সোমবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

ইতিহাস বিকৃতকারীদের চরম মূল্য দিতে হবে

মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন

ইতিহাস বিকৃতকারীদের চরম মূল্য দিতে হবে

কিছুদিন আগে একজন প্রবীণ জাতীয় রাজনীতিবিদ বাংলাদেশের সংবিধান নিয়ে যে অনর্গল বক্তব্য রেখেছেন তা শুধু সত্যের অপলাপই নয়, সংবিধান বিকৃত করার শামিল। এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে তিনি পবিত্র সংবিধানকে তুচ্ছ করেছেন। ইতিহাসকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করে জাতির সামনে তুলে ধরা আমাদের পূতপবিত্র দায়িত্ব। কাউকে ছোট অথবা বড় করে দেখার মনমানসিকতা আমাদের পরিত্যাগ করতে হবে। আমি উনার বক্তব্য অত্যন্ত নিবিড়ভাবে শুনেছি। উনার সঙ্গে আমার রাজনৈতিক সম্পর্ক না থাকলেও ব্যক্তিগত চমৎকার সম্পর্ক ছিল। তার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা আমেরিকার ফ্লোরিডার মিয়ামি ইউনিভার্সিটি অব স্কুল অ্যান্ড ল’তে অধ্যয়নকালে। রাতে ডিনার পার্টিতে উনাকে দেখে আমি অত্যন্ত আনন্দিত ও গর্বিত বোধ করেছি। উনি আমার অধ্যাপক ডক্টর আর সি টি বেনিটেসের পাশের চেয়ারে বসা ছিলেন। ডক্টর আর সি টি বেনিটেস যার অধীনে ডক্টরেট ডিগ্রি কোর্সে উনি আমার সুপারভাইজার ছিলেন। ইতোমধ্যে আমি এত বেশি হোমসিক হয়ে গেছি আমার সুপারভাইজার আমাকে বারবার সান্ত্বনা ও আশ্বস্ত করতেন যে, তুমি উইকলি পরীক্ষাতে এত ভালো করছো এবং প্রতি মাসে তুমি দেড় হাজার ডলার করে পাচ্ছ। তোমার পারফরম্যান্স আমার দৃষ্টিতে এক্সিলেন্ট। তুমি কিছুদিন পর তোমার স্ত্রী ও আট মাসের ছেলেকে নিয়ে আসতে পারবে। এ কথাগুলো তিনি ড. কামাল হোসেনকে হয়তো বলেছেন। তিনি তার হৃদয়ের বিশালতায় আমাকে ডেকে নিয়ে সুপারভাইজার ডক্টর আর সি টি বেনিটেসকে বললেন, আপনি কিছুদিন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেন আপনার সুপারভাইজার আপনার যে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন আমি তাতে গর্ববোধ করছি। তিনি আরও বললেন, আমি দেশে ফিরে যাচ্ছি। ফিরে গিয়ে আপনার ছেলে ও স্ত্রীকে পাঠিয়ে দেব। তিনি মিয়ামি ইউনিভার্সিটি স্কুল অব ল’তে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন।

আমি উনার কাছ থেকে তিনি কখন দেশে ফিরবেন সেই তারিখটা জেনে আমাদের ইউনিভার্সিটি প্রাঙ্গণের বিদেশি শিক্ষার্থীদের বিশেষ সহযোগিতা করার অফিসে গিয়ে উনি যে তারিখে বাংলাদেশে ফিরবেন আমি উনার আইটিনারি অনুযায়ী বাংলাদেশে ফেরত যাওয়ার জন্য রিটার্ন টিকিট নিয়েছিলাম। উনাকে বললাম, স্যার আমি আপনার সঙ্গে বাংলাদেশে ফিরে যাচ্ছি। তিনি আশ্চর্যান্বিত হয়ে বললেন, আমার জীবনে এ ধরনের সুযোগকে কাজে না লাগিয়ে ছেলে ও বউয়ের জন্য দেশে ফিরে যাওয়াটা এই প্রথম দেখলাম। তিনি যতদিন মিয়ামিতে ছিলেন সারাক্ষণ আমাকে কাছে কাছে রাখতেন আর বিভিন্ন এয়ারপোর্টে তিনি নেমেই উনার একমাত্র কন্যা সারা হোসেনের জন্য এয়ারপোর্টের বিভিন্ন দোকানে ঘুরে শুধু চকলেট কিনতেন। আমি উনাকে বলতাম আপনার মেয়ের জন্য যে প্রচন্ড মায়া, আর আমার একমাত্র শিশু হেলাল যার বয়স মাত্র ৮ থেকে ৯ মাস তাকে ফেলে আমি কীভাবে এখানে থাকব। দেশে ফিরে এসে উনার সঙ্গে আমার প্রায়ই যোগাযোগ হতো। বেইলি রোডস্থ বাসায় যখনই যেতাম উনি অত্যন্ত আদরের সঙ্গে আমাকে গ্রহণ করতেন আর উনার স্ত্রী হামিদা হোসেনকে বলতেন, দেখ একজন বউপাগলা লোক, যে কি না আমার সঙ্গে শুধু আমেরিকার ফ্লোরিডা থেকে ডিগ্রি না নিয়ে চলে এলো বাংলাদেশে।

তিনি তার রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যোগদানের জন্য চট্টগ্রামে গেলে হোটেল শাহজাহানে থাকতেন। চট্টগ্রামের যতবার গেছেন ততবার আমি উনার সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি সবাইকে বের করে দিয়ে আমার সঙ্গে একান্তে আলাপ করতেন। যাক ভূমিকা আর বাড়িয়ে লাভ নেই, আসল লেখায় চলে আসি।

তিনি কিছুদিন আগে বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মৌলিক অধিকার, আইনের শাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে একপেশে যে বক্তব্য রেখেছেন তাতে আমি একমত হতে পারিনি। বিবেকের তাড়নায় এ লেখা। এটা সত্য যে, ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধান অনুমোদন পায় গণপরিষদে। রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মহান বিজয়ের পর জাতি পায় তাদের আকাক্সক্ষার পবিত্র সংবিধান। যা ছিল গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, আইনের শাসন, মানবাধিকার ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণের মূল্যবান সনদ। জাতি যাত্রা শুরু করল সংসদীয় পদ্ধতির পথ ধরে। কিন্তু অচিরেই সেই পূতপবিত্র সংবিধান বেয়নেটের আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত করা হলো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার লক্ষ্যে। অর্থবহ গণতান্ত্রিক বিধানকে বিদায় দিয়ে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় পদ্ধতির সরকার চালু হলো। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হলো রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা। জাতি পেল আজ্ঞাবাহী মন্ত্রিপরিষদ এবং ক্ষমতাহীন জাতীয় সংসদ। একদলীয় শাসনব্যবস্থায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়। এর আগে ১৯৭৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিধান, বিবর্তনমূলক আটক সংক্রান্ত আইনের মধ্য দিয়ে মৌলিক অধিকারে আঘাত হানা হয়। ১৯৭২ সালের ৪ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানের অধীনে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার যাত্রা শুরু করল। যে সংবিধান এ দেশের জনগণের রক্তের আখরে লেখা এক পূতপবিত্র জাতীয় দলিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত রাজনৈতিক নেতৃত্ব রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার চালু করা হলো। প্রকৃতপক্ষে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর তারিখে গণপরিষদে এ সংবিধান গৃহীত হয় এবং ১৯৭২ সালের ১২ ডিসেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান বলবৎ হয়। সংবিধান বলবৎ হওয়াকে সংবিধান প্রবর্তন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আর সেই সংবিধান নিয়ে আমরা সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থার পথে যাত্রা শুরু করি। সেই আদি বা মূল সংবিধানে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনে ১৬টি সংশোধনী আনা হয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এবং ১৯৭৫ সালে ২৫ জানুয়ারির যে সংশোধনী স্বাধীনতার মূলমন্ত্র গণতন্ত্র থেকে বিচ্যুতি ঘটায় তা-ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে। ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন হয়। বহুদলীয় গণতন্ত্র, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের মধ্য দিয়ে বিচার বিভাগ তার স্বাধীনতা ফিরে পায়। আবার ফিরে পায় তার আদি ব্যবস্থা। প্রত্যেক রাজনৈতিক দল তার দলীয় রাজনীতি করার অধিকার ফিরে পায়। জাতি একদলীয় শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্তি পায়।

পঞ্চম সংশোধনীর মধ্য দিয়ে একদলীয় সরকার পদ্ধতির বিধান বিলুপ্ত হলেও রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পদ্ধতি চালু ছিল। কিন্তু ১৯৯১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সংসদে ১২তম সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশে আবার সেই বহু আকাক্সিক্ষত সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। জনগণ তাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতার স্বাদ, ভোটের অধিকার, মৌলিক অধিকারগুলো ফিরে পায়। একই ধারায় ১৯৯৬ সালের ২৮ মার্চ ১৩তম সংশোধনের মধ্য দিয়ে এ দেশের জনগণ দলীয় সরকারের প্রভাবমুক্ত ভোটদানের অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রবর্তন করে বাংলাদেশের সংবিধানের ইতিহাসে ১২তম ও ১৩তম সংশোধনীর মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার পরিবর্তে জনগণের ভোটের অধিকার জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন বেগম খালেদা জিয়া। বাংলাদেশে গণতন্ত্র, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য উনার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীনে দেশে তিনটি সংসদ নির্বাচনে জনগণ ইচ্ছামতো প্রার্থীকে ভোট দিয়ে সংসদে পাঠিয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে এ কৃতিত্বের দাবিদার বেগম খালেদা জিয়া। তাঁর নেতৃত্বেই এ দুটি সংশোধনী সংবিধানে এনে জনগণের মৌলিক অধিকার সমুন্নত রাখার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছিল। এ পদ্ধতির ফলে আওয়ামী লীগ ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসার সুযোগ পেয়েছিল। যারা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ভোটাধিকার ফিরে পেয়েছিল সেই কোটি কোটি জনগণের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে। কেননা যে নেত্রী জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছেন, নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার সে অধিকার আজ অনুপস্থিত। আজ ভোটের অধিকার বঞ্চিত কোটি কোটি মানুষের অন্তরে বেগম খালেদা জিয়ার জন্য রক্তক্ষরণ হচ্ছে। মুক্ত খালেদা জিয়ার চেয়ে বন্দি খালেদা জিয়া অনেক শক্তিশালী। মানুষের ভোটের অধিকার ফেরত দেওয়ায় তাঁর নাম বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। এ ঐতিহাসিক সত্য ঘটনাগুলো ড. কামাল হোসেন সাহেব সাহস করে সেদিন টিভিতে বলেননি। বললে বরং তার মর্যাদা বাড়ত বই কমত না। রাজনীতির অঙ্গনে সফল রাজনীতিবিদ হতে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা দরকার হয়, কিন্তু সেই ইমেজ ধ্বংস হতে একটি ভুল-ই যথেষ্ট।

                লেখক : সাবেক বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী, রাষ্ট্রদূত, মেয়র।

সর্বশেষ খবর