শুক্রবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

উম্মতের কল্যাণকামিতায় নির্যাতিত বিশ্বনবী

মুফতি রুহুল আমিন কাসেমী

উম্মতের কল্যাণকামিতায় নির্যাতিত বিশ্বনবী

মহান রব্বুল আলামিন ওই ব্যক্তিকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন যে অন্যের কল্যাণ কামনা করে, এমনকি তাঁর সমগ্র সৃষ্টির কল্যাণ কামনা করাও অত্যন্ত নেকির কাজ। অন্যের দোষত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখা, ক্ষমতার বলে দুর্বলের প্রতি অত্যাচারের হাত সম্প্রসারণ না করা, মুখের ভাষায় গালিগালাজ করে কারও মনে আঘাত দিয়ে অপমান-অপদস্থ না করা, বরং প্রতিশোধ গ্রহণ না করে আল্লাহর ওয়াস্তে সবাইকে ক্ষমা করে দিয়ে তাদের জন্য হেদায়েতের দোয়া করাই একজন মুসলমানের ইমানের দাবি। হজরত মুহাম্মদ (সা.) মানবতার কল্যাণ ও মুক্তির জন্য এ ধরার বুকে প্রেরিত হয়েছিলেন। জন্মলগ্নে সুবহে সাদিকের সেই প্রথম আগমনীতেই তিনি কেঁদেছিলেন উম্মতের জন্য। মৃত্যুর সময়ও তিনি উম্মতের কথা ভুললেন না, তিনি কেঁদেছিলেন উম্মতের জন্য। নবুয়তের ২৩ বছরের সময়টুকু ছিলেন তিনি উম্মতের জন্য ব্যাকুল বেকারার। উম্মতের কল্যাণ ও নাজাত কামনায় তিনি হু হু করে কাঁদতেন। মানুষকে শিরক-কুফরির অন্ধকার থেকে আলোর পথে আহ্বান করতেন। আল্লাহর দাসত্বের প্রতি দাওয়াত দিতেন। ক্ষুব্ধ হয়ে মক্কার লোকেরা নবীজির প্রতি বর্ণনাতীত অত্যাচারে জর্জরিত করত। আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে দিত। গালিগালাজ, অপমান-অপদস্থতায় এতিম নবীকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে দিত। সব দুঃখ-কষ্ট সয়ে নিয়ে, হাসিমুখে বড় আশা-আবেগ নিয়ে আবারও ফিরে যেতেন মানুষের কাছে। তিনি যে রহমাতুল্লিল আলামিন, বিশ্বমানবতার সর্বোচ্চ কল্যাণকামিতার জন্যই তিনি প্রেরিত হয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা জাহান্নামের দ্বারপ্রান্তে ছিলে, সেখান থেকে তিনি তোমাদের কোমর ধরে পেছনে টেনে নিয়ে এলেন।’ সুরা বাকারা। কেননা তাঁকে উম্মতের প্রতি দরদ, মায়া, ভালোবাসা ও কল্যাণকামিতায় ভরপুর করে দেওয়া হয়েছিল। রসুল (সা.) বলেন, ‘আমাকে এত বেশি কষ্ট দেওয়া হয়েছে, এত উৎপীড়ন ও নির্যাতন, অপমান-অপদস্থ করা হয়েছে যে এ রকম কষ্ট অন্য কোনো নবীকেও দেওয়া হয়নি।’ একজন সাহাবি বলেন, ‘ইসলাম কবুলের আগে আমি মূর্খতার অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিলাম। সে সময় একদিন দেখলাম একজন লোকের চারদিকে বহলোক ভিড় করে রয়েছে। তিনি নিজেদের হাতে গড়া সব অসার দেবদেবী ও মূর্তিপূজা ছেড়ে দিয়ে এক আল্লাহর ইবাদতের প্রতি আহ্বান করেছিলেন। পাথরের আঘাতে সুন্দর মুখ থেকে রক্ত বেরোচ্ছিল। হঠাৎ এক ব্যক্তি এসে তাঁর মুখে থুথু নিক্ষেপ করল। অন্য একজন এসে তাঁর জামা ছিঁড়ে ফেলল। কেউ একজন তাঁর মাথায় মাটি নিক্ষেপ করল। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করছে। তা দেখে বাচ্চারা পাগল পাগল বলে ঠাট্টাবিদ্রƒপ করে হাসছে।’ তায়েফের ময়দানে রসুলকে সীমাহীন কষ্ট দেওয়া হয়েছিল একটি বর্ণনায় পাওয়া যায় দীর্ঘ ৬ মাইল পর্যন্ত জনতা পাথর নিক্ষেপ করে ধাওয়া করেছিল। পাথরের আঘাতে নবীজি জমিনে পড়ে যেতেন, দাঁড়ানোর পর আবারও তাড়া করত। তায়েফে তাঁকে এত বেশি নির্যাতন করা হয়েছিল যে তাঁর শরীর রক্তাক্ত এবং জুতা পায়ের সঙ্গে লেগে গিয়েছিল। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, তায়েফের জমিনে নবীজির প্রতি অত্যাচারের দৃশ্য দেখে আকাশের ফেরেশতারাও চিৎকার করে কেঁদে ছিলেন। প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে হজরত জিবরাইল গজবের ফেরেশতাসহ নবীজির কাছে অনুমতি প্রার্থনা করেছিলেন। কিন্তু দয়ার নবী ফেরেশতাদের হাসিমুখে ফিরিয়ে দিয়ে, তায়েফবাসীকে ক্ষমা করে রব্বুল আলামিনের কাছে তাদের জন্যই হেদায়েতের দোয়া করলেন। তিনি বললেন, ‘হে রব্বুল আলামিন! তায়েফবাসী আমাকে চিনতে পারেনি, না চিনে না বুঝে তারা আমাকে কষ্ট দিয়েছে, তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে আজাব নাজিল কোর না, তাদের দয়া করে ক্ষমা করে দাও। একদিন তারা বুঝবে, তোমার প্রতি ইমান আনবে, নবীকে ভালোবাসবে, নবীর জন্য কেঁদে বুক ভাসাবে।’ তাই তো তায়েফবাসী নিজেদের কৃত অপরাধের কথা স্বীকার করে আজও নবীজির জন্য পাগলপারা হয়ে কেঁদে বুক ভাসায়। কখনো কখনো দীনের দাওয়াত শেষে এসে দেখতেন, ঘরের সামনে মক্কাবাসী তাদের যাবতীয় ময়লা-আবর্জনা, উটের দুর্গন্ধময় পচা নাড়িভুঁড়ি তাঁর দরজার সামনে ফেলে রেখে এসেছে। নবীজি কুরাইশদের এ রকম অত্যাচার করতে নিষেধ করতেন। তিনি বলতেন, ‘হে কুরাইশবাসী! যদি ভালো বন্ধু হতে না চাও তবে অন্তত ভালো প্রতিবেশী হয়ে থাক। তবু এভাবে আমাকে অত্যাচার কোর না, কষ্ট দিও না।’ এত নির্যাতন সত্ত্বেও কারও প্রতি তাঁর কোনো অভিযোগ ছিল না, কষ্ট ছিল না, সবাইকে তিনি ক্ষমা করে দিতেন, সবার জন্য হেদায়েতের দোয়া করতেন, সবার মঙ্গল কামনা করতেন। কারণ তিনি যে উম্মতের দরদি নবী।

লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক। ইমাম ও খতিব, কাওলারবাজার জামে মসজিদ, দক্ষিণখান, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর