বৃহস্পতিবার, ২০ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

স্মৃতির পাতায় : বিবেকের পথচলা

বিচারপতি মো. রেজাউল হাসান (এম আর হাসান)

স্মৃতির পাতায় : বিবেকের পথচলা

একসময় ‘দ্য ঢাকা কুরিয়ার’-এ মাঝেমধ্যে লেখা পাঠাতাম। তারা ছাপাতেন। বাংলাদেশে শাস্তি হিসেবে ‘মৃত্যুদন্ড’ থাকবে কি থাকবে না এ বিষয়ে ১৯৯০-এর প্রথম দিকে পত্রিকাটি একটি লিখিত বিতর্কের আয়োজন করে। এ বিষয়ে বেশ কয়েকটি লেখা ছাপা হয় বিশিষ্টজনদের। আমি ভেবেছিলাম আমার লেখাটি নির্বাচিত হয়নি। পরে দেখলাম আমার লেখাটি দিয়েই তারা উপসংহার টেনেছিলেন। এর শিরোনাম ছিল Capital punishment is morally Socially and legally justified. এটি ছাপা হয় ‘দ্য ঢাকা কুরিয়ার’-এর মার্চ ৯-১৫, ১৯৯০ সংখ্যায়। আমার বক্তব্যের সারমর্ম ছিল : যদিও বাংলাদেশের অনেক আইনে (ওই লেখায় উদ্ধৃত করেছি) কতিপয় অপরাধের জন্য শাস্তির বিধান ছিল মৃত্যুদন্ড, তথাপিও ওইসব অপরাধ সংঘটনের হার সেভাবে হ্রাস পায়নি। ফলে শাস্তি হিসেবে ‘মৃত্যুদন্ড’ ওইসব অপরাধ নিবারণের ক্ষেত্রে তেমন প্রতিরোধকের ভূমিকা পালন করতে পারেনি। কারণ, আমার মতে, এসব গুরুতর অপরাধ করলেও শাস্তি পেতে হবে এমন কোনো নিশ্চয়তা না থাকা। এ ছাড়া আমি উল্লেখ করেছি, ১৩ ডিসেম্বর ১৯৮৯ সালে আরিফ হত্যাকারীদের মৃত্যুদন্ড চেয়ে ওই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা একটি মিছিল করেন। হত্যা-খুন এ রকম অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের ফাঁসি চেয়ে পোস্টার করা ও দেয়াল লিখন- এগুলোও ব্যাপকভাবে দেখা যেত। ফলে আমার যুক্তি ছিল : মৃত্যুদন্ড রাখার ক্ষেত্রে আমাদের সমাজের মূল্যবোধ ও আইনের মূল্যবোধ একই (values of the society is in harmoney with the values of law)। যুক্তরাজ্য ১৯৬৫ সালে প্রথমে মৃত্যুদন্ড রদ আইন করে, অস্থায়ীভাবে। পাঁচ বছরের জন্য। তারা এটি স্থায়ী করে ১৯৭০ সালে। কিন্তু তাদের শিক্ষা, সামাজিক মূল্যবোধ, শিক্ষার হার এবং মাথাপিছু আয় ইত্যাদি নানা মৌলিক বিষয়ের সঙ্গে আমাদের অবস্থার তফাত রয়েছে। এসব মানদন্ডে আমরা অনেকটাই অনগ্রসর। ফলে আমি প্রস্তাব করেছিলাম, ওইসব মানদন্ড অর্জনের আগেই কেবল কাউকে অনুকরণ করে বাহবা নেওয়ার জন্য ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দিয়ে সমাজব্যবস্থাকে অনিরাপত্তার দিকে ঠেলে দেওয়া উচিত নয়।

১৯৯১-৯২ সালের আরেকটি ঘটনা। ‘সংবাদচিত্র’ নামক একটি রাজনৈতিক সংবাদধর্মী সাপ্তাহিক তখন কাকরাইলের ফরিদপুর ম্যানশন থেকে প্রকাশিত হতো। এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ওই সময় চট্টগ্রাম অঞ্চলে কর্মরত বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার এজাজ মাহমুদ। একই প্রকাশকের আরেকটি সাপ্তাহিক পত্রিকা ছিল ‘অপরাধচিত্র’। ওয়াহিদ মুরাদসহ এদের কয়েকজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ওই সময় চট্টগ্রাম শহরের কোতোয়ালি থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বাদী হয়ে চট্টগ্রাম সিএমএম কোর্টে একটি মামলা দায়ের করেন। এজাজ মাহমুদের অনুরোধে আমি সাংবাদিকদের জামিনের আবেদন করি এবং শুনানি করি। চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব থেকে ব্যানার লাগিয়ে একটি মাইক্রোবাসে করে অভিযুক্ত সাংবাদিকরা আসেন। বিজ্ঞ আদালত তাদের জামিন দেয়। যদিও আমি ওই আদালতের নিয়মিত আইনজীবী নই। আমি মূলত উচ্চতর আদালতেই প্র্যাকটিস করতাম। যা হোক, এ সুবাদে এজাজ মাহমুদের সঙ্গে আমার সখ্য বৃদ্ধি পায়। তিনি ১৯৯২ সালে শোকাবহ ১৫ আগস্ট উপলক্ষে এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী, এম এ মান্নান, ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী (বাবুল) এবং আমার একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। ওই সাক্ষাৎকারে আমি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়েছি। আমি স্পষ্ট করে দিয়েছি যে ওই ষড়যন্ত্রের শুরু ১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে। ওই সাক্ষাৎকারে আমি ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ ১৯৭৫ কেন সংবিধান পরিপন্থী তা ব্যাখ্যা করি এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠাকল্পে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার দাবি করি। কারণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায়ই একজন নেতৃত্ব নেবেন বা নেতৃত্ব থেকে চলে যাবেন, অন্য কোনো প্রক্রিয়ায় নয়।

যা হোক, পরে একটি মানবাধিকার সংস্থার হয়ে চট্টগ্রাম বিশেষ জজ আদালতে ওই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেছিলাম। ওই সময় স্পেশাল জজ ছিলেন আমার পরম শ্রদ্ধাভাজন ইফতেখার রসুল (ওই সময় চট্টগ্রামের জেলা দায়রা ও বিশেষ আদালতের জজ। পরে হাই কোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারপতি থাকাকালে ইন্তেকাল করেন)। এ মামলার ধারাবাহিকতায় ওই কর্মকর্তা বরখাস্ত হয়েছিলেন।

অন্য একটি ঘটনা বেশ মনে পড়ে। ১৯৯৬-এ আমি ভোরের কাগজে একটি লেখা পাঠিয়েছিলাম। ওই সময় নির্বাচন কেন্দ্র করে বিরোধী দল থেকে রাজপথে ব্যাপক মিছিল-মিটিং ও সমাবেশ করা হচ্ছিল। এ ধরনের কর্মসূচির ফলে গণআন্দোলনের মুখে ১৯৯১ সালে অর্জিত এবং পুনর্জন্ম গ্রহণ করা গণতান্ত্রিক ধারা ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। ফলে নিয়মতান্ত্রিক একটি রাজনৈতিক ধারা সৃষ্টি ও প্রতিষ্ঠিত হোক এ লক্ষ্যে আমি লিখেছিলাম, সাধারণ নির্বাচন প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের ভোটের ভিত্তিতে হয়ে থাকে। এই নির্বাচনে রাষ্ট্রপতির যেমন একটি ভোট, তেমনি একজন পরিচ্ছন্নতা কর্মীরও একটি ভোট। এরূপ একটি সাংবিধানিক সমতা ও সমঅধিকারের ভিত্তিতে যে নির্বাচন হয় সেটিকে সভা-সমাবেশ বা মিছিল-মিটিং করে প্রশ্নবিদ্ধ করা হলে তা একদিকে যেমন নির্বাচিত সরকারকে আস্থার সংকটে ফেলবে, তেমনি সামাজিক স্থিতিশীলতা ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করবে এবং সরকারের স্বাভাবিক কার্যক্রমকেও বাধাগ্রস্ত করবে (যে দলই সরকারে থাকুক না কেন)। এ ছাড়া, এটি হবে সংবিধানের বিধি-বিধান ও ফয়সালাকে অস্বীকার করার বা গৌণ করে দেখার শামিল, যা কারও ক্ষেত্রেই অভিপ্রেত নয়। বিশেষ করে যখন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১২৫ নম্বর অনুচ্ছেদে এরূপ নির্বাচনী বিতর্কের মীমাংসার জন্য আদালত ও প্রতিকারের বিধান রাখা হয়েছে। আদালতে বিচার্য প্রতিটি বিষয়ে আদালতের মাধ্যমেই সুরাহা হওয়া উচিত। এর বিকল্প কিছু কাম্য নয়। ফলপ্রসূও নয়। যেহেতু নির্বাচন হয় কোনো না কোনো আইনের বিধান অনুযায়ী, সেহেতু বিশ্বের প্রতিটি দেশেই নির্বাচনী বিতর্ক ট্রাইব্যুনাল বা আদালতের মাধ্যমে নিষ্পত্তির বিধান রাখা হয় এবং আদালতের মাধ্যমেই নিষ্পত্তি হয়। এমনকি ২০০০ সালে আমেরিকার প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচনে ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যে ভোট গণনা বিতর্কের অবসান হয় আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টে ‘George W. Bush and Al Gore’ এ মামলায় প্রদত্ত রায়ের মাধ্যমে। আদালতের এ ধরনের রায় বিশ্বব্যাপী কার্যকর ও সবার জন্য বাধ্যতামূলক বটে।

যা হোক আমার এ লেখার পরে ৫ জুলাই ১৯৯৬ তারিখে বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক ভোরের কাগজে প্রকাশিত ‘পঞ্চ রোমাঞ্চ’ নামক কলামে আমার এ মতামত উদ্ধৃত করেন এবং লিখেন- ‘এটা ভোরের কাগজকে অবহিত করেছেন সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট এম আর হাসান। তাঁকে ধন্যবাদ’ এবং তাঁর লেখায় উদ্ধৃত করেন, ‘বাংলাদেশ সংবিধানের ১২৫(খ) অনুচ্ছেদে বলা আছে : সংসদ কর্তৃক প্রণীত কোনো আইনের দ্বারা বা অধীন বিধান-অনুযায়ী কর্তৃপক্ষের নিকট এবং অনুরূপভাবে নির্ধারিত প্রণালিতে নির্বাচনী দরখাস্ত ব্যতীত রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন বা সংসদের কোনো নির্বাচন সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।’

আনিসুল হকের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় বা সাক্ষাৎ হয়নি, যদিও তাঁর সময়োপযোগী ও প্রাঞ্জল লেখার আমি একজন নিয়মিত পাঠক ছিলাম। এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সবর্জনসমাদৃত আবুল মোমেন ভাইকে স্মরণ না করে লেখাটি সমাপ্ত করা যায় না। তিনি ১৯৯৭ সালে বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রে ১৫ আগস্ট উপলক্ষে আয়োজিত একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে আমাকে আমন্ত্রণ করেন। আমরা তিনজন ছিলাম। অন্য সুধীজনের কথা আমার স্মরণ নেই। আবুল মোমেন ভাই ওই সময় সম্ভবত দৈনিক ভোরের কাগজ দৈনিকটির চট্টগ্রাম ব্যুরোপ্রধান ছিলেন। বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ। মোমেন ভাইকে দেখেছি একই চেতনার আরেকজন মানুষ। এ রকম মানুষই এ দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ। হয়তো বা তাঁরা নীরব জনতার অংশ। যা হোক, মোমেন ভাইয়ের সঙ্গে আমার শেষ দেখা ১৯৯৭-১৯৯৯, কোনো একসময়। কর্মজীবন এবং পরে (২০২০-২০২১) করোনা মহামারি অনেকের মধ্যেই সামাজিক দূরত্ব তৈরি করেছে। কিন্তু আমাদের মনোজগতে কোনো দূরত্ব তৈরি করতে পারেনি। সেটাই হোক আমাদের আনন্দ, সাহস আর বেঁচে থাকার প্রেরণা।

 

লেখক :  বিচারপতি, হাই কোর্ট বিভাগ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।

সর্বশেষ খবর