সোমবার, ২৭ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

নবীজির রওজা মোবারক জিয়ারত

মুফতি রুহুল আমিন কাসেমী

নবীজির রওজা মোবারক জিয়ারত

মদিনাতুন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বা নবীর শহর সোনার মদিনা, বিশ্বমুসলিমের সর্বোচ্চ ইমানি আবেগ-উচ্ছ্বাসের কেন্দ্রস্থল। মক্কার কুরাইশরা যখন সাইয়েদুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, মানবকুল শিরোমণি মোহাম্মদ (সা.)-কে নির্দয় নিষ্ঠুর আচরণ করে নিজ জন্মভূমি মক্কা মোকাররমা থেকে হিজরত করতে বাধ্য করেছিল, তখন যে পবিত্র ভূমি রাহমাতুল্লিল আলামিনকে তার কোলে আশ্রয় দিয়ে চিরধন্য হয়েছিল, সেই পবিত্র নগরীই হচ্ছে মদিনাতুল মুনাওয়ারা। তার পবিত্র দেহমোবারককে ধারণ করে আজও এ নগরী লাভ করেছে পৃথিবীর বুকে সর্বোচ্চ সম্মান ও জান্নাতের মর্যাদা। পবিত্র কোরআনে এ ভূমিকে আল্লাহতায়ালা আরদুল্লাহ (আল্লাহর ভূমি) বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ পবিত্র ভূমির প্রায় ১০০টি নাম কোরআন হাদিস ও ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে। মহানবী (সা.)-এর চরণ স্পর্শে ধন্য হয়েছে এর প্রতিটি অলিগলি, আকাশে বাতাসে মিশে রয়েছে তাঁর পবিত্র নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের সুবাস। মদিনার প্রতি নবী করিম (সা.)-এর এত অধিক পরিমাণ আকর্ষণ ছিল যে, কোনো সফর থেকে মদিনায় প্রত্যাবর্তনকালে উটের গতি বাড়িয়ে দিতেন, কারণ তখন তিনি মদিনায় প্রবেশের জন্য ব্যাকুল হয়ে যেতেন, মদিনায় পৌঁছে তার হৃদয় মন জোড়াত। তিনি চাদর না খুলেই বলতেন, আহ্! কী মনোরম প্রশান্তিময় তার আলো-বাতাস। গায়ে লেগে যাওয়া মদিনার ধুলাবালি যা তার মুখমন্ডলে এসে পড়ত, তা তিনি পরিষ্কার করতেন না। কোনো সাহাবি ধুলাবালি থেকে রক্ষার জন্য মুখ আবৃত্ত করলে তিনি তাদের নিষেধ করতেন এবং বলতেন মদিনার মাটিতে শিফা ও নিরাময় রয়েছে। তিনি বলেছেন- এ শহর পবিত্র, এটা গুনাসমূহকে বিদূরিত করে যেমনটা বিদূরিত করে হাপর লোহার মরিচাকে, (বোখারি)। তিনি মদিনার জন্য বরকতের ও রোগ মুক্তির দোয়া করেছেন। মদিনায় মসজিদে নববীতে রিয়াজুল জান্নাহ নামক স্থানটি জান্নাতের বাগান। ওহুদ পাহাড়টি জান্নাতের পাহাড়। উহুদ পাহাড়ের কোল ঘেঁষে মসজিদে নববী, এখানেই সবুজ গম্বুজের নিচে শায়িত আছেন, প্রিয় নবী মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, হজরত আবু বকর, হজরত ওমর ও পাশেই জান্নাতুল বাকিতে হজরত উসমান, হজরত ফাতিমা রাদিয়াল্লাহু আনহুম ওয়া রাদুআনহুসহ অসংখ্য অগণিত সাহাবায়ে কেরাম। নবীজি এরশাদ করেন মদিনা আমার হিজরত স্থল, এখানেই আমার শয়ান স্থল, এখান থেকেই কিয়ামতের দিন আমার পুনরুত্থান হবে। আমার উম্মতের কর্তব্য আমার পড়শীদের হেফাজত ও সম্মান করা। তারা কবিরা গুনাহ থেকে দূরে থাকে। আমি তাদের সম্মান, হেফাজত ও সুপারিশকারী হব। নবীজি দুই হাত তুলে দোয়া করেছেন, হে আল্লাহ! যে আমার ও আমার নগরীর অনিষ্ঠসাধন করতে চায়, তুমি তার ধ্বংস ত্বরান্বিত কর। পবিত্র মদিনাকে আল্লাহতায়ালা দাজ্জালের ফিতনা থেকেও রক্ষা করবেন। নবীজির রওজা শরিফ জিয়ারত যে কত বড় পরম সৌভাগ্য ও শ্রেষ্ঠ সওয়াবের কাজ তা বর্ণনাতীত। তাই নবীজির রওজা জিয়ারত করাকে কোনো কোনো ফকিহ ওয়াজিব বলেছেন। নবীজি এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় আমার জিয়ারত করবে, কিয়ামতের দিন সে আমার আশপাশে থাকবে, (মিশকাত)। তিনি আরও বলেন, যে ব্যক্তি হজ করল এবং আমার মৃত্যুর পর আমার কবর জিয়ারত করল, সে যেন জীবদ্দশায় আমার সঙ্গেই সাক্ষাৎ করল। তিনি আরও বলেন যে ব্যক্তি মক্কার হজ সমাপন করে আমার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে আমার মসজিদে আসে, তার জন্য দুটি মকবুল হজের সওয়াব লিখিত হয়। তিনি আরও বলেন, যে ব্যক্তি দুনিয়াবী কোনো উদ্দেশ্য ব্যতীত শুধুমাত্র আমার জিয়ারতের উদ্দেশ্যে আমার নিকট আসে, কিয়ামতের দিন আমি তার জন্য সুপারিশকারী হব। নবীজি বলেন, আমার এ মসজিদে এক নামাজ, মসজিদুল হারাম ব্যতীত অন্য মসজিদে ১০০০ নামাজ আদায়ের চাইতেও উত্তম। কোনো কোনো বর্ণনায় তা ৫০,০০০ বলেও উল্লেখ রয়েছে। মদিনায় পৌঁছার পর দরুদ-সালাম, ভালোবাসা ও আবেগের মাত্রা বাড়িয়ে দিবেন। হাদিস শরিফে আছে, জিয়ারতকারী মদিনার নিকটবর্তী হলে রহমতের ফেরেশতাগণ তাকে অভ্যর্থনার জন্য এগিয়ে আসেন, এ সময় রওজা পাকের দিকে সর্বোচ্চ মনোযোগ, সর্বোচ্চ আদব, সর্বোচ্চ সম্মান, দুনিয়ার সবকিছু থেকে নিজেকে আলাদা করে নিজের চিন্তা চেতনায় নবীজির ভালোবাসায় একনিষ্ঠ হওয়া। নিজেকে উজাড় করে প্রেমাষ্পদের সঙ্গে সাক্ষাতের প্রতীক্ষার প্রহর গোনা। জুলহুলাইফা বা বীরেআলী নামক স্থানে পৌঁছলে, সম্ভব হলে অজু গোসল করে নতুন কাপড় পরিধান ও সুগন্ধি ব্যবহার করে দুই রাকাত নামাজ আদায় করা। অতঃপর সোনার মদিনার নগর প্রাচীর চোখে পড়া মাত্রই ভালোবাসা ও কান্না জড়িত কণ্ঠে দরুদ পাঠ করা শুরু করবেন। মনে রাখবেন আপনি যেখান দিয়ে হাঁটছেন, কদম রাখছেন, হয়তোবা আল্লাহর প্রিয় হাবিব সেখানেই কদম রেখেছেন, সেই পথেই হেঁটেছেন। তাই অত্যাধিক সম্মান, আদব ও বিনয় অবনত অন্তর নিয়ে ধীর স্থির কদমে এগিয়ে যাওয়া। অতঃপর সর্বপ্রথম মসজিদে নববীতে দোয়া পড়ে ডান পা রেখে অত্যন্ত বিনয় ও আদব সহকারে প্রবেশ করবেন এবং সম্ভব হলে রিয়াজুল জান্নাতে তাহিয়্যাতুল মসজিদ ও দুই রাকাত শুকরিয়া নামাজ আদায় করবেন এবং সর্বোত্তমভাবে আল্লাহর রসুলের রওজা জিয়ারত করার তৌফিক কামনা করবেন। অতঃপর বাবুস সালাম পথ ধরে নবীজির রওজার সামনে গিয়ে অত্যন্ত ভাবগম্ভীর পরিবেশে, সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা সম্মান ও ভালোবাসার আবেগে আপ্লুত হয়ে, মধ্যম আওয়াজে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সালাম পেশ করবেন। যদি কারও পক্ষ থেকে সালাম পৌঁছানোর দায়িত্ব থাকে, তাও পেশ করবেন। এখানে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে না থেকে অন্যদের সুযোগ দিয়ে সামনে এগিয়ে যান। অতঃপর নবীজির দুই  সঙ্গী হজরত আবু বকর ও হজরত  ওমর (রা.) গণকেও সালাম প্রদান করবেন। অতঃপর সেখান থেকে বের হয়ে কেবলামুখী হয়ে মন প্রাণ উজাড় করে, মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে শুকরিয়া আদায় করে দোয়া করবেন, অতঃপর সুযোগ বুঝে রওজা পাকের পূর্বদিকে জান্নাতুল বাকিতে গিয়ে অসংখ্য অগণিত সাহাবায়ে কেরামের কবর জিয়ারত করবেন। সম্ভব হলে চল্লিশ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে নববীতে আদায় করার চেষ্টা করবেন এবং সুযোগ পেলেই নবীজির রওজা জিয়ারত করবেন। আল্লাহ পাক আমাদের কবুল করুন আমিন।

 

                লেখক : ইমাম ও খতিব : কাওলার বাজার জামে মসজিদ, দক্ষিণ খান-ঢাকা।

সর্বশেষ খবর