শিরোনাম
শনিবার, ৩ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

কৌশল বুঝে করলে চাষ, ফলবে ড্রাগন বারো মাস

শাইখ সিরাজ

কৌশল বুঝে করলে চাষ, ফলবে ড্রাগন বারো মাস

বাংলাদেশে ফলের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। সঙ্গে বাড়ছে ফলের উৎপাদনও। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাবমতে বাংলাদেশে বছরে ১২ শতাংশ হারে ফলের উৎপাদন বাড়ছে। আর ফল চাষে জমির ব্যবহার বাড়ছে ১০ থেকে ১১ শতাংশ হারে। বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ চারটি ফলের মোট উৎপাদনে বাংলাদেশ শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় উঠে এসেছে। কাঁঠাল উৎপাদনে বিশ্বের দ্বিতীয়, আমে সপ্তম, পেয়ারায় অষ্টম ও পেঁপেতে চতুর্দশতম স্থানে আছে বাংলাদেশ। আর মৌসুমি ফল উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমানে দশম। দেশি ফলের পাশাপাশি স্ট্রবেরি, ড্রাগন, অ্যাভোকাডো, ত্বিন, এমনকি আপেল চাষেও বাংলাদেশের কৃষক উৎসাহী হয়ে উঠেছেন। বিশেষ করে গত এক যুগে বাংলাদেশে ড্রাগন ফলের চাষ ব্যাপক ছড়িয়েছে। কোথায় নেই? পাহাড়ি ঢালু ভূমি, মধুপুরের লাল মাটির খেত থেকে শুরু করে নরসিংদী, সাভার কিংবা ঢাকার আবাসিক ভবনের ছাদেও ড্রাগন ফল স্থান করে নিয়েছে। বাকি নেই শিল্পকারখানার ফাঁকা জায়গাটিও। ড্রাগন ফল মানেই ভিন্ন আমেজের রঙিন রসালো ফল, নিশ্চিত লাভের চাষ। শীতকালে ড্রাগন কম ফলে, বলা চলে শীতকাল ড্রাগনের অমৌসুম। অমৌসুমে ড্রাগনের চাহিদা থাকে বেশি। তাই অমৌসুমে ড্রাগন চাষের জন্য কৃষক নানা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

২০১৮ সালে চীনের গোয়াংডং প্রদেশের শিনশিং গ্রামের লিউয়ের খামারে গিয়ে দেখেছিলাম সন্ধ্যায় এলইডি বাতি জ্বালিয়ে দিনের দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে অমৌসুমেও দিব্যি ড্রাগন ফলের চাষ করছেন। টেলিভিশনে সেই প্রতিবেদন প্রচার হওয়ার পর এ দেশের ড্রাগন ফল চাষিদের মাঝে এ কৌশল অবলম্বনে উৎসাহ দেখা যায়। অনেকেই জানিয়েছেন এলইডি বাতি জ্বালিয়ে শীত মৌসুমেও ড্রাগন ফলানো সম্ভব হচ্ছে। মাস কয়েক আগে নাটোর থেকে রবিউল করিম নামে একজন ফোন দিয়ে জানালেন এলইডি বাতি ব্যবহার না করেই তিনি যে কৌশল অবলম্বন করছেন তাতে সারা বছর বাগান থেকে ড্রাগন ফল পাওয়া সম্ভব। বড়াইগ্রাম উপজেলার পাঁচবাড়িয়া গ্রামের রবিউল করিম পেশায় শিক্ষক। গত বছর থেকে করোনার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। এ অবসরে তিনি ৩ বিঘা জমিতে ড্রাগন ফলের চাষ করেন। প্রথম বছরেই ভালো ফলন পেয়েছেন। এখন ৯ বিঘায় ড্রাগন ফল চাষ করছেন। যেহেতু রবিউল করিমের ড্রাগন ফল চাষের অনুপ্রেরণা আমার তৈরি প্রতিবেদন, তাই তার খুব ইচ্ছা আমি যেন তার বাগানটা একটু দেখে আসি।

গত মে-র শেষ সপ্তাহে রবিউল করিমের বাগান দেখার সুযোগ হয়েছিল। এমনিতেই নাটোরে উচ্চমূল্যের ফল-ফসলের চাষ অনেক আগে থেকেই তরুণ উদ্যোক্তাদের হাত ধরে প্রসারিত হচ্ছিল। আম তো আছেই, তার সঙ্গে পেয়ারা, কুল এবং সাম্প্রতিক সময়ে ড্রাগন ফল চাষ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে গেছে। বলা চলে বাংলাদেশের ড্রাগন চাষের রাজধানী হয়ে উঠছে নাটোর।

রবিউল করিমের ড্রাগন ফল চাষের শুরুর গল্পটা শোনালেন। শিক্ষক মানুষ। ২০ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা। তাই কথা বলেন বেশ জোর দিয়ে। বললেন, ‘আমার মেয়ের পিইসি পরীক্ষার দিন এক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে ড্রাগন চাষের কথা শুনেছিলাম। আমি বাড়ি ফিরে ইউটিউবে ড্রাগন চাষ নিয়ে আপনার প্রতিবেদনগুলো একের পর এক দেখে নিলাম। সারা রাত বারবার আমি আপনার প্রতিবেদনগুলো দেখলাম। ঘুম চলে গেল। রাতেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম আমিও ড্রাগন ফলাব।’

রবিউলের সিদ্ধান্তটি যে ঠিক ছিল সে প্রমাণ মিলছে তার কৃষি উদ্যোগ দেখে। ৯ বিঘা জমিতে ড্রাগন চাষ করে গ্রামে রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছেন। কথায় বলে, যতনে রতন মেলে। রবিউলের ক্ষেত্রেও হয়েছে তাই। খুব বুঝেশুনেই কৃষির মাঠে পা ফেলছেন তিনি। ড্রাগন ফলের খেত যেন তার স্কুল আর এখানে কোনো মাস্টারি নয়, বরং মনোযোগী ছাত্রের মতোই শিখে শিখে এগোচ্ছেন। তিনি বলছেন, তার সাফল্যের মন্ত্রই এটা।

‘দেখলাম ড্রাগন ফলের ফুল ফোটে রাতে। ফুলে সপরাগায়ণে যে ফল হয় তার আকার ছোট। আবার ফুল ফোটার পর যদি বৃষ্টি হয় তাহলে পোলেনটা ধুয়ে যায়। ফলে ফল আসে না। তাই রাতে এসে ফোটা ফুল থেকে পোলেনটা সংগ্রহ করে হস্তপরাগায়ণের মাধ্যমে চেষ্টা করি প্রতিটি ফুল থেকেই ফল পাওয়ার।’ বলছিলেন রবিউল করিম। দেখলাম হস্তপরাগায়ণের জন্য নিজস্ব একটা কৌশল তৈরি করে নিয়েছেন। বুঝলাম তিনি ক্রমেই ড্রাগন চাষের শিক্ষার্থী থেকে শিক্ষক হয়ে উঠছেন।

রবিউল করিমের বাগানের প্রতিটি গাছই খুব সজীব। একই গাছে ফুল, কুঁড়ি, ফল আছে। অর্থাৎ একটি গাছ থেকেই ধারাবাহিকভাবে ফল পাওয়া যাবে একের পর এক। রবিউল বললেন, প্রতিটি গাছ থেকেই সারা বছর ফল পাওয়া সম্ভব। এমনকি শীতকালেও ফলবে। তিনি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন, ‘স্যার, জানুয়ারিতে আইসেন, দেখবেন কোনো বাগানে ফল না থাকলেও আমার বাগানে ড্রাগন থাকবে ইনশা আল্লাহ।’ বললাম, তা না হয় বুঝলাম। আপনি যে কৌশলে বারো মাস ড্রাগন ফলাচ্ছেন সে কৌশলটা কী?

বললেন, ‘কৌশল বুঝে করলে চাষ, ফলবে ড্রাগন বারো মাস’। ভালো চারা সংগ্রহ করার বাইরে তিনটি কৌশল তিনি অবলম্বন করেছেন। এক. তিনি নিয়ম মেনে প্রæনিং করেছেন প্রতিটি গাছে। অনুকূল পরিবেশ পেলে গাছ নতুন কুশি আর কুঁড়ি ছাড়ে। তিনি কুঁড়িটাকে নিয়েছেন, কুশি ছেঁটে দিয়েছেন। দুই. পর্যাপ্ত সেচের ব্যবস্থা করেছেন। তিনি বললেন, ড্রাগনের ভালো ফলন পেতে সেচটা হতে হবে পর্যাপ্ত। বেশিও না, কমও না। যে সময়টাতে বৃষ্টি থাকে না, তাপমাত্রা থাকে বেশি, প্রখর সূর্যের তাপ। সে সময়টাতে তিনি প্রতিটি গাছের গোড়ায় কচুরিপানা দিয়ে দেন। এটা যেমন আর্দ্রতা ধরে রাখে, তেমনই সেচের পানিটাকেও ফিল্টারিং করে।

বললাম, দুটি কৌশল তো বললেন। তৃতীয়টা কী? জানালেন তৃতীয় কৌশল। প্রতিটি গাছের গোড়াকে তিনি মাটি থেকে একটু উঁচুতে রেখেছেন। প্রতিটি গাছেই পর্যাপ্ত জৈবসার এবং কিছুটা রাসায়নিক সার প্রয়োগ করেন। আমি বললাম, আপনার কৌশল মূলত তিনটি না, চারটি। আপনার হস্তপরাগায়ণও একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। তিনি হাসলেন। প্রতিটি উদ্যোগেই থাকে বিনিয়োগের প্রশ্ন, থাকে লাভ-ক্ষতির হিসাব। এ উদ্যোগের লাভের হিসাবও বেশ সচেতনভাবেই কষে নিয়েছেন উদ্যোক্তা। প্রায় প্রতিদিনই ফল সংগ্রহ হয়। বাগান থেকেই ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করে দিচ্ছেন। ক্রেতারা দূরদূরান্তের। কক্সবাজার, চট্টগ্রাম থেকেও অর্ডার আসে ফোনে। লাভের হিসাবে বেশ লাভেই আছেন রবিউল। বাগান আরও বড় করবেন। আরও হাজারখানেক পিলার কিনেছেন। জমিও তৈরি হচ্ছে। বললাম, ১ বিঘায় ড্রাগন বাগান করতে কী পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ তার একটা খসড়া হিসাব দিন। তিনি বললেন, ১ বিঘা জমিতে খুঁটি পড়বে ২১০টি। একটি খুঁটির দাম ৪০০ টাকা। প্রতি খুঁটিতে অ্যাঙ্গেল বার ৫০ টাকা। টায়ার ৭৫ টাকা। ড্রাগন ফলের চারা প্রতিটি ৬০ টাকা দরে খুঁটিপ্রতি পাঁচটি চারার দাম ৩০০ টাকা। জৈবসার ২৫ থেকে ৩০ টাকা। রাসায়নিক সার ৬০ থেকে ৭০ টাকা। অর্থাৎ খুঁটিপ্রতি খরচ প্রায় ১ হাজার টাকা। এ হিসাবে ১ বিঘা জমিতে ড্রাগন ফল চাষে ২ লাখ ১০ হাজার টাকা শ্রমিক খরচ ছাড়াই প্রাথমিক বিনিয়োগ করতে হবে।

আমার পরামর্শ হচ্ছে প্রথমেই বড় বিনিয়োগে না গিয়ে ছোট আকারে ড্রাগন চাষের কৌশল ও পদ্ধতিগুলো রপ্ত ও ভালো করে যাচাই-বাছাই করে ক্রমে বড় বিনিয়োগের দিকে যাওয়া। বুঝেশুনে কৃষিতে বিনিয়োগ করে শ্রম দিলে লাভ আসবেই। লাভ পেলে লাভের অংশ শ্রমিকদের দিতে কার্পণ্য করে না কৃষক। এমন একটি মধুর সময়ের মুখোমুখি হয়েছিলাম রবিউলের খামারে। তিনি তার বাগানের শ্রমিকদের বেতন বাড়িয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিলেন। বুঝলাম রবিউল মানুষ হিসেবেও উদার। তাই প্রকৃতিও তাকে উদার হাতে ফলন দিচ্ছে।

রবিউল বললেন, ‘আপনিই তো শিক্ষিত তরুণদের কৃষিতে যুক্ত হতে বলেন। তাই আমি আমার কয়েকজন ছাত্রকে আমার সঙ্গে নিয়েছি। আমিও চাই আগামীর শিক্ষিত প্রজন্মই হাল ধরুক আধুনিক কৃষির।’ দেখলাম রবিউল সত্যি সত্যি শিক্ষক হয়েও ড্রাগন ফল চাষের মাঠে সতীর্থ করে নিয়েছেন তার কয়েকজন ছাত্রকে। কথা বললাম তাদের সঙ্গেও। তারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। ছুটির এ সময়টাতে তার সঙ্গে থেকে শিখে নিচ্ছেন ড্রাগন চাষের কলাকৌশল। তাদের স্বপ্ন রচিত হচ্ছে কৃষি ঘিরে। পৃথিবীর যে কোনো দুঃসময়ে কৃষকই হয়ে ওঠেন সভ্যতার মূলশক্তি। কৃষক শ্রমে-ঘামে পৃথিবীর বুক চিরে ফলিয়ে আনেন সোনার ফসল। তার উৎপাদিত ফল-ফসলেই মূলত মানুষের জীবন রঙিন হয়ে ওঠে। আর রবিউলের মতো কৃষি উদ্যোক্তারা রঙিন করে তুলছেন আমাদের কৃষি অর্থনীতি। আর সেই রং ক্রমে ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।  

ইমেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর