মা, মাটি, মাতৃভূমি, মাতৃভাষা তথা শিকড়ের টানে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনাময়ী উপমহাদেশের বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী ইমেরিটাস প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম (জে এন ইসলাম) নিজভূমে চলে এসেছিলেন। এ যেন অনেকটা তীরে এসে তরী ডোবানো গল্পের মতো নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গ ছেড়ে স্বদেশের টানে ছুটে আসা। জামাল নজরুল ইসলাম ১৯৩৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বাবার কর্মস্থল ঝিনাইদহে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা খান বাহাদুর মুহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম, মা রাহাত আরা বেগম। তাঁর বাবা ছিলেন পেশায় মুন্সেফ, মা লেখক, নাট্যকার ও কবি। জামাল নজরুল ইসলামরা চার ভাই ও চার বোন।
বাবার চাকরির সুবাদে জামাল নজরুল ইসলামের বয়স যখন ১ তখন খান বাহাদুর মুহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম বদলি হয়ে কলকাতা শহরে পাড়ি জমান। তাঁর হাতেখড়ি কলকাতার মডেল স্কুলে। তিনি কলকাতা শিশু বিদ্যাপীঠে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। বাবা চট্টগ্রামে বদলি হয়ে এলে ১৯৪৭ সালে তিনি চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। ছোটবেলা থেকেই মেধার স্বাক্ষর রাখেন তিনি। স্কুলে তাঁর রেজাল্ট দেখে শিক্ষকরা মুগ্ধ হয়ে ডাবল প্রমোশন দিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করেন। কলেজিয়েট স্কুলে নবম শ্রেণিতে অধ্যয়নের সময় তিনি এসএসসি ও এইচএসসির গণিত বিষয়ে বেশ পারদর্শী হয়ে ওঠেন। খুব সহজে গণিত ও জ্যামিতিক সমস্যাগুলোর সমাধান করেন। বাবার চাকরির সুবাদে আবার চলে যেতে হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। সেখানে তিনি যে বোডিং স্কুলে ভর্তি হন তার নাম লরেন্স স্কুল। লরেন্স স্কুল থেকে তিনি সিনিয়র ক্যামব্রিজ বা ‘ও লেভেল’ এবং হায়ার ক্যামব্রিজ বা ‘এ লেভেল’ পাস করেন। পরে কলকাতার বিখ্যাত সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে বিএসসি পাস করেন। তাঁকে একটি সম্মানসূচক বৃত্তি দেওয়া হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের শিক্ষক ফাদার সোরে জামাল নজরুলকে ডাকতেন জীবন্ত কম্পিউটার বলে। অন্য বিজ্ঞানীরা যেখানে কম্পিউটার, ক্যালকুলেটর নিয়ে কাজ করতেন সেখানে তিনি নিজ বুদ্ধিতে বড় বড় হিসাবগুলো মুহূর্তে করে দিতেন। তিনি বলতেন কম্পিউটার আমার কাছে অপ্রয়োজনীয়, তবে কম্পিউটারের সাধারণ প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করেননি। পরে তিনি গণিত বিষয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য বিলেতে পাড়ি জমান।
১৯৫৭ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তিনি গণিতে ট্রাইপজে তিন বছরের কোর্স দুই বছরে শেষ করেন। ১৯৬০ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাস করে ১৯৬৪ সালে প্রায়োগিক গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ছাত্রজীবন থেকে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন বিস্ময়কর বিজ্ঞান-প্রতিভা স্টিফেন হকিং। ১৯৬৩ থেকে ’৬৫ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরাল ফেলো ছিলেন জামাল নজরুল।
১৯৬৭ থেকে ’৭১ সাল পর্যন্ত ক্যামব্রিজ ইনস্টিটিউট অব থিওরেটিক্যাল অ্যাস্ট্রোনমিতে গবেষণায় যোগ দেন। ১৯৭১ থেকে ’৭২ সাল পর্যন্ত দুই বছর ক্যালটেক বা ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে ভিজিটিং অধ্যাপক হিসেবে অধ্যাপনা শুরু করেন। তাঁর সম্পর্কে বলতে গিয়ে স্টিভেন হকিং বলেছিলেন- ‘জে এন ইসলাম আমার রুমমেট, আমরা ছিলাম পরস্পর বন্ধু এবং পরস্পরের শিক্ষক।’ ১৯৬০ থেকে ’৮০ সাল পর্যন্ত হকিং যেসব বিজ্ঞানীকে নিয়ে গবেষণা করেন জে এন ইসলাম ছিলেন তার অন্যতম। জগদীশচন্দ্র বসু প্রথম রেডিও আবিষ্কার করলেও কৃতিত্ব চলে গিয়েছিল মার্কনির কাছে। তেমনটিই ঘটেছে জে এন ইসলামের ক্ষেত্রেও।
জামাল নজরুল ইসলাম ১৯৭৩-৭৪ সাল পর্যন্ত লন্ডনের কিংস কলেজ ফলিত গণিতের শিক্ষক, ১৯৭৫-৭৮ সাল পর্যন্ত কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে সায়েন্স রিসার্চ ফেলো এবং ১৯৭৮ থেকে ’৮৪ সাল পর্যন্ত লন্ডনে সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। ৩০ বছরের অভ্যস্ত জীবন, সম্মানজনক পদ, গবেষণার অনুকূল পরিবেশ, বিশ্বনন্দিত নোবেলজয়ী গুণীজন সাহচর্য এবং লাখ টাকার লোভনীয় চাকরি ছেড়ে দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে শিকড়ের টানে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। অল্প বেতনে ১৯৮১ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে যোগদান করেন। তাঁর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা করা হয় রিসার্চ সেন্টার ফর ম্যাথমেটিক্যাল অ্যান্ড ফিজিক্যাল সায়েন্স বা গণিত ভৌত বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র। যার বর্তমান নাম ‘জামাল নজরুল ইসলাম গণিত ও ভৌত বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র’। অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি পরিবেশ, সামাজিক-সাংস্কৃতিক, নাগরিক আন্দোলনসহ সামাজিক দায়বদ্ধতার জন্য নিরন্তর কাজ করে গেছেন। গরিব-মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের প্রতি ভালোবাসার হাত বাড়িয়েছেন।
ভৌতবিজ্ঞানী ইমেরিটাস প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলামের লেখা ‘দি আলটিমেট ফেইট অব দি ইউনিভার্স’ ছিল তাঁর প্রথম এবং শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। বইটি ১৯৮৩ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়। বইটি ৩০টি দেশের ভাষায় অনূদিত হয়। পৃথিবী বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বইটি পাঠ্যবই হিসেবে গৃহীত হয়। এ ছাড়া তাঁর উল্লেখযোগ্য বইগুলো হলো- ‘রোটেটিং ফিল্ডস ইন জেনারেল রিলেটিভিটি’, ‘অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু ম্যাথমেটিক্যাল কসমোলজি’, ‘ক্লাসিক্যাল জেনারেল রিলেটিভিটি’, ‘অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু ম্যাথমেটিক্যাল ইকোনমিক্স অ্যান্ড সোশ্যাল চয়েস’, ‘কনফাইনমেন্ট অ্যান্ড স্রোডিঙ্গার ইকুয়েশন ফর গাউস থিওরিস’, ‘অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু ম্যাথমেটিক্যাল ইকোনমিক্স’ ইত্যাদি। তাঁর বন্ধু নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী আবদুস সালাম, ওয়েনবার্গ, জোসেফসন, ফ্রিম্যান ডাইসন, রিচার্ড ফাইনম্যান, সুব্রাহ্মনিয়াম চন্দ্রশেখর, অমর্ত্য সেন এবং অমিয় বাগচী, জয়ন্ত নারলিকর, ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জিম মার্লিস, স্টিফেন হকিং, রজার পেনরোজ, জ্যা অ্যান্দুজ, মার্টিন রিজ, লুইস জনসন, হোয়েল, জন টেইলর, জ্যাজ ওয়ান প্রমুখ।
তিনি স্মিথস প্রাইজ, পদ্মভূষণ, অ্যাডামস প্রাইজ, একুশে পদক, বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি স্বর্ণপদক, জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পদক, থার্ড ওয়ার্ল্ড একাডেমি লেকচার পদক লাভ করেন।
লেখক : প্রাবন্ধিক।