দিন বাঁচব বঙ্গবন্ধুকে বুকে লালন করেই বাঁচব, হৃদয়ে ধারণ করেই বেঁচে থাকব। কথায় আছে, ‘সুসময়ে বন্ধু বটে অনেকেই হয়, অসময়ে হায় হায় কেহ কারো নয়’। তাই সব সময়ই কেন যেন এক মারাত্মক শঙ্কায় থাকি। সরকারের নরম গদিতে বসে অনেক কিছু আঁচ করা যায় না। আর ধীরে ধীরে যেভাবে ক্ষমতা শুধু প্রধানমন্ত্রীর দফতরে কেন্দ্রীভূত হয়েছে তাতে আরও ঘুটঘুটে অন্ধকারের সৃষ্টি হয়েছে। আজ ২০-২১ বছর কী কষ্ট কী অবহেলা এবং নির্যাতন সহ্য করে বেঁচে আছি। তার পরও হঠাৎ কোনো ওলটপালট হলে খুব একটা সুখে থাকব না জানি। কিন্তু কত চেষ্টা করি কেউ কোনো কথা শোনে না। সবাই গা ভাসিয়ে দিয়েছে। সবাই ভাবছে এভাবেই দিন যাবে। জন্মের পর মৃত্যু, শিশুকাল-যৌবন তারপর বৃদ্ধ এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াও ক্ষমতাবানরা ভুলে গেছে। সব সময় চাই ফুলে ফলে আনন্দে গৌরবে দেশ ভরে উঠুক, একটি শান্তি ও সমৃদ্ধির নীড় রচিত হোক। কিন্তু দেশকে সেদিকে মোটেই এগোতে দেখছি না। মাথা ভারী প্রশাসন, কিছু লোকের কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা তো আর একটা দেশ ও জাতির উন্নয়ন হতে পারে না।
২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে দেশ ও দেশবাসীকে আরেকটু সম্পৃক্ত করা গেলে খুবই ভালো হতো। বিশেষ করে ২৬ মার্চ জাতীয় স্মৃতিসৌধে বেলা দেড়টার আগে কেউ শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারেনি। কারণ ভারতের মান্যবর প্রধানমন্ত্রী শ্রীনরেন্দ্র মোদির জন্য বেদিমূল খালি রাখা হয়েছিল। বিদেশি মেহমানদের জন্য অবশ্যই সাবধানতা নিতে হবে। কিন্তু তার অর্থ সবাইকে গৃহবন্দী করে নয়। একদিকে হেফাজতের তা-ব, অন্যদিকে সরকারি বিধিনিষেধে ঢাকা হয়ে পড়েছিল একেবারে একটি অবরুদ্ধ নগরী। কেউ কোনো দিকে যেতে পারেনি। আমার সঙ্গে বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির কথা বলার ছিল। তারা ঘর থেকে বেরোতে পারেননি, সাক্ষাতের অপারগতা প্রকাশ করেছেন। কেন এমন হবে? সুবর্ণজয়ন্তী তো আর বছর বছর পাব না। কোথায় যেন পরিচালনায় একটা সূক্ষ্ম দুর্বলতা। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন কমিটিতে সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম। একজন নির্বিবাদী ভালো মানুষ। এত বড় একটি মহাযজ্ঞ, যেখানে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের প্রাধান্য থাকার কথা সেখানে আমলা দিয়ে এত বড় একটা কাজ কী করে সুন্দরভাবে সুসম্পন্ন হতে পারে? ছাগল দিয়ে তো আর ধান মাড়ানো যায় না। পছন্দ না হলেও ধান মাড়াতে গরু লাগে। সেখানে আবার মহিষও চলে না। ছাগলের পাড়ায় যেমন ধান পড়ে না, মহিষের পাড়ায় ধান নষ্ট হয়। ধান মাড়ানোর জন্য গরুই উত্তম। যদিও এখন মান্ধাতা আমলের পদ্ধতিতে ধান মাড়ানো হয় না। মাড়ানো হয় যান্ত্রিক পদ্ধতিতে। তা হোক, যান্ত্রিক পদ্ধতিতেও গুণাগুণ বিচারের প্রয়োজন আছে। যাক, আল্লাহ আমার দেশকে ভালো রাখুন, সব বালামুসিবত থেকে হেফাজত করুন, ধনী-নির্ধন সবাই সম্মানে নিরাপদে থাকুক সুবর্ণজয়ন্তী এবং পিতার শততম জন্মবার্ষিকীতে- পরম করুণাময়ের কাছে এ কামনাই করি।
লেখক : রাজনীতিক।
www.ksjleague.com