বুধবার, ২৬ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

দরকার আবরাহাম লিঙ্কনের ‘সেই সরকার’

মেজর আখতার (অব.)

দরকার আবরাহাম লিঙ্কনের ‘সেই সরকার’

যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সুদীর্ঘ ১৫০ বছরের লাগাতার সহিংস সংগ্রামে যে অগণিত যোদ্ধা জীবন দিয়েছিল তাদের আত্মত্যাগের সম্মানে গ্যাটিসবার্গের অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট আবরাহাম লিঙ্কন বলেছিলেন,   that government of the people, by the people, for the people, shall not perish from the earth. এ চিরন্তন ভাষণের বাংলা অনুবাদ আমরা সবাই জানি। আমরা এও জানি এবং বিশ্বাস করি, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সরকারকে অবশ্যই জনগণের মধ্য থেকে জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। কিন্তু আজ গণতন্ত্র এমন এক অলঙ্ঘনীয় কল্পিত ধারণা হয়ে গেছে যে উত্তর কোরিয়ার মতো চরম স্বৈরতন্ত্রবাদী সরকার নিজেদের Democratic Peoples Republic of Korea বলে পরিচয় দেয়! উত্তর কোরিয়ার মতো বিশ্বের অনেকে নিজেদের গণতান্ত্রিক সরকার বলে গলাবাজি করে। গণতন্ত্রের মূল যে জনগণ সেই দেশের জনগণের নির্লিপ্ততার জন্যই বিভিন্ন দেশের চরম স্বৈরাচারী সরকারগুলোও জঘন্যতম নির্লজ্জের মতো নিজেদের গণতান্ত্রিক সরকার বলে দাবি করতে পারছে। জনগণের নির্লিপ্ততার সুযোগে অনেক ঐতিহ্যবাহী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সরকারও চরমভাবে স্বৈরাচারী হয়ে যাচ্ছে। শুধু ভোট দিতে পারাই গণতন্ত্র নয় বা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বিদ্যমান বলা যাবে না।

আমাদের দেশে একসময় ‘হ্যাঁ’-‘না’ ভোট হয়েছিল অর্থাৎ শাসকের পক্ষে হ্যাঁ এবং বিপক্ষে না ভোট দেওয়ার জন্য নির্বাচন হয়েছিল। হ্যাঁ বা না ভোটের পরে ওই সরকার কি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার হয়ে গিয়েছিল? উত্তর অবশ্যই ছিল ‘না’! ১৯৪৭ সালে গণভোটের মাধ্যমে বাংলা ও পাঞ্জাবকে ভাগ করে এক অংশ ভারতকে এবং এক অংশ পাকিস্তানকে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। লুটেরা সাম্রাজ্যবাদী ও রাজতন্ত্রবাদী ভারতের ব্রিটিশ সরকার ভারত থেকে চলে যেতে বাধ্য হয়ে তখন কি তথাকথিত গণভোটের মাধ্যমে গণতান্ত্রিকভাবে বাংলা ও পাঞ্জাবকে বিভক্ত করে ভারত ও পাকিস্তানকে বিলিয়ে দিয়ে গেছে? উত্তর অবশ্যই ‘না’। সম্প্রতি ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার জন্য যেখানে বেরিয়ে গেলে কী সুবিধা হবে তার বিতর্কিত তথ্যের ওপর ব্রিটিশ জনগণকে ভোট দিতে বলা হয়েছিল তা কি গণতান্ত্রিক ছিল? উত্তরে এখন অনেকেই বলছেন ‘না’। গত ২০ বছরে ইরাক ও আফগানিস্তানে যেসব নির্বাচন হয়েছিল ওইগুলো কি গণতান্ত্রিকভাবে হয়েছে বলা যাবে? উত্তর অবশ্যই ‘না’।

চীন ও রাশিয়ায়ও নির্বাচনের মাধ্যমেই সরকার গঠিত হচ্ছে। সেখানেও নির্দিষ্ট সময়ের পর নির্বাচন হয় এবং যথারীতি সরকারের মেয়াদ বাড়ে। চীন ও রাশিয়ার সরকারও আবরাহাম লিঙ্কনের সংজ্ঞামত জনগণের মধ্য থেকে জনগণের জন্যই প্রতিষ্ঠিত সরকার। তারা আবার এক ধরনের নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে কি বর্তমান চীন ও রাশিয়ার সরকারকে গণতান্ত্রিক বলা যাবে? উত্তর এখানেও দেখা যাচ্ছে ‘না’!

আমাদের দেশে প্রতিটি রাজনৈতিক দলেই ঘটা করে সম্মেলনের মাধ্যমে বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটি ও কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করে। বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা আবার ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত করার নাটকও হয়। সেখানে প্রথমে কাউন্সিল করা হয় এবং নেতার নির্বাচিত ব্যক্তিদের শুধু সেই কাউন্সিলে রাখা হয় যার ফলে নেতা সেভাবেই গদিনশিন হন। সবাই নাটকটা খুব ভালো করে বোঝে কিন্তু কায়েমি স্বার্থে চুপ মেরে থাকে! সব বেটা শেয়ানা! একটি ক্ষুদ্র অংশ ছাড়া কেউ ঝুঁকি নিতে চায় না! তবে এখানেও বলা হচ্ছে, দলের নেতা গণতান্ত্রিকভাবেই নাকি নির্বাচিত হচ্ছেন!

সরকার গঠনের প্রক্রিয়া নিয়েই মূলত গণতন্ত্রের মূল সমস্যা সম্ভবত সৃষ্টি হয়েছে বলে অনেকের ধারণা। আবরাহাম লিঙ্কনের বক্তব্যটি সবাই কেন জানি বিকৃত করে ফেলছে! তাঁর বক্তব্যের শুরু ছিল সেই সরকার ‘that government’ জনগণের মধ্য থেকে, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য হলে, পৃথিবী থেকে ধ্বংস হয়ে যাবে না। আবরাহাম লিঙ্কন কিন্তু বলেননি, ‘সরকার জনগণের মধ্য থেকে বা জনগণের দ্বারা বা জনগণের জন্য নির্বাচিত হতে হবে।’ তিনি সরকারের তিনটি শর্ত উল্লেখ করেছেন, যে সরকার শর্ত তিনটি পালন করতে পারবে সে সরকার সম্ভবত পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে না। এখন বিভিন্ন দেশ এ তিনটি শর্তের মধ্যে দুটি খুব জোরেশোরে পালন করছে এবং একটিকে বাদই দিয়ে দিচ্ছে তা হলো ‘জনগণের দ্বারা’ নির্বাচিত হওয়ার শর্ত। আর যে দুটিকে পালন করছে তা হলো ‘জনগণের মধ্য থেকে’ ও ‘জনগণের জন্য’। এখন জনগণের দ্বারা সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তা সম্ভবত ফুরিয়ে গেছে। জনগণও এখন সরকার গঠনে তেমন আগ্রহী নয়। জনগণের প্রায় সবাই এখন কোনো না কোনো দলে ভিড়ে গেছে। এমনকি রাষ্ট্রের কর্মকর্তা-কর্মচারী যাদের নিরপেক্ষ থাকার কথা তারাও প্রায় সবাই দলের উচ্ছিষ্ট খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। জনগণের অতি ক্ষুদ্র অংশ দলমুক্তভাবে তাদের স্বাধীন বিবেক নিয়ে অতিনীরবে সুন্দর ভবিষ্যতের আশায় জীবন কাটাচ্ছে তবে তাদের চিন্তা-চেতনায় আবার ভিনদেশি প্রভাব অনেক বেশি।

জনগণের দ্বারা সরকার নির্বাচিত বা গঠিত হওয়ার সম্ভাবনা দিন দিন ক্ষীণ হয়ে আসছে। একটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও এলাকার বা ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে নির্বাচনের ফলাফল নিজের কবজায় রাখতে চান। সেখানে ক্ষমতাসীন সরকার নির্বাচনে জনগণের ভোটে হেরে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে সেই নির্বাচন হবে বলে যারা মনে করে তারা যে ভাবের রাজ্যে আছে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। নির্বাচিত কোনো সরকারকে ভোটের মাধ্যমে কখনই পরিবর্তন করা সম্ভব নয় যদি না শক্তিশালী কোনো তৃতীয় পক্ষ সরকারের বিপক্ষে কাজ করে। যতক্ষণ পর্যন্ত রাজনৈতিক নেতারা জনগণের ওপর সত্যিকার বিশ্বাস ও আস্থা রাখতে না পারবেন ততক্ষণ গণতন্ত্র অবশ্যই গভীর সংকটের মধ্যে থাকবে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আবশ্যিক পূর্বশর্ত সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন এবং এ ধরনের নির্বাচনের জন্য অবশ্যই জনগণকে বিশ্বাস করতে হবে এবং আস্থায় নিতে হবে। এজন্য অবশ্যই জনগণকে সম্মানও করতে হবে। সে সম্মান শুধু যারা ভোট দিয়ে জেতাবে তাদেরই নয়, যারা বিপক্ষে ভোট দেবে তাদেরও সমভাবে সম্মান করতে হবে। সরকার শুধু যারা পক্ষে ভোট দিয়েছে তাদের জন্য কাজ করবে কিন্তু যারা সরকারকে ভোট দেয়নি সেই জনগণের জন্য কাজ না করলে সে সরকার কখনই গণতান্ত্রিক সরকার হতে পারে না। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সরকারকে অবশ্যই জনগণের জন্য কাজ করতে হবে এবং জনগণ মানে রাষ্ট্রের সবাই। পক্ষে ভোট দিল কি বিপক্ষে দিল তা গণতান্ত্রিক সরকারের কাজ করার ক্ষেত্রে বিবেচনার সুযোগ রাখে না। সরকার সব সময় জনস্বার্থে কাজ করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। তা ছাড়া যখন জনগণের ভোটের মাধ্যমে সরকার গঠিত হয়নি অর্থাৎ জনগণের দ্বারা সরকার গঠিত হয়নি তখন সেখানেও সরকারকে শতভাগ ‘জনগণের জন্য’ কাজ করতে হবে। ‘জনগণের জন্য’ কাজ করার শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলে অবশ্যই সে সরকার ক্ষমতায় থাকার নৈতিক যোগ্যতা হারায়। একে তো সরকার জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হয়নি তার ওপর আবার সব জনগণের জন্য কাজ করবে না সে সরকারকে যে কোনো মূল্যে প্রতিহত করা জনগণের জন্য নাগরিক দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়।

জনগণ যাতে তার ভোটাধিকার প্রয়োগসহ সব নাগরিক দায়িত্ব সঠিক ও সুষ্ঠুভাবে পালন করতে পারে সেজন্য সব নাগরিককে প্রয়োজনীয় সব তথ্য জানাতে এবং তথ্য জানার অধিকার সরকারকে যতটুকু সম্ভব অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। গণতন্ত্র হলো রাষ্ট্র পরিচালনার সাংঘর্ষিক ব্যবস্থাপনা যেখানে প্রতিনিয়ত বিভিন্নমুখী মত ও পথের সঙ্গে আপস করে বিভিন্ন পার্থিব স্বার্থ বিভিন্ন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা গোত্র বা দেশি ও বিদেশি প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে আপসের মাধ্যমে বিলিবণ্টন করা। সরকারের ওপর বিভিন্নমুখী চাপ ও আক্রমণাত্মক চাহিদা থাকবে কিন্তু সরকার কখনই রাগ, অনুরাগ বা বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে কোনো কাজ করতে পারবে না। সরকার হয়তো জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হয়নি যার ফলে সরকারের ওপর জনগণের ক্ষোভ বা রাগ বা বিদ্বেষ থাকতে পারে; কিন্তু গণতান্ত্রিক সরকার অবশ্যই সদাসর্বদা শুধু জনগণের জন্যই কাজ করতে বাধ্য। কাজেই সরকারের কাজের সঙ্গে অবশ্যই জনগণের সম্পৃক্ততা ও ঐকমত্য থাকতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে অবশ্যই সে সরকার সন্দেহাতীতভাবে স্বৈরাচার হয়ে যেতে বাধ্য। এজন্য সরকারের সব কাজে জনসম্পৃক্ততা থাকা অতীব জরুরি। তবে জনসম্পৃক্ততা মানে দলের লোকদের সম্পৃক্ততা বোঝাবে না। কারণ দলের লোক সরকারেরই অংশ। জনসম্পৃক্ততা মানে হলো সরকার ও সরকারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ও সরকারি দলের বাইরের জনগণ যেখানে সরকারবিরোধীরাও থাকবে। তাহলে অবশ্যই সরকার গণতান্ত্রিক হবে। তবে দেশের তাবৎ জনগণকে যদি সরকার তার কবজায় নিয়ে নিতে পারে তাহলে সেখানে কারও কোনো আপত্তির সুযোগ অবশ্যই থাকবে না।

জনগণের প্রত্যাশা এবং মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা গণতান্ত্রিক পরিবেশে দেশ শাসিত হবে। অতীতে বিভিন্ন কারণে সেই সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশ গড়ে ওঠেনি তার জন্য অবশ্যই আমরা সব রাজনীতিবিদই দায়ী। আমাদের রক্তের ওপর দিয়ে সুযোগ নিয়েছে দেশি-বিদেশি কায়েমি স্বার্থবাদীরা তাদের স্বার্থে রাষ্ট্র চালাতে। সেজন্য জনগণ তার অব্যাহত সংগ্রাম জারি রেখেছে। জনগণের প্রত্যাশা রাষ্ট্র ও সরকারকে গণতান্ত্রিক করতে হবে এবং তা করতে হবে আমাদের মতো রাজনীতিবিদদেরই। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা নিশ্চিত রাখতে হলে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিকল্প আমাদের সামনে নেই। আমরা হয়তো অনগ্রসর ও আধুনিক শিক্ষার কিছুটা অভাবের কারণে কাক্সিক্ষত পর্যায়ে সুষ্ঠু, অবাধ বা নিরপেক্ষ নির্বাচন আশা করতে পারি না ফলে হয়তো সত্যিকারভাবে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা এককভাবে আমাদের নিজেদের পক্ষে করা খুব দুঃসাধ্য হয়ে যায়। ফলে কাক্সিক্ষত নির্বাচনের জন্য বিদেশিদের সাহায্য নিতে হয় কিন্তু বিদেশিরা আবার তাদের নিজেদের স্বার্থে কোনো আপস করে না। তবে জনগণের ঐকান্তিক কামনা দেশে অন্তত একটি প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন হোক যেখানে তারা স্বাধীনভাবে নিজের ভোটটা দিয়ে তার রাষ্ট্রের মালিকানার অনুভূতিটি অনুভব করতে পারে। জনগণ আবরাহাম লিঙ্কনের সেই সরকার that government-এর প্রত্যশায় যে সরকারকে জনগণ ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে দেবে। জনগণের সেই স্বপ্ন পূরণে শাসক রাজনৈতিক দলের কাছেই তাই জনগণের দাবি এমন একটি নির্বাচনের যে নির্বাচনে তারা তাদের নিজের ভোট নিজে দিতে পারে। আগামী নির্বাচনে জনগণের সেই প্রত্যাশা পূরণ হবে- এ বিষয়ে সবাই কমবেশি আশাবাদী।

 

                লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য।

সর্বশেষ খবর