শুক্রবার, ১৫ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

আমলের মধ্যে ইখলাস না থাকলে শুদ্ধ হবে না

আল্লামা মাহ্মূদুল হাসান

যখন রসুল (সা.)-কে হত্যা করার নির্দেশ দেওয়া হলো তখন আবু জাহেল রাজি হয়নি, আবু লাহাব রাজি হয়নি। যখন কোনো কাফের নবী (সা.)-কে হত্যা করতে রাজি হয়নি, তখন ওমর তাঁকে হত্যা করতে রাজি হয়ে যায়, কিন্তু আল্লাহ তাঁকে ইমানের দৌলতে ধন্য করেন। প্রথমে তিনি কোরআনের তিলাওয়াত তাঁর বোনের মুখে শুনেছেন। ওই তিলাওয়াতের তাসিরের বরকতে আল্লাহ রব্বুল আলামিন তাঁর দিলের মধ্যে যত শিরক ছিল, কুফর ছিল, নবীবিদ্বেষ ছিল তা সব ধুয়ে দিয়ে নবীর মহব্বতে পূর্ণ করেছিলেন। কোরআন এত বড় বরকতময় ও প্রভাব সৃষ্টিকারী। আল্লাহ বলেন, ‘যারা ইমান আনয়ন এবং নেক আমল করল, সত্বরই আল্লাহ তাকে মহব্বতের বস্তুতে পরিণত করে দেবেন।’ ইমান ও নেক আমল এ দুটি বিষয় যে কোনো ব্যক্তির মধ্যে আসবে, পৃথিবীর সব সৃষ্টজীবের অন্তরে আল্লাহ তাঁর মহব্বত ঢেলে দেবেন। সে মানুষ হোক বা জানোয়ার, দানব হোক, প্রাণী হোক, বাতাস হোক বা পানি। আল্লাহ নিজেও মহব্বত করবেন, উপরন্তু অন্যান্য সৃষ্টির অন্তরে মহব্বত ঢেলে দেবেন। বুখারির হাদিসে বলা হয়েছে, যখন আল্লাহ কোনো বান্দাকে মহব্বত করেন, তখন ফেরেশতা জিবরাইলকে ডাকেন। ডেকে বলেন, আমি এ বান্দাকে মহব্বত করি, অতএব হে জিবরাইল! তুমিও তাকে মহব্বত কর। জিবরাইল আসমানের ফেরেশতাদের ডেকে ডেকে বলে, এ লোকটাকে আল্লাহতায়ালা মহব্বত করেন আল্লাহর নির্দেশে আমিও তাকে মহব্বত করি। সুতরাং হে আসমানের ফেরেশতারা! তোমরাও তাকে মহববত কর। এরপর আসমানের ফেরেশতাদের মাধ্যমে আল্লাহ পৃথিবীর সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে ওই লোকের মহব্বত ঢেলে দেন। সে সৃষ্টি যেভাবেই থাক, যে স্থানেই থাক, জঙ্গলে থাক, লোকালয়ে থাক সবাই তাকে মহব্বত করে। ফলে পৃথিবীর কোনো সৃষ্টি তাকে কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। পৃথিবীতে এমন হাজারো ইতিহাস আছে। আল্লাহ আমাদের সঠিকভাবে ইমান আনয়ন ও নেক আমল করার তৌফিক দান করুন।

ইমাম গাজ্জালি (রহ.) বলেন, আমরা সাধারণত মনে করি নেক আমল হলো শুধু নামাজ পড়া, রোজা রাখা, হজ করা, জাকাত দেওয়া, সালাম দেওয়া, আজান দেওয়া, ইকামত দেওয়া। এসব নেক আমল তো আমরা করছি। রসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে নামাজ পড়বে, হালাল জবাই খাবে, বায়তুল্লাহকে কেবলা বানাবে আল্লাহ ও রসুল তার অভিভাবক হয়ে যাবেন। পৃথিবীর কোনো শক্তি তার ওপর হাত তুললে ধ্বংস হয়ে যাবে।’ আমরা নামাজ পড়ি, রোজা রাখি, হজ করি, জাকাত দিই, ইমানও আছে, সব আছে। আর আল্লাহ বলেছেন, যদি নামাজ পড়, রোজা রাখ তবে পৃথিবীর কোনো শক্তি তোমাদের ধ্বংস করতে পারবে না। কিন্তু আমরা নামাজ পড়ি, রোজা রাখি, জাকাত দিই এর পরও আমরা বিধর্মীদের হাতে গ্রাস হয়ে যাচ্ছি। শুধু কাফেরদের হাতেই নয়, মুসলমানদের হাতেও! এর কারণ কী? ইমাম গাজ্জালি (রহ.) বলেন, নেক আমল কাকে বলে বুঝতে চেষ্টা কর। শুধু নামাজ নেক আমল নয়, শুধু রোজা নেক আমল নয়, যতক্ষণ তার মধ্যে দুটি জিনিস না আসে। নামাজের মধ্যে যখন দুটি জিনিস পাওয়া যাবে, রোজার মধ্যে দুটি জিনিস পাওয়া যাবে, সদকার মধ্যে দুটি জিনিস পাওয়া যাবে, ইকামতের মধ্যে দুটি জিনিস পাওয়া যাবে তবেই এটা নেক আমল হবে। দুটির যে কোনো একটি বাদ পড়লে কাজটি নেক থাকবে না। তার একটা হলো ‘ইখলাস’। অন্যটি সুন্নত। আল্লাহ হাশরের ময়দানে দানবীরকে ডেকে জিজ্ঞাসা করবেন, আমি যে দুনিয়ায় তোমাকে জীবন দিলাম সে জীবনে তুমি কী করেছ? সে বলবে হে আল্লাহ! টাকাপয়সা দিয়ে মাদরাসা বানিয়ে দিয়েছি, মসজিদ বানিয়ে দিয়েছি। আল্লাহ বলবেন, তুমি তা এজন্য বানিয়েছিলে যেন মানুষ তোমাকে দানবীর বলে। দুনিয়ায় মানুষ তোমাকে দানবীর বলেছে, এখন তুমি জাহান্নামে যাও। অনুরূপভাবে কারিকে ডাকবেন, আলেমকে ডাকবেন, কী করেছ? তারা বলবে, অনেক বড় আলেম হয়ে ওয়াজ করেছি, হাজার হাজার মানুষের সামনে কোরআন তিলাওয়াত করেছি। আল্লাহ বলবেন, এসব তো এজন্য করেছিলে যাতে মানুষ তোমাকে বড় আলেম বলে, বড় কারি বলে, বড় বক্তা বলে, মুহতামিম বলে, শায়খুল হাদিস বলে। দুনিয়ায় মানুষ তোমাকে এসব বলেছে, এখন জাহান্নামে যাও। কী বোঝা গেল এর দ্বারা? কাজ তো সব ভালোই। কিন্তু কীসের অভাবে এ নেক কাজগুলো কাজে লাগেনি? তার নাম সহজ ভাষায় ইখলাস। আমলের মধ্যে যতক্ষণ ইখলাস না থাকবে ততক্ষণ আমল পরিশুদ্ধ হবে না। যেমন মানুষের শরীরে আত্মা না থাকলে হাত পচে যায়, ধরতে পারে না, চোখ পচে যায়, দেখতে পারে না, পা ভেঙে যায়, চলতে পারে না, মুখ বন্ধ হয়ে যায়, কথা বলতে পারে না; তেমনি আমলের জন্য ইখলাস হলো আত্মা। মানুষ যেসব আমল করে তার মধ্যে যখন ইখলাস থাকে না, তখন সে আমল পচে নষ্ট হয়ে যায়। সে আমল জান্নাতকে দেখতে পারে না, ধরতে পারে না, সে আমল তাকে জান্নাত পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না। সব আমলের মধ্যে ইখলাস থাকতে হবে।

 

লেখক : আমির, আল হাইআতুল উলয়া ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ।

সর্বশেষ খবর