সোমবার, ২২ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

বিপন্ন কাইকলা মাছ ও সৎ মানুষের আকাল

মহিউদ্দিন খান মোহন

বিপন্ন কাইকলা মাছ ও সৎ মানুষের আকাল

কাইকলা মাছের সঙ্গে পরিচয় নেই এমন কাউকে আমাদের দেশে অন্তত খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। শুদ্ধ বাংলায় এটাকে বলা হয় ‘কাকিলা মাছ’। কোথাও আবার ‘কাইক্কা’ নামে পরিচিত। আমাদের বিক্রমপুর অঞ্চলে এটি কাইকলা নামেই সমধিক পরিচিত। সুচালো মুখে সারি সারি ছোট অথচ তীক্ষè দাঁতসংবলিত এ মাছটি দেশের নদ-নদী, খাল-বিল, পুকুর-ডোবায় এক সময় প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত। ভোজনরসিক অনেকেরই এ মাছটি অত্যন্ত প্রিয়। কাঁচামরিচ-পিঁয়াজ সহযোগে এর চচ্চরি কিংবা তেলে ভেজে এর ভর্তা খাবার টেবিলে এক উপাদেয় আইটেম। অনেকের মতো আমিও এ মাছের ভক্ত। ছেলেবেলায় আশ্বিন-কার্তিক মাসে এ মাছের সমারোহ দেখা যেত গ্রামের খালবিলে। আমরা ছাতার শিক দিয়ে বানানো টেঁটায় এদের শিকার করতাম। আবার খালের ভেঁশালেও উঠত অনেক কাইকলা। এ কাইকলা মাছের একটি অম্লমধুর স্মৃতি রয়েছে আমার ছেলেবেলার। এক সকালে আমাদের গ্রামের খালে পাতা ভেঁশাল থেকে মাছ কিনে বাড়ি ফিরছিলাম। বাড়ির সামনে দেখা হলো আমার এক চাচা আজম খানের সঙ্গে। সে বয়সে দু-তিন বছরের বড় আমার চেয়ে। তবে চলাফেরা একসঙ্গে। আচরণও বন্ধুসুলভ। আমার হাতে মাছের ডুলা (বাঁশ-বেতের তৈরি হাতলওয়ালা এক ধরনের পাত্র) দেখে বলল, ‘বাহ দারুণ মাছ তো! কাইকলাগুলো বেশ বড়! বড়টার লেজে ধরলেই ডিম পাড়ব’। বালক আমি না বুঝেই কাইকলা মাছের ডিম দেখার লোভে যেই ওটার লেজ ধরে ওপরের দিকে তুলেছি, অমনি সেটা বাঁকা হয়ে ঘুরে আমার হাতের আঙুলে বসিয়ে দিল তার তীক্ষè দাঁত। আর্তনাদ করে হাত চপে ধরলাম। আসন্ন ভর্ৎসনার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আজম কাকা ‘দে হাওয়া চাগিয়ে কাপড়’। সারা দিন হাতের ব্যথায় ভুগেছিলাম।

সেই কাইকলা বা কাকিলা মাছ এখন খুব একটা দেখা যায় না। না খালে-বিলে, না বাজারে। দেশীয় কাইকলার পরিবর্তে ইদানীং সামুদ্রিক কাইকলা দেখা যায় বাজারে। মাস দুয়েক আগে পত্রিকায় দেশীয় কাইকলার বিপন্ন প্রায় প্রাণীতে পরিণত হওয়ার খবর পড়েছিলাম। খবের বলা হয়েছে- মিঠা পানির এ সুস্বাদু মাছটি নানা প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে বিপন্নপ্রায় প্রজাতিতে পরিণত হয়েছে। তাই আমাদের মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষকরা চেষ্টা করছেন খামারে এর উৎপাদনের পদ্ধতি উদ্ভাবনের। তারা নাকি সে প্রচেষ্টায় অনেকটা সফলও হয়েছেন। তাদের প্রচেষ্টা সফল হলে আগামীতে কই শিং মাগুর রুই কাতলা পাবদার মতো কাইকলা মাছও পুকুরে চাষ করা যাবে। এতে এ সুস্বাদু দেশীয় মাছটি বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পাবে এবং যারা এ মাছটি খেতে পছন্দ করেন তাদের হতাশাও কেটে যাবে। বিজ্ঞানের ক্রমোন্নতির ফলে এমন অনেক প্রাণীকেই বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষার উপায় উদ্ভাবিত হয়েছে। এর ফলে প্রকৃতির জীববৈচিত্র্য রক্ষাও অনেকটাই সহজসাধ্য হয়ে উঠছে।

এ প্রাকৃতিক জগতের অন্যান্য জীবের মতো মানুষও একটি প্রজাতি। তবে মানুষের সৃষ্টি নিয়ে মতভেদ আছে। আমরা যারা সৃষ্টিকর্তা ও ধর্মে বিশ্বাসী তারা বিশ্বাস করি আল্লাহ রাব্বুল আলামিন হজরত আদম (আ.) ও বিবি হাওয়াকে প্রথম মানব-মানবী হিসেবে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছিলেন। আর বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদ তত্ত্ব মতে পৃথিবীর জন্মের পর প্রাকৃতিক বিভিন্ন বিবর্তনের একপর্যায়ে বানর থেকে মানুষের অভ্যুদয়। তবে ধর্মে বিশ্বাসীরা ডারউইনের এ থিওরিকে অবাস্তব বলেই উড়িয়ে দেন। আশির দশকের মাঝামাঝিতে মাওলানা মীর হাবীবুর রহমান যুক্তিবাদী এক মাহফিলে ডারউইনের থিওরিকে মিথ্যা বলে আখ্যায়িত করে বলেছিলেন, বানর থেকে যদি মানুষ সৃষ্টি হয়, তাহলে এখনো বনে-বাদারে, চিড়িয়াখানায়, এমনকি ঢাকার গেন্ডারিয়ায় সাধনা ঔষধালয়ের কারখানায় যেসব বানর আছে সেগুলো একটাও ক্যান মানুষ হইল না? মাওলানা যুক্তিবাদীর এ প্রশ্নের জবাব দিতে কেউ আগ্রহী হননি। ডারউইন বেঁচে থাকলে কী বলতেন সেটা তো আমাদের জানার কথা নয়। তবে সৃষ্টির রহস্য নিয়ে আমাদের মতো সীমিত জ্ঞানের মানুষদের কথা না বলাকেই আমি শ্রেয় মনে করি।

আল্লাহর সৃষ্ট ১৮ হাজার মাখলুকাতের মধ্যে মানুষকে বলা হয় ‘অশরাফুল মাখলুকাত’- মানে সৃষ্টির সেরা জীব। মানুষের এ শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষিত হয়েছে নানা কারণে। তার মধ্যে প্রধান কারণ- মানুষ বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন জীব। অন্য অনেক প্রাণীরই বুদ্ধি আছে, কিন্তু তাদের বিবেক নেই। বুদ্ধির কারণে তারা পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে হয়তো বেঁচেবর্তে থাকতে পারে। তবে ন্যায়-অন্যায়বোধ তাদের নেই। এ বিবেক তথা ন্যায়-অন্যায়বোধই মানুষের সঙ্গে অন্য প্রাণীর মধ্যে প্রধান পার্থক্য। সেই মানুষের মধ্যে এখন অনেক শ্রেণি-বিভাগ দেখা যায়। এ শ্রেণি বিভাজনের মধ্যে সৎ মানুষ আর অসৎ মানুষ দুটি প্রধান ভাগ। সমাজে এক সময় এমন বিভাজন হয়তো ছিল না। একটি সময় ছিল যখন অসৎ বা দুর্নীতিপরায়ণ মানুষ ছিল দুর্লভ। মানুষ আবার অসৎ হবে কেন- এমন ধারণাও নাকি এক সময় মানুষের মধ্যে ছিল। মানুষ তো মানুষ। তার আবার প্রকারভেদ থাকবে কেন? মানুষ হিসেবে যার জন্ম, আকৃতিগতভাবে যেমন, প্রকৃতিগতভাবেও তিনি মানুষ হবেন এটাই স্বতঃসিদ্ধ কথা। কিন্তু এখন সময় বদলেছে। এখন সমাজে অসৎ আর দুর্নীতিপরায়ণ মানুুষের প্রাধান্য বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। বলা যায় অসৎ মানুষেরা প্রাধান্য বিস্তার করে আছে সর্বক্ষেত্রে। এক সময় আমাদের দেশের মানুষ ভেজাল পণ্য কী তা জানত না। আর এখন পণ্য উৎপাদনকারী বা বিপণন কর্তৃপক্ষকে রীতিমতো বিজ্ঞাপন দিয়ে দাবি করতে হয় তাদের পণ্যটি ‘পিওর’ অর্থাৎ খাঁটি। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান তো তাদের পণ্যের নামই রেখেছে পিওর। ভেজালের বিপুল সমারোহে এ নামকরণের কারণটি অবোধগম্য নয়। তবে প্রশ্ন হলো- পিওর নামের ওই পণ্যটি কতটা পিওর। আমার বন্ধু নাজমুল আলম ভূঁইয়া নিজাম দুই দশক ধরে সুইডেন প্রবাসী। একবার দেশে আসার সময় সেখান থেকে সে নিয়ে এলো ঘি। জিজ্ঞেস করলাম ঘি খাঁটি কিনা। সে বলল, সুইডেনে ‘খাঁটি’ কোনো জিনিস পাবেন না। তার মানে সব ভেজাল! আমার বিস্ময়মাখা প্রশ্নের জবাবে সে বলল, আপনি যদি ওখানে দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন জিনিসটি খাঁটি কিনা, দোকানি অবাক হয়ে আপনাকে দেখবে। ভাববে আপনি কোন গ্রহ থেকে এসেছেন। কারণ ওদের কাছে পণ্য মানে পণ্য। পণ্যে ভেজাল দেওয়া যায় এটা ওরা জানেই না। আর আমরা একটি পণ্য খাঁটি কিনা তা কখনোই নিশ্চিত হতে পারি না। আসলে ভেজালের আগ্রাসনে আমরা আসল জিনিস থাকতে পারে সে কথা যেন ভুলেই গেছি। প্রবীণ রাজনীতিক শফি বিক্রমপুরী গল্প বলতে ওস্তাদ। তেমনি একটি গল্প শোনালেন একদিন। এক ছাত্রহোস্টেলে ঘি সাপ্লাই দেয় এক গোয়ালা। সে তার ঘিয়ে ভেজাল দিত। কিন্তু ছাত্ররা সেই ঘি খেয়েই অভ্যস্ত। একবার কোনো একটি উৎসব উপলক্ষে ঘি সাপ্লাই দিতে হবে। গোয়ালা ভাবল- সারা বছর তো ভেজাল ঘি দিই, এবার না হয় খাঁটি ঘি দিই। সেই ঘিয়ের তৈরি খাদ্য খেয়ে ছাত্ররা পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হলো। সপ্তাহখানেক পরে যখন গোয়ালা এসে জিজ্ঞেস করল, ঘিটা কেমন ছিল, ছাত্ররা তার ওপর হামলে পড়ল। বলল, ব্যাটা, সারা বছর খাঁটি ঘি খাওয়াইয়া এ উৎসবে তুই ভেজাল খাওইয়ালি! তখন গোয়ালা বলল, ভাইয়েরা, আসলে সারা বছর আমি আপনাগো ভেজাল ঘি খাওয়াই। এবারই খাঁটি দিছিলাম। বুঝছি, খাঁটি ঘি আপনাগো পেটে সইব না।

আমাদের এ সমাজে এখন আসল মানুষরা বিরল প্রাণীতে পরিণত হতে চলেছে- এ আশঙ্কা সমাজসচেতন ব্যক্তিদের। সর্বত্র নকলের দাপট। আমি সমাজবিজ্ঞানী নই। রাজনীতিই আমার লেখা এবং বলার প্রধান বিষয়। সেই রাজনীতিতে আসল মানুষ কি আর আছে? নেই এ কথা বলা বোধকরি সংগত হবে না। আসল অর্থাৎ সৎ রাজনীতিকরা এখনো আছেন। তবে অসৎদের দাপটে তারা কোণঠাসা। তারা কোনোক্রমে মান-মর্যাদা বাঁচিয়ে চলেন নীরবে-নিভৃতে। তারা কথাও বলেন কম। কেননা তারা জানেন, অসৎদের কলরবে তাদের কণ্ঠ কেউ শুনবে না। কেবল রাজনীতি নয়, সমাজের সব ক্ষেত্রে আজ অসৎ আর দুর্নীতিবাজদের প্রবল দাপট। সরকারি অফিসে যান দেখতে পাবেন অসৎদের দোর্দণ্ড প্রতাপ। আর যারা সৎ তারা ঘাড় গুঁজে চুপচাপ কাজ করে যাচ্ছেন। তারা এতটাই সংখ্যালঘিষ্ঠ যে, চোখের সামনে দুর্নীতির মহোৎসব দেখেও তার প্রতিবাদ বা প্রতিরোধে সাহসী হন না।

সমাজে ভালো মানুষের আকাল দেখা দিয়েছে বলে সচেতন ব্যক্তিরা আক্ষেপ করেন। তাদের এ আক্ষেপ অমূলক নয়। যদি জরিপ করা হয় দেখা যাবে সমাজ থেকে সৎ মানুষের সংখ্যা ক্রমাগত কমছে। এর কারণ কী তা নিয়ে বিশেষ কোনো গবেষণা এখনো পর্যন্ত হয়নি এটা ঠিক। তবে সমাজবিজ্ঞানীদের মতে মানুষের মধ্যে আত্মকেন্দ্রিকতা, স্বার্থপরতা এবং লোভ-লালসা বেড়ে যাওয়ায় সৎ মানুষের সংখ্যা ক্রমশ কমে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক পরিবেশের নানা ধরনের পরিবর্তন বা বিপর্যয়ের কারণে যেমন কাইকলাসহ অন্যান্য অনেক মাছ ক্রমশ বিপন্ন প্রাণীতে পরিণত হচ্ছে, তেমনি সামাজিক নানা প্রতিকূল পরিবেশের কারণে সৎ মানুষের সংখ্যাও দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। যদি বলা হয়- সমাজে সৎ মানুষেরা এখন বিপন্ন প্রাণীর শ্রেণিভুক্ত তাহলে খুব একটা অযৌক্তিক হবে বলে মনে হয় না। কিন্তু বড় প্রশ্ন হলো, কেন সৎ মানুষ কমে যাচ্ছে? বিজ্ঞজনেরা এ জন্য প্রয়োজনীয় নৈতিক শিক্ষার অভাবকেই দায়ী করতে চান। তাদের মতে, মানুষের যখন শিক্ষা গ্রহণের সময় অর্থাৎ বাল্যকাল থেকে তাদের আগের মতো নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার গরজ কেউ খুব একটা অনুভব করেন না। ফলে সমাজে উচ্চ ডিগ্রিধারীর সংখ্যা বাড়লেও সুশিক্ষিত ও নৈতিকতাসম্পন্ন মানুষ তৈরি হচ্ছে না। চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াস বলেছেন, ‘পরিবার হচ্ছে একজন মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান’। দ্বিমতের অবকাশ নেই তাঁর এ কথার সঙ্গে। বিদ্যায়তনে মানুষ পুস্তকভিত্তিক শিক্ষা পেতে পারে। কিন্তু নৈতিক শিক্ষা সে পায় পরিবার থেকেই। পরিবারের অভিভাবকদের আচার-আচরণ, কাজকর্ম শিশুর মনে যে ছাপ ফেলে তা-ই ভবিষ্যতে তার চরিত্র গঠনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। যে শিশু জ্ঞান হওয়ার পরই দেখে তার পিতা অবৈধ পথে উপার্জন করে বিত্তশালী হচ্ছে, তার মনে তখন এ কথাটি রেখাপাত করে যে ওটাই বুঝি সঠিক পথ। এভাবেই সমাজে দুর্নীতি-অনৈতিকতার বিষবৃক্ষ তার ডালপালা বিস্তার করে চলেছে। ছেয়ে ফেলছে আমাদের সমাজকে।

প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার মরহুম আমজাদ হোসেনের ‘দুই পয়সার আলতা’ ছবিতে মিতালী মুখার্জির কণ্ঠে একটি গান আছে- ‘এই দুনিয়া এখন তো আর সেই দুনিয়া নাই/ মানুষ নামের মানুষ আছে দুনিয়া বোঝাই/ এই মানুষের ভিড়ে আমার সেই মানুষ নাই...’। গানের কথাগুলোর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে পুনর্বার বলার দরকার পড়ে না। এই যে এত কোটি কোটি মানুষ, কিন্তু তাদের মধ্যে আমাদের কাক্সিক্ষত সেই মানুষ কোথায়? বিপন্ন কাইকলা মাছের প্রাচুর্যকে মৎস্য গবেষকরা হয়তো আবার ফিরিয়ে আনতে পারবেন। কিন্তু সমাজে সৎ মানুষ যে বিপন্ন প্রজাতিতে পরিণত হচ্ছে, এ সর্বনাশা প্রবণতা রোধ করার উপায় কী?

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক।

সর্বশেষ খবর