রবিবার, ৭ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

কেন আত্মহননের প্রবণতা

তপন কুমার ঘোষ

কেন আত্মহননের প্রবণতা

ইদানীং সমাজে আত্মহননের প্রবণতা বেড়েছে। খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশে বছরে গড়ে ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে। সম্প্রতি এক গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশে গত বছর উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১০১ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। প্রসঙ্গত, বিশ্বে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন আত্মহত্যা করে। দেশে একের পর এক আত্মঘাতী উঠতি ছেলেমেয়েরা। একটা ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই আরেকটা ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়ছে সংবাদমাধ্যমে। আত্মহত্যার প্রবণতা নিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। আত্মহত্যার খবর আমাদের মনকে ভারাক্রান্ত না করে পারে না। কেন কম বয়সী ছেলেমেয়েরা এ চরম পন্থা বেছে নিচ্ছে? এর আর্থসামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক কারণ অনুসন্ধান করার সময় এসেছে। বিষয়টি নিয়ে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে। সভা-সেমিনার-সাক্ষাৎকারে চিকিৎসক ও মনোবিদরা নানা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ উপস্থাপন করছেন। আত্মহত্যা প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধির ওপর বিশেষজ্ঞরা জোর দিচ্ছেন। ২২ জুলাই ‘শিক্ষিতরা কেন বেশি আত্মহননে’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন ছেপেছে বাংলাদেশ প্রতিদিন। আত্মহত্যা ঠেকাতে করণীয় বিষয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনে ৪ ফেব্রুয়ারি একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। এর আগে ১৫ জানুয়ারি ছাপা হয়েছে ‘কেন আত্মহত্যায় ৭২ শতাংশ শিক্ষার্থী’। মূলত হতাশা থেকেই মানুষ আত্মঘাতী হয়। ক্যারিয়ার নিয়ে বিষণœতা, পরিবারের অবহেলা, প্রেমে ব্যর্থতা, সম্পর্কে টানাপোড়েন, কঠিন ব্যাধি থেকে মুক্তি, একাকিত্ব, স্বপ্ন পূরণে ব্যর্থতা, অভাব-অনটন, মান-অভিমান, ক্ষোভ-অপমান ইত্যাদি বহুবিধ কারণে আত্মহত্যা বেড়ে গেছে। কারণ যা-ই হোক, আত্মহত্যার প্রতিটি ঘটনাই আমাদের বেদনার্ত করে। আত্মহত্যা নিয়ে কিছু লিখতেও মন সায় দেয় না।

জীবন সম্পর্কে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে হবে ছোটকাল থেকেই। মানুষে মানুষে শিক্ষা, মূল্যবোধ, চিন্তা-চেতনা, জীবনযাপনের ধরন ও রুচিতে ভিন্নতা থাকবেই। এটা অস্বাভাবিক নয়। এটা মেনে নিতে হয়। সব মানুষের জীবনেই সমস্যা আছে। সবার জীবনেই ঝড়ঝাপটা আসে। আবার তা কেটেও যায়। ছোটবেলা থেকেই সন্তানদের এটা শেখাতে হবে। পারস্পরিক শ্রদ্ধা, দায়িত্ববোধ ও অধিকার সম্পর্কে সচেতনতার শিক্ষা দেওয়াটা খুবই জরুরি। এটা মানতে হবে, আমাদের সমাজ আত্মকেন্দ্রিক ও সুবিধাবাদী হয়ে উঠেছে। জীবনটা বড্ড বেশি যান্ত্রিক হয়ে পড়েছে। আমরা সবাই ব্যস্ত সময় পার করছি। নিজেকে নিয়েই সদা ব্যস্ত। কান্না-হাসির দোল দোলানো এই জীবন। মানুষের জীবনে সুখ আছে, দুঃখও আছে। সুখ অনুভব করতে হলে দুঃখের অনুভূতি থাকা চাই। এ কথা হলফ করে বলা যায়, একমাত্র শিশু ও পাগল ছাড়া প্রায় সব মানুষ আনন্দের পাশাপাশি কমবেশি হতাশায় ভুগছে। মানুষের মনোজগৎ বড়ই দুর্বোধ্য। রহস্যে ঘেরা। অনেক কিছু পাওয়ার পরও না পাওয়ার বেদনা গুমরে মরে। অকারণ বিষণœতা এসে জাপটে ধরে। ব্যাখ্যার অতীত এক শূন্যতা মনের গোপন কুঠুরিতে চিরস্থায়ী বাসা বাঁধে। কাউকে আপাত সুখী মনে হলেও সুখী জীবনের আড়ালে তার হৃদয়ে যে রক্তক্ষরণ হচ্ছে তা আমরা দেখতে পাই না। অনেক অপূর্ণতা নিয়ে আমাদের বেঁচে থাকতে হয়। তার পরও বেঁচে থাকার জন্য চলে নিরন্তর লড়াই। জীবনের মাধুর্য শেষ কণা পর্যন্ত মানুষ আস্বাদন করতে চায়। বেঁচে থাকার মধ্যেই আনন্দ। মানুষ রোবট নয়। মানুষের আবেগ আছে। তবে সেই আবেগ হতে হবে নিয়ন্ত্রিত। জীবনে প্রতিষ্ঠা পেতে হলে আবেগ দমন করতে হবে। আত্মবিশ্বাস ও মনোবল অটুট রেখে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। হাল ছাড়লে হবে না। স্বপ্ন দেখতে হবে। মানুষ স্বপ্ন নিয়েই বেঁচে থাকে। ডুবে থাকতে হবে কাজের মধ্যে। কাজকে ভালোবাসলে কাজের মধ্যে আনন্দ খুঁজে পাওয়া যায়। জীবনযুদ্ধে আমি জয়ী হবই। আমার জীবনে সাফল্য একদিন ধরা দেবেই- এ দৃঢ়প্রত্যয় নিয়ে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। কোনো মানুষেরই সব স্বপ্ন পূরণ হয় না। স্বপ্নভঙ্গের বেদনা বা গ্লানি সহ্য করার মতো মাইন্ডসেট বা মানসকাঠামো থাকতে হয়। এসব নতুন কথা নয়। জীবনের কঠিন বাস্তবতা বোঝার বয়স যাদের এখনো হয়নি তাদের উদ্দেশে আমার এ নিবেদন।

আত্মহনন সমাধান নয়। জগৎ সংসারে হাজারো প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয়। সব ক্ষেত্রে সাফল্য আসে না। জীবনের অঙ্ক সব সময় মেলে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হার মেনে নিতে হয়। ব্যর্থতা জীবনেরই অংশ। আবেগতাড়িত হয়ে হুট করে কিছু একটা করা অবিবেচনাপ্রসূত। বাস্তবতা বোঝার চেষ্টা করতে হবে। বাস্তবতা হচ্ছে- অন্ধ প্রেমের ক্ষেত্রে একদিন মোহমুক্তি ঘটে। দুঃখের রজনির অবসান হয়। রাতের পর দিন আসে। সময় একটা বড় ফ্যাক্টর। নিজেকে শেষ করে দেওয়ার আগে আত্মহননকারী নিজ পরিবার ও আত্মীয়স্বজনদের কথা একবারও ভাবে না। ভালোমন্দ, বর্তমান-ভবিষ্যৎ সব দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আগে আত্মহত্যা ঘটত সঙ্গোপনে। ইদানীং আত্মহত্যার কিছু ঘটনা ঘটেছে ফেসবুক লাইভে। আত্মহত্যা ছেলেখেলা নয়। এতে গৌরবের কিছু নেই। এটা জীবনের পরাজয় মাত্র। সন্তানতুল্য নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ুক এ উপলব্ধি।

লেখক : পরিচালক, পরিচালনা পর্ষদ, বাংলাদেশ হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর