সোমবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে সরকার

মেজর আখতার (অব.)

নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে সরকার

বর্তমান জাতীয় সংসদের প্রথম সভা হয়েছিল ৩০ জানুয়ারি ২০১৯ সালে। সেই মোতাবেক বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ হবে ২৯ জানুয়ারি ২০২৪ সালে। সবকিছু ভালোভাবে চললে আগামী ২৯ অক্টোবর ২০২৩ সাল থেকে ২৯ জানুয়ারির যে কোনো দিন পরবর্তী সংসদের নির্বাচন হবে। নতুন নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে গঠিত হয়েছে। নতুন নির্বাচন কমিশন মঙ্গলবার ২৪ জানুয়ারি ২০২৪ সালে পরবর্তী নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ নির্ধারণ করে নির্বাচনী কর্মকান্ডের কর্মসূচি তৈরি করছেন বলে কানাঘুষা হচ্ছে। ২৪ জানুয়ারি ২০২৪ সালে পরবর্তী নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ হতেই পারে। কারণ সংবিধানের ১২৩(৩)(ক) মোতাবেক সংসদের মেয়াদ পূরণের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হতে হবে। তবে ২৪ জানুয়ারি অর্থাৎ সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার মাত্র ছয় দিন আগে নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ হলে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। যেহেতু এক্ষেত্রে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে, সেখানে হাতে মাত্র ছয় দিন রেখে নির্বাচনের দিনক্ষণ স্থির করা কেমন যেন ঝুঁকিপূর্ণ মনে হচ্ছে! অনেকে আগে থেকেই বলে আসছেন প্রধানমন্ত্রী বেজোড় সালে নির্বাচন করতে অনুৎসাহী! সবার সে ধারণার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতেই কি নির্বাচন কমিশন ২০২৪ সালে নির্বাচন করতে অতিআগ্রহ দেখাচ্ছে কি না সেটাই জনগণের সামনে প্রশ্ন হয়ে দেখা দিচ্ছে। তবে যে যাই বলুক আগামী সংসদ নির্বাচন ২০২৪ সালে হওয়ার সম্ভাবনা যেমন নেই তেমনি ২০২৩ সালেও হওয়ার সম্ভাবনাও অনেক কম! প্রধানমন্ত্রী ২০২৩ সালের আগে যে কোনো সময় নির্বাচন দিতে অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন বলে অনেকের ধারণা।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে কতগুলো দিনক্ষণ রয়েছে যেগুলো রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। আমি দিনক্ষণগুলো নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করতে চাই। প্রথমে আমি ইতিহাসের পাতা উল্টাতে চাই। ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাকিস্তান সফর। পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশন সংক্ষেপে ওআইসির দ্বিতীয় সম্মেলনে যোগদান করেন বঙ্গবন্ধু। ওই সম্মেলনে পাকিস্তান প্রথমে বঙ্গবন্ধুকে দাওয়াত করেনি। কিন্তু পরবর্তীতে বিভিন্ন আরব রাষ্ট্রের চাপে ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ সালে প্রথমে পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। তারপর মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত, আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ারি বুমেদিন, পিএলও নেতা ইয়াসির আরাফাতসহ সাতজন প্রতিনিধি বঙ্গবন্ধুকে আমন্ত্রণ জানাতে ব্যক্তিগতভাবে ঢাকায় আসেন এবং বঙ্গবন্ধুকে ওআইসি সম্মেলনে নিয়ে যান। পরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ভুট্টো তিন দিনের সফরে ২৭ জুন বাংলাদেশে আসেন।

আমাদের আগামী দিনের রাজনীতিতে কয়েকটি জন্মদিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন দেশমাতা খালেদা জিয়ার জন্মদিন-আগস্ট ১৯৪৫ এবং প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিন ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭। মাত্র দুই বছরের ছোট বড়। তার মানে উনারা একই প্রজন্মের যার ফলে উনাদের মধ্যে প্রচন্ডতম বৈরী সম্পর্ক। উনারা দুজন পরস্পর বন্ধু হলে তা হতো অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ ও মধুর। আর তা না হওয়াতে কী হয়েছে তা জাতি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।

তারপর আসি বঙ্গবন্ধুর অপর কন্যা এবং প্রধানমন্ত্রীর ছোট বোন সম্মানিতা শেখ রেহানার জন্মদিন নিয়ে। উনার জন্মদিন ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৫৫ অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে ৮ বছরের ছোট। এরপর আসি বিএনপি নেতা তারেক রহমানের জন্মদিন নিয়ে। উনার জন্মদিন ২০ নভেম্বর ১৯৬৭।

এই চারটি জন্মদিন গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় প্রথম দুজনের অবস্থান সাংঘর্ষিক। যার ফলে উনাদের মধ্যে পালাবদল আর সম্ভব নয়। প্রথমজনের অবস্থান এখন কঠিন পর্যায়ে এবং উনার সমসাময়িক সাথী বন্ধুও প্রায় বিলুপ্তির পথে। সময় এখন দ্বিতীয়জনের নিয়ন্ত্রণে। দ্বিতীয়জনের ইচ্ছা বা অনিচ্ছার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করছে তৃতীয়জনের রাজনৈতিক অবস্থান। এখানে সংঘাতের কোনো সুযোগ নেই। আছে শুধু ইচ্ছা এবং সমন্বয়। কিন্তু চতুর্থজনের রাজনৈতিক অবস্থান সম্পূর্ণ নির্ভর করছে তার সংগ্রাম করার সক্ষমতা ও বিচক্ষণতার ওপর। চতুর্থজনকে কেউ সহায়তা করবে না, কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে না। চতুর্থজনকে তার লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে আন্দোলন সংগ্রাম ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা নেই। তিনি তার সক্ষমতা দেখাতে পারলে সবাই তখন তার পেছনে কাতারবন্দি হয়ে যাবে। কারণ এটাই রাজনীতির চরম সত্য। রাজনীতিতে দুর্বলের সঙ্গে কেউ থাকে না।

এবার আসতে চাই একটি জটিল তারিখে। তারিখটি হলো ২৩ এপ্রিল ২০২৩ সাল। ওইদিন আমাদের রাষ্ট্রপতির মেয়াদ শেষ হবে। তার মানে এর আগেই নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করতে হবে। এখন সামনে চলে আসছে নতুন প্রশ্ন-কে হবেন আমাদের পরবর্তী রাষ্ট্রপতি? এবারের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনেক বেশি জটিল ও কঠিন সমস্যা সামনে আসবে বলে অনেকে মনে করেন। কারণ নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন পড়তে পারে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী কে হবেন-সেই প্রশ্নের মীমাংসা করা। কানাঘুষা শোনা যায় প্রধানমন্ত্রী আর এ পদে থাকতে চান না। প্রধানমন্ত্রী উনার রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ত্যাগ করে নতুন কাউকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দিলে তা হবে একটি বিপ্লবী রাজনৈতিক পদক্ষেপ। এ ধরনের পদক্ষেপ রাজনীতিতে অনেক বেশি ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। রাজনীতির নতুন মেরুকরণ হবে। দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার এক নতুন বিপ্লব ঘটে যাবে। দেশের প্রশাসনসহ সব পর্যায়ে অভাবনীয় ঝাকি লাগবে যা দেশকে নতুন করে জাগিয়ে তুলবে। বাংলাদেশকে নিয়ে বিশ্বকে নতুন করে ভাবতে হবে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের ভাবমূর্তির নতুন অবস্থান তৈরি হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের একজন অনুকরণীয় নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে শেখ হাসিনার নাম অমোছনীয় স্বর্ণাক্ষরে লেখা হবে।

তবে প্রধানমন্ত্রী যদি সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি একজন নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেবেন এবং নিজে রাষ্ট্রপতি হবেন। তাহলে বর্তমান রাষ্ট্রপতির মেয়াদ শেষে অন্য কাউকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করা যাবে না। কারণ যদি ২৩ এপ্রিল ২০২৩ সালের পরে অন্য কাউকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করা হয় তাহলে তিনি পরবর্তী পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকবেন। যা হয়তো ঝুঁকিপূর্ণও হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া এখন নতুন করে আরেকজন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনও অনেক বেশি জটিল হতে পারে।

রাজনীতিতে কোনো কিছুই স্থির নিশ্চিত নয় এবং স্থির থাকেও না। সবকিছু প্রচন্ড পরিবর্তনশীল। সময় এবং অবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আগাতে না পারলে রাজনীতিতে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। রাজনীতিতে কোনো কিছুতেই ঐকমত্য হয় না। ঐকমত্য হয় শুধু স্বার্থের বেলায়। স্বার্থ এক তো সবাই এক। সবাই রাজনীতিতে যার যার হিস্যা চায়। দিতে পারলে সবাই আছে আর না দিতে পারলে খালেদা জিয়ার মতো একা একা জেলের ঘানি টানতে হয়-যা চরম সত্য। কোনো কিছু দেওয়ার ক্ষমতা নেই তাই বেগম খালেদা জিয়া জেলের ঘানি টানছেন আর বাকিরা ফুরফুরে মেজাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে! দলের নেতৃত্বের ক্ষমতার জিয়নকাঠি যদি খালেদা জিয়া তাঁর নিজের হাতে রাখতেন তাহলে উনার আজকের এই অসহনীয় অবস্থা হতো না তা চোখ বন্ধ করে বলা যায়। ক্ষমতা এক অমোঘ শক্তি তা যার হাতে থাকে সেই-ই হয় ক্ষমতার নিয়ন্ত্রক-তা সরকারি দলে হোক বা বিরোধী দলেই হোক। সরকার অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে ক্ষমতার বাইরে রেখেছে যাতে দলের ওপর উনি উনার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। আমি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে পারি বন্দি খালেদা জিয়া যদি দলের চেয়ারম্যানের ক্ষমতা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের হাতে হস্তান্তর না করতেন তাহলে রাজনীতির অবস্থান আজকে অবশ্যই ভিন্নতর হতো। সরকার কোনো অবস্থাতেই খালেদা জিয়াকে একাকী করে ফেলতে পারত না। যাই হোক, যা হওয়ার হয়ে গেছে। বিএনপিকে এখন নতুন নেতৃত্ব নিয়ে নতুন করে শুরু করতে হবে যেখানে বাস্তবতার কারণেই বয়স্ক নেতাদের স্থান দেওয়া যাবে না। নতুন প্রজন্মের নেতাদের নিয়ে শুরু করতে হবে।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব বিএনপির মতো ভুল করবে না। তাই চলমান রাজনীতির প্রেক্ষাপটে বলা যায় ২৩ এপ্রিল ২০২৩-এর পরে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ছাড়া অন্য কারও রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ ২৩ এপ্রিল ২০২৩ সালে কাউকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করলে ২৪ জানুয়ারি ২০২৪ সালের নির্বাচনের পরে নতুন কাউকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ জটিল ও কঠিন হয়ে যেতে পারে। ফলে ২৩ এপ্রিল ২০২৩ সালের পরে ২৪ জানুয়ারি ২০২৪ সাল পর্যন্ত বর্তমান সংসদকেও টেনে নিয়ে যাওয়ার কোনো যৌক্তিকতা আছে বলেও অনেকে মনে করেন না। প্রধানমন্ত্রীকে ২০২২ সালের জুন বা জুলাইয়ের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে পরবর্তী রাষ্ট্রপতি কে হবেন এবং পরবর্তী সংসদ নির্বাচন কবে হবে। প্রধানমন্ত্রী যদি সত্যিই নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দিতে চান তাহলে এ বছরের শেষের দিকে সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচন দিতে হতে পারে। তার আগে সংবিধানে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন এনে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ, প্রধানমন্ত্রীর নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হওয়া ও নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করতে হবে। বিরোধী দল তখন কোণঠাসা হয়ে যাবে! সেই চিন্তা মাথায় রেখে ২০২৩ বা ২০২৪ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা না করে ২০২২ সালেই নির্বাচন হতে পারে সব দিক দিয়েই সুবিধাজনক!

আর যদি প্রধানমন্ত্রী ২০২৩ সালে নির্বাচন করতে রাজি থাকেন তাহলে সেই নির্বাচন হবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পরে ২০২৩ সালের জুন মাসে সংসদ ভেঙে দিয়ে। তবে সবকিছু নির্ভর করবে একমাত্র বিএনপির সক্ষমতার ওপর। রাজনীতি এখন বিএনপির কোর্টে। বিএনপি যদি সঠিকভাবে খেলতে পারে তাহলে সরকারের সব রাজনৈতিক চাল উলট-পালট হয়ে যাবে। জনগণের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। জনগণ পরিবর্তনের জন্য মুখিয়ে আছে। জনগণের আকুল প্রত্যাশা বিএনপি বাঁধভাঙা স্রোতের মতো রাস্তায় বেরিয়ে আসুক। হাওরের মতো সারা বাংলাদেশ বিএনপি প্লাবিত করে দিক। তাই সবার প্রত্যাশা একসঙ্গে সুর মেলানোর-বাঁধ ভেঙে দাও, বাঁধ ভেঙে দাও, বাঁ...ধ।

                লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য।

সর্বশেষ খবর