রবিবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

এম আবদুর রহিম : একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান

এম বি আখতার

এম আবদুর রহিম : একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান

এম আবদুর রহিম অ্যাডভোকেট। বৃহত্তর দিনাজপুরের রাজনৈতিক অঙ্গনে একজন সৎ, নির্ভীক, ধর্মীয় অনুশাসনে আবদ্ধ অথচ অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে তাঁকে স্মরণ করা হয়। তিনি ছিলেন সততার প্রতীক, দক্ষ ও সচেতন রাজনীতিবিদ অথচ সামাজিক সেবা ও কল্যাণমুখী কাজে অগ্রপথিক। যিনি শিক্ষাজীবন শুরু করেছিলেন মাদরাসায়, ১৯৪২ সালে রাজশাহী সরকারি মাদরাসা থেকে ম্যাট্রিকুলেশন করেছিলেন অথচ ব্যক্তি, পারিবারিক, সামাজিক, কর্মজীবনে ধর্মীয় অনুশীলনগুলো কোনোভাবেই আওয়ামী লীগের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক চেতনায় বাধাগ্রস্ত হয়নি। তিনি পারিবারিক জীবনে সন্তানদের ধর্মবিষয়ক শিক্ষা যেভাবে প্রদান করেছিলেন ঠিক সেভাবেই সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবন পরিচালনার শিক্ষা প্রদান করেছিলেন। সেজন্যই হয়তো মরহুম এম আবদুর রহিমের সব সন্তান দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন। বড় সন্তান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের পরিচালনায় দোয়া মাহফিলগুলোয় সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে মন্ত্রমুগ্ধের মতো ‘আমিন’ ‘আমিন’ বলতে থাকেন। মরহুম এম আবদুর রহিম অ্যাডভোকেট যেমন কর্মদক্ষতায় নিজেকে রাজনৈতিক ময়দানে ও সামাজিক কার্যক্রমে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, ঠিক সেভাবে সন্তানরাও তাদের নিজ দক্ষতায় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। অর্থাৎ আজকের সমাজে প্রচলিত রাজনৈতিক ধারা ‘পলিটিক্যাল ডায়নাস্টি’ সেই ধারা থেকে তিনি নিজকে মুক্ত করতে পেরেছিলেন এবং সব সন্তান হয়তো সে আলোকেই কাজ করতে সক্ষম হয়েছেন। এখানেই একজন রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে নির্মোহ পিতার সার্থকতা। মরহুম এম আবদুর রহিম ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের একজন বিশিষ্ট সংগঠক। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে দিনাজপুর বড় ময়দানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রদেয় প্যারেড অনুষ্ঠানে সালাম গ্রহণ করেছিলেন। ছিলেন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য, দুবার জাতীয় সংসদের নির্বাচিত সদস্য, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রাজনীতি করেছেন। অথচ রাজনীতির মাঠে ছিলেন একজন নিরহংকার মানুষ। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের এক লেখায় দেখলাম তিনি কীভাবে সন্তানদের নিকট কিংবা দূর আত্মীয়দের খোঁজখবর রাখার জন্য হাসপাতালে পাঠাতেন। তাঁর এ নিরহংকার রাজনৈতিক ও ব্যক্তিজীবনের বৈশিষ্ট্যগুলোই আজকে রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায় স্মরণ করতে বাধ্য করছে।

মরহুম এম আবদুর রহিম অনেক বড় বড় রাজনৈতিক মঞ্চে রাজনৈতিক বক্তৃতা দিয়েছেন, সামাজিক বিপ্লবের কথা বলেছেন, পাশাপাশি বাংলাদেশের সংবিধান হাতে নিয়ে জনগণকে দেখিয়েছেন কেন আমাদের সংবিধানের ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে। ব্যাখ্যা দিয়েছেন কীভাবে স্বৈরশাসক জিয়া কিংবা এরশাদ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ সংবিধান ক্ষতবিক্ষত করেছেন। কেন আমাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে। আবার একই সভায় তিনি কোরআন শরিফ থেকে সুরা পড়ে ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন কেন এবং কীভাবে ধর্ম আমার ব্যক্তিজীবন গড়ার ক্ষেত্রে কাজ করবে, আর সংবিধান কীভাবে আমাদের ব্যক্তি, সামাজিক জীবনের অধিকার সংরক্ষণ করবে।

মরহুম রহিম সাহেবের সঙ্গে প্রায় ১০ বছর রাজনৈতিভাবে সম্পৃক্ত হয়ে দেখেছি তিনি কখনো কোনো বক্তৃতায় কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কথা বলেননি, সব সময় আদর্শিক কথা বলেছেন, স্বৈরশাসন এবং গণতান্ত্রিক শাসনের তফাত বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। বঙ্গবন্ধু এবং শেখ হাসিনার অর্থনৈতিক কর্মসূচিগুলো জনগণকে ব্যাখ্যা করে সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেছেন। যখন তিনি সমাজসেবা করছেন তখন তিনি রাজনৈতিক পরিচয় সামনে আনেননি। ১৯৯৪ সালের ঘটনা। দিনাজপুরের একটি বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানে আমি কাজ করি। হঠাৎ এক সকালে গেটের দারোয়ান দৌড়ে এসে জানাল গেটের বাইরে এমপি সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। তাড়াতাড়ি গিয়ে সালাম দিয়ে আমন্ত্রণ জানালাম অফিসে আসার জন্য। তিনি বললেন, কোর্টে যাওয়ার সময় মনে হলো তোমাকে একটু বলে যাই, আমাদের গ্রামের কয়েকটি এলাকায় বন্যার কারণে টিউবওয়েলগুলো নষ্ট হয়ে গেছে, পারলে চারটা টিউবওয়েল লাগিয়ে দিও। আমি বললাম, আপনি ফোনে আমাকে জানালেই পারতেন, কষ্ট করে এলেন! তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘কাজটা আমার, উপকার পাবে আমার এলাকার জনগণ তাই তোমার কাছে আসা, ফোন করলে হয়তো মনে হতো তোমাকে প্রেসার দিচ্ছি।’ আরও একটি উদাহরণ দিই। ১৯৯৫ সালে চাঞ্চল্যকর ইয়াসমিন হত্যার পর চারদিকে সবাই যখন রাজপথের আন্দোলনে ব্যস্ত তখন তিনি পরিচিত কয়েকজন এনজিও কর্মীকে ডেকে উপদেশ দিয়ে বললেন, রাজপথের আন্দোলন চলবে কিন্তু তোমরা সাক্ষী, তথ্য ও আলামত সংগ্রহ শুরু কর। এগুলো এখনই করা দরকার, পরে পাওয়া যাবে না। তাঁর কথামতো অনেক কাজ করার ফলে কেস পরিচালনায় অনেক মসৃণ হয়েছিল। রংপুরে যখন ইয়াসমিনের কেসের ট্রায়াল চলছিল তিনি নিয়মিত আন্দোলনের সমর্থকদের নিয়ে বাসে করে রংপুর কোর্ট চত্বরে যাওয়ার পরামর্শ দিতেন এবং যাওয়াটা নিশ্চিত করতেন। তাঁর নিবিড় তদারকি ও পরিশ্রমের ফলে দোষীদের বিচারের রায় কার্যকর হয়েছিল। এসব কারণেই তিনি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি এ অঞ্চলের একজন স্মরণীয় সমাজসেবী। মরহুম এম আবদুর রহিম অ্যাডভোকেট প্রায় ৬৫ বছরের অধিক সময় রাজনৈতিক এবং সামাজিক অঙ্গনে নেতৃস্থানীয়ভাবে বিচরণ করেছিলেন। তিনি ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং পরবর্তীতে তাঁর দেশ গড়ার কাজে অবদান এবং ১৯৭৫-পরবর্তী আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করা ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্বদানের মাধ্যমে তিনি যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন সেই অভিজ্ঞতা আজকের রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায় মৃত এম আবদুর রহিমকে ‘রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে’ পরিণত করেছে। দিনাজপুর অঞ্চলের মানুষ রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্রান্তিলগ্নে হয়তো এই ‘রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক অবদান’কে স্মরণ করে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে।

                লেখক : উন্নয়নকর্মী ও বিশ্লেষক

সর্বশেষ খবর