শনিবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

প্রয়োজন ধারালো টিনের তলোয়ার

হারুন রশীদ

প্রয়োজন ধারালো টিনের তলোয়ার

১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ধর্ম ও ইসলাম নিয়ে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী এবং তাদের দোসররা যেসব মনগড়া কথা বলেছে সেসব শুনলে এবং মানলে ভাষা আন্দোলন সফল হতো না। স্বাধীন হতো না বাংলাদেশ। ভাষা আন্দোলন অনিবার্য হয় তখন যখন পাকিস্তানি শাসকরা বাংলা ভাষাকে ‘হিন্দুর ভাষা’, ‘বিধর্মীর ভাষা’ এসব আখ্যা দিয়ে উর্দুকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধকেও পাকিস্তানি শাসক এবং তাদের দেশি-বিদেশি দালালরা ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হিসেবে গণ্য করার অপচেষ্টা করেছিল। কিন্তু ধর্ম এবং ধর্মান্ধতা প্রতিহত করে বাঙালি ভাষার সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রামসহ মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও মানবিকতার দাবি আদায়ের সব সংগ্রাম ও আন্দোলনে বিজয়ী হয়েছে।

আমরা জানি, ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়েছিল। এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল হিসেবে আমাদের দেশ হয়েছিল পাকিস্তানের অংশ। রাজনীতিবিদদের কারণে হোক আর ধর্মীয় সংবেদনশীলতার জন্যই হোক আমরা ‘মুসলমানদের আবাসস্থল’ পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছিলাম। অর্থাৎ রাষ্ট্র গ্রহণের ক্ষেত্রে সে সময় হিন্দু এবং মুসলমানের সুস্পষ্ট ধর্মীয় বিভাজনে ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় আমরাও অংশগ্রহণ করেছিলাম। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তানের নাগরিক হলেও সাম্প্রদায়িকতা কিংবা ধর্মান্ধতা কিন্তু তখন আমাদের আচ্ছন্ন করতে পারেনি। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরও পাকিস্তানের পূর্বাংশ অর্থাৎ আমাদের এ ভূখন্ডের নাম ছিল পূর্ববঙ্গ। পরবর্তীতে রাজনৈতিক মানচিত্রে আমাদের এ দেশের নাম পূর্ব পাকিস্তান উল্লিখিত হলেও হাজার বছর ধরে লালিত বাঙালির সংস্কৃতি, জীবনাচার এবং মনস্তাত্ত্বিক ভাবনার জন্য পকিস্তান রাষ্ট্রের ধর্মীয় পরিচয় আমাদের কখনো প্রভাবিত করতে পারেনি। অথচ আমাদের পরিবারে ধর্মচর্চা এবং ধর্মীয় অনুশাসন বিদ্যমান ছিল। আমাদের পূর্বপুরুষ এবং অগ্রজেরা ধার্মিক ছিলেন। কিন্তু সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। ধর্মান্ধতার তো প্রশ্নই ওঠে না। বাঙালির এ উদার এবং অসাম্প্রদায়িক ভাবনা ও অস্তিত্বের ফসল ভাষা আন্দোলন। স্বাধীনতাযুদ্ধেও বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ রেখেছিল তার অসাম্প্রদায়িক ভাবনা।

ঔপনিবেশিক শাসন, শোষণ এবং নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাঙালি যখনই ফুঁসে উঠেছে তখনই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ইসলাম এবং ধর্মের নানা ধুয়া তুলে বাঙালির আন্দোলন এবং সংগ্রামকে নষ্ট ও দিগ্ভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তারা সফল হয়নি। স্বাধীন বাংলাদেশেও ধর্মকে পুঁজি করে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা করা হয়েছে এবং সে চেষ্টা এখনো অব্যাহত আছে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর একাত্তরের পরাজিত শত্রুরা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ধর্মের লেবাস পরে বাঙালির আত্মপরিচয় এবং সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যকে ভূলুণ্ঠিত করার চেষ্টা করেছে। দুরন্ত কৈশোর অতিক্রম করে আমরা যখন তরুণ তখন ১৯৭৬-৭৭ সালে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের লেবাসে বাংলাদেশে ইসলামী ছাত্রশিবির আত্মপ্রকাশ করে। ধর্মভিত্তিক নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী কার্যক্রম শুরু করে তখনই। ১৯৭৫-এর বিভীষিকার পর বিভ্রান্ত বাঙালি তরুণসমাজকে দিগ্ভ্রান্ত করার অপতৎপরতায় মেতে ওঠে শাসককুল। আর এ অপতৎপরতায় তাদের সঙ্গী হয় জামায়াত-শিবিরসহ উগ্র মৌলবাদী শক্তি।

আমাদের অনেক পরিচিত তরুণ ও যুবক, বন্ধু এবং সহপাঠীকে দেখেছি তখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে না আসা ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিভিন্ন ফ্রন্টলাইন সংগঠনের নানা অনুষ্ঠান ও কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করছে। এসব কর্মকান্ডে নিয়মিত অংশগ্রহণকারী কেউ কেউ পরবর্তীতে ইসলামী ছাত্রশিবিরে যোগদান করেছে। সে সময় বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের কোনো সন্তান আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হবে তা ছিল অনেক অভিভাবকের কাছে ভাবনারও অতীত। কারণ, উড়ে এসে জুড়ে বসা সামরিক সরকারের লোকজনসহ ধর্মীয় অপশক্তির ধারক ও বাহকরা আওয়ামী লীগকে গণবিরোধী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সংগঠিত প্রচারণা চালিয়েছে। আর বঙ্গবন্ধুকে তো খলনায়ক বানানোর চেষ্টা চলেছে। সামরিক স্বৈরতন্ত্র এবং ধর্মীয় অপশক্তির এসব প্রচারণাকে অনেক ক্ষেত্রে ভিত্তি দিয়েছে বামপন্থি নামধারী কিছু ব্যক্তি ও সংগঠনের কার্যক্রম, বক্তৃতা-বিবৃতি।

মধ্যবিত্ত বাঙালি অভিভাবকদের বৃহদাংশ চাইত না তাদের সন্তানরা রাজনীতি করুক। আওয়ামী লীগ করুক তা ছিল তাদের ভাবনারও বাইরে। বামপন্থিদের নানা হঠকারী কর্মকান্ড দেখে সন্তানদের সে পথে যেতেও নিরুৎসাহ করত। প্রচলিত রাজনীতির সঙ্গে সন্তানদের যুক্ত হওয়ার চেয়ে ইসলাম এবং ধর্ম নিয়ে ‘সুন্দর সুন্দর’ কথা বলা লোকদের সঙ্গে মেলামেশা করা এবং তাদের সৃষ্ট সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হওয়াকে অনেক অভিভাবক ভালো বিকল্প (বেটার অপশন) বলে বিবেচনা করতেন। পরে যখন এসব অভিভাবক দেখেছেন, ওইসব ব্যক্তির সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সংগঠন ও প্ল্যাটফরমগুলো আসলে ইসলামী ছাত্রশিবিরের ছদ্মবেশী সংগঠন, তখন অনেক অভিভাবক চেষ্টা করেছেন ওইসব ব্যক্তি ও সংগঠনের কাছ থেকে তাদের সন্তানদের ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু অনেকেই সফল হননি। কারণ তাদের সন্তানরা তত দিনে সংগঠনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে গেছে। নেতা হয়ে গেছে কেউ কেউ।

বড় নষ্ট সময় ছিল সেটা। ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃত করার চেষ্টা চলেছে। মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের পৃষ্ঠপোষকতায় স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক শক্তি রাষ্ট্র ও সমাজে পুনর্বাসিত হয়েছে। জাতির পিতার হত্যাকারীরা পুরস্কৃত হয়েছে। এসব দেখে বিভ্রান্ত ও দিগ্ভ্রান্ত হয়েছে তখনকার নতুন প্রজন্ম। আর এর সুযোগ নিয়েছে স্বৈরাচারী শাসকরা। ছাত্র রাজনীতির গৌরবময় ঐতিহ্য নষ্ট করে সরকারের স্বার্থ রক্ষাকারী ছাত্র সংগঠন জন্ম দিয়েছে তারা। নানা স্বপ্ন, লোভ আর প্রলোভন দেখিয়ে সেসব সংগঠনে ভেড়ানো হয়েছে উচ্চাকাক্সক্ষী মধ্যবিত্ত পরিবারের তরুণ-তরুণীদের। আমরা কেন সে সময় ওইসব ধর্মভিত্তিক সংগঠন এবং সামরিক শাসকের তৈরি ছাত্র সংগঠনে যোগ দিইনি তার কারণ আমাদের অগ্রসর ও অসাম্প্রদায়িক ভাবনা। আমাদের পরিবার আমাদের ধর্মকর্ম করতে উৎসাহিত করত। কিন্তু ধর্মান্ধতা এবং সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দিত না। পারিবারিক আবহের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিল সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে আমাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ। আমরা তখন নিয়মিত সিনেমা দেখতাম। বাড়িতে গান-বাজনা হতো। পাড়া-মহল্লা, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে হতো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বার্ষিক নাটক, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন ক্লাব ও সামাজিক সংগঠন সাহিত্য পত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করত। বের করত দেয়াল পত্রিকা। পড়াশোনার পাশাপাশি আমরা এসবে মেতে থাকতাম। আমি এমন অনেককে জানি, নিয়মিত সিনেমা দেখার অভ্যাসের ফলে তারা প্রতিক্রিয়াশীল ও ধর্মীয় উগ্রবাদী কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত হয়নি। স্বাধীনতার পর আমাদের দেশে অত্যন্ত বিকশিত শিল্পমাধ্যম হলো মঞ্চনাটক। গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্তদের আধুনিক ও পরিচ্ছন্ন ভাবনার উজ্জ্বল দ্যুতি আমাদের সৃজনশীল ভাবনা ও শিল্পবোধে নতুন মাত্রা যুক্ত করল।

সাম্প্রদায়িকতা এবং ধর্মান্ধতা মিইয়ে গেল প্রগতিশীল শিল্পচর্চার সুবিমল বাতাসে। যার ফলে বাংলার তরুণ-যুবকরা আবারও দেশ ও সমাজ সচেতন হয়েছে। স্বৈরশাসন, সামাজিক অবিচার এবং ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ হয়েছে। রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে সাংস্কৃতিক কর্মীদের অংশগ্রহণে গড়ে ওঠা আন্দোলনে স্বৈরাচারের পতন ঘটেছে। তরুণ প্রজন্মকে সুন্দর ও মঙ্গল ভাবনায় উজ্জীবিত করতে পারলে তারা যে বিরাট কিছু করতে পারে তার দৃষ্টান্ত গণজাগরণ মঞ্চ। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গণজাগরণ মঞ্চের ভূমিকা ও প্রভাব সর্বজনবিদিত। গণজাগরণ মঞ্চের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, সংস্কৃতিমান তরুণ এবং যুবকরাই পারে সামাজিক কূপমন্ডূকতা দূর করতে, ধর্মের অপব্যবহার রোধ করতে এবং ধর্মের নামে সৃষ্ট তান্ডব প্রতিহত করতে।

ধর্মীয় উগ্রবাদ ও উন্মত্ততা এবং সাম্প্রদায়িকতা থেকে মানুষকে বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে দূরে রাখতে চাইলে তাদের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে বেশি বেশি সম্পৃক্ত ও সংযুক্ত রাখতে হবে। যে ব্যক্তি নিয়মিত সিনেমা (সে যে সিনেমাই হোক) ও নাটক দেখে, নাটক করে, গান গায়, গান শোনে, ছবি আঁকে, নাচে, নাচ দেখে উগ্রবাদী ধর্মীয় এবং সাম্প্রদায়িক ভাবনা কখনই তাকে আচ্ছন্ন করতে পারে না। আর তাই বাঙালির হাজার বছরের সম্প্রীতির ঘর সজীব ও অক্ষত রাখতে ধর্মের নামে তান্ডব ও উন্মত্ততা ঠেকাতে ঘরে ঘরে, পাড়ায়, মহল্লায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আগের মতো নিয়মিত সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করতে হবে। আর এ দায়িত্ব পালন করতে হবে মূলত সংস্কৃতির বিভিন্ন মাধ্যমে নিয়োজিত ব্যক্তিদের। মূল কাজ তারাই করবেন। সরকার তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দেবে। প্রয়োজনে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করবে। গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের শেষার্ধ থেকে শুরু করে এ শতাব্দীর প্রথম দশক পর্যন্ত কিন্তু সাংস্কৃতিক কর্মীরা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার ধার ধারেননি। কারণ অগ্রসর সাংস্কৃতিক কর্মীরা মনে করতেন তখনকার সরকার এবং রাষ্ট্রযন্ত্র বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ নানা কর্মকান্ডকে লালনপালন করে। এখনকার সরকার মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী সংগঠনের সরকার। জাতির পিতার কন্যা এ সরকারের প্রধান। সংগত কারণেই এখন সরকারি সহায়তা এবং পৃষ্ঠপোষকতা গ্রহণের ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক কর্মীরা আগের মতো অনাগ্রহী ও দ্বিধাগ্রস্ত নন।

সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেতে চাইলে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ফোরাম, প্ল্যাটফরম এবং সংগঠনকে তাদের কাজের গতিময়তা ও ফলপ্রসূতা প্রমাণ করতে হবে। নেতৃত্ব ধরে রাখার জন্য নয়, তাদের মূল কাজ হতে হবে জীবন আর শিল্প নিয়ে সীমাহীন স্বপ্ন দেখা তরুণ-তরুণীদের সংগঠিত করা, তাদের সৃজনশীলতাকে পরিচর্যা করা এবং শিল্পের বিভিন্ন শাখায় যোগ্যতমদের প্রতিষ্ঠিত করা। জীবন আর শিল্পের সীমারেখাকে একাকার করে দেওয়ার জন্য যথাযথ কাজ করতে চাইলে নেতৃবৃন্দকে ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতির হিসাব বাদ দিয়ে কাজ করে যেতে হবে। নাটকের মঞ্চে নায়ক যখন টিনের তলোয়ার দিয়ে খলনায়ককে বধ করে দর্শকরা তখন উল্লাস প্রকাশ করে। ভিলেন চরিত্রের অভিনেতার ব্যক্তিগত পতন এবং বিনাশের জন্য কিন্তু দর্শক উল্লাস করে না। তারা খুশি হয় ভিলেনের অপরাধ, অপকর্ম, অন্যায় এবং নিষ্ঠুরতার বিনাশ দেখে। সাংস্কৃতিক কর্মী এবং সৃজনশীল মানুষ শিল্পের তলোয়ার দিয়ে অন্যায় ও অসুন্দরের বিনাশ ঘটিয়ে নিজের এবং অন্যান্য মানুষের মানবিক বোধকে জাগিয়ে রাখার দায়িত্ব পালন করে। আর এজন্য শিল্প ও সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষকে হতে হয় অনেক বেশি শুদ্ধ এবং নীতিমান।

নীতিনির্ধারক ও মাঠ পর্যায়ের নির্বাহী দায়িত্ব পালনসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের অভিজ্ঞতা থেকে আমি বিশ্বাস করি, দেশের শিশু-কিশোর, তরুণ ও যুবকদের অংশগ্রহণে সারা বছর বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মসূচি গ্রহণ করা হলে তরুণ প্রজন্ম দিগ্ভ্রান্ত হবে না। এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য সরকারের তরফ থেকে দেশের ৫০০ উপজেলায় যদি বছরে ২ কোটি টাকা করে মোট ১ হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয় তাহলে এসব কর্মসূচি ঘিরে বছরব্যাপী সারা দেশে শিশু-কিশোর, তরুণ ও যুবকদের সঙ্গে সঙ্গে তাদের অভিভাবক, আত্মীয়-পরিজনসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে চমৎকার সৃষ্টিশীল আবেগ ও উদ্দীপনা বিরাজ করবে, যা এসব কাজের সঙ্গে সংযুক্তদের এবং দর্শক ও শ্রোতাদের অগ্রসর ভাবনায় অনুপ্রাণিত করবে। সরকারি উদ্যোগে ৫০০ উপজেলায় তৈরি করা যায় ৫০০ মিনিপ্লেক্স, যেখানে থাকবে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও ব্যবস্থায় সিনেমা দেখার সুযোগ। অনেকে হয়তো বলবেন, তথ্যপ্রযুক্তি বিকাশের বর্তমান উত্তুঙ্গ সময়ে মানুষের হাতের মুঠোয়ই তো থাকে নানা কনটেন্ট। সেখান থেকেই তো তারা যথাযথ কনটেন্ট দেখে জীবন ও জীবনদর্শনের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা নিতে পারে। না, তা সম্ভব নয়। কেননা মানুষের হাতের মুঠোর কনটেন্টের মধ্যে অপ্রয়োজনীয় এবং ক্ষতিকর কনটেন্টের সংখ্যাও কিন্তু কম নয়। ফেসবুক, ইউটিউব এবং টেলিভিশন কনটেন্টের ক্ষতিকর প্রভাব আমরা অনেক প্রত্যক্ষ করেছি। প্রতিদিনই করি। মানুষের সৃজনশীলতার বিকাশ এবং সুন্দরের ভাবনাকে টেকসই করতে হলে সুনির্দিষ্ট দর্শন ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সংগঠিতভাবে নিরবচ্ছিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড পরিচালনার কোনো বিকল্প নেই। আর এ কাজটা করতে হবে ন্যারোকাস্ট বা সীমিত প্রচারমাধমেই। মঞ্চের নাটক, গান, নৃত্য, কবিতা আবৃত্তি থেকে শুরু করে আমাদের পরিবার ও সমাজের নানা সাংস্কৃতিক কার্যক্রম এবং সিনেমা হলে চলচ্চিত্র প্রদর্শন হলো ন্যারোকাস্ট মাধ্যমের উপকরণ। অর্থাৎ ন্যারোকাস্ট মাধ্যমের প্রচারের পাদপীঠ হলো মানুষের ঘর, নাটকের মঞ্চ, অনুষ্ঠানের মিলনায়তন, সিনেমা হল ইত্যাদি। একটি নাটক কিংবা গান নিউ মিডিয়া এবং টেলিভিশনে এসে পরিণত হয় কনটেন্টে। নিউ মিডিয়া ও টেলিভিশনে কনটেন্ট হলো এক ধরনের বিক্রয়যোগ্য পণ্য। পণ্যের মোড়কে বন্দী নাটক, গান, নৃত্য, যাত্রাপালা ও লোকায়ত শিল্পের উপকরণ মূলত মানুষের বিনোদন চাহিদা পূরণ করে। আর সেজন্যই জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ও সৃজনশীল চাহিদার পূরণ এবং মানুষের মানবিক বোধকে সমুন্নত রাখতে নিউ মিডিয়া ও সম্প্রচারমাধ্যমের সঙ্গে সঙ্গে প্রচলিত ও চিরায়ত মাধ্যমগুলোকে অনেক বেশি সক্রিয় ও সচল রাখতে হবে।

৫০০ মিনিপ্লেক্স তৈরি করতে বড়জোর এককালীন ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা খরচ হবে। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় এসব মিনিপ্লেক্স পরিচালনা করা যেতে পারে। এসব কার্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমে আমি কিন্তু শুধুু শিল্প, শিল্পমাধ্যম এবং সাংস্কৃতিক কর্মীদের পৃষ্ঠপোষকতা, লালন ও পরিচর্যার কথা বলছি না। আমাদের বুঝতে হবে, শিল্প ও শিল্পী বেঁচে না থাকলে মানুষের অন্তরাত্মার অকালমৃত্যু ঘটে। বাংলাদেশের বার্ষিক ৩২ লাখ কোটি টাকার বাজেট থেকে এককালীন ২ হাজার ৫০০ কোটি এবং বছরে ১ হাজার কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দ প্রদান বা খরচ করা সরকারের জন্য খুব বড় ব্যাপার নয়। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যথাযথ ব্যবস্থাপনায় শিল্প ও সংস্কৃতির জন্য এ অর্থলগ্নির ফল হবে সুদূরপ্রসারী। দেশের ৫০০ উপজেলায় যদি ৫০০ মিনিপ্লেক্স তৈরি করে নিয়মিত সিনেমা দেখার সুযোগ তৈরি করা হয় তাহলে একদিকে চলচ্চিত্রশিল্প যেমন ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে যাবে, তেমনি সিনেমা দেখার সুবাদে মানুষ কুসংস্কার ও কূপমন্ডূকতামুক্ত থাকবে। তারা ধার্মিক হবে। কিন্তু ধর্মান্ধ হবে না। তারা থাকবে সাম্প্রদায়িকতামুক্ত। সরাসরি বলতে গেলে নিয়মিত সংস্কৃতিচর্চা করা এবং সিনেমা দেখা কোনো কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী সাধারণভাবে সাম্প্রদায়িক, ধর্মান্ধ এবং জঙ্গিবাদী শক্তি ও সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হবে না। আর অগ্রসর ভাবনার তরুণ প্রজন্মের অন্তর্গত সৌন্দর্য, মানুষের প্রতি মমত্ববোধ এবং মানবিকতার কাছে অসুন্দর প্রত্যাখ্যাত হবে, পরাজিত হবে ধ্বংস পিশাচ। সুন্দর ও ন্যায়ের পূজারি পরিশুদ্ধ তরুণ প্রজন্ম নিজেদের তাগিদেই প্রতিহত করবে হেফাজত, জামায়াতসহ ধর্মীয় বিষবাষ্প ছড়ানো শক্তিকে।

পশ্চাদ্পদ ধারণা, ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার ও কূপমন্ডূকতামুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে টেকসই করার লক্ষ্যে টিনের তলোয়ার দিয়ে অন্যায়, অবিচার ও অসুন্দরের বিনাশ ঘটানোর ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক কর্মীদের নিরন্তর প্রয়াস অব্যাহত রাখতে হবে। আর তাদের কর্মকান্ড বাস্তবায়নে সরকারের নিরবচ্ছিন্ন সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা বাংলাদেশকে সুন্দরের লালন কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে। সমৃদ্ধ ও সুন্দর বাংলাদেশ এবং সুন্দরের চেতনায় উদ্দীপ্ত মানুষই সাম্প্রদায়িক শক্তিসহ সব অপশক্তিকে রুখে দেবে।

                লেখক : নাট্যকার, অভিনেতা ও সাবেক আমলা।

সর্বশেষ খবর