শিরোনাম
সোমবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

তিস্তা চুক্তি হবে তিস্তার পানি দিয়েই

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

তিস্তা চুক্তি হবে তিস্তার পানি দিয়েই

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাঁচ দিনের (৩ থেকে ৮ সেপ্টেম্বর) ভারত সফর শেষ হয়েছে ১০ দিন আগে। একাধিক বিষয় নিয়ে দুই প্রতিবেশী দেশে আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক হলেও মূল বিষয়টি ছিল দীর্ঘদিনের বকেয়া তিস্তা নদীর জল বণ্টন নিয়ে সম্ভাব্য স্থায়ী চুক্তি। সে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার আগে একবার নজর দেওয়া যাক ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে নদীর জল বণ্টন নিয়ে জটিলতার দীর্ঘ ইতিহাসের ওপর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার ঠিক এক মাসের মধ্যে হত্যাকারীদের নেতা জিয়াউর রহমান ফারাক্কা থেকে জল নেওয়ার জন্য ভারতের বিরুদ্ধে নালিশ জানিয়েছিলেন জাতিসংঘে। সে সময় তার পরামর্শদাতা ছিলেন দিনাজপুরের বি এম আব্বাস। আব্বাস পাকিস্তান আমলে আইয়ুব, ইয়াহিয়া খানদের পরামর্শদাতা ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তিনি জিয়ার পরামর্শদাতা হলেন। সেই সূত্র ধরে জিয়াউর রহমান তাকে এবং কে এম কাইসারকে জাতিসংঘে পাঠিয়েছিলেন ভারতের বিরুদ্ধে নালিশ জানাতে। ভারত সরকার এই নালিশের জবাব দেওয়ার জন্য পাঠিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন সেচমন্ত্রী আবু বরকত আতাউল গনি খান চৌধুরীকে। প্রায় চার সপ্তাহ ধরে জাতিসংঘে বিষয়টি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হয়। সেই সময় জাতিসংঘে রিপোর্ট করার জন্য আনন্দবাজার থেকে আমাকে পাঠানো হয়েছিল। জাতিসংঘে বিশ্বের অন্তত ৫০টি মুসলিম দেশের স্থায়ী প্রতিনিধিদের সঙ্গে বরকত সাহেব ব্যক্তিগতভাবে বৈঠক করেন। বৈঠকে তিনি জিয়ার নানা অপকর্ম তুলে ধরেন। তারা সবাই বুঝতে পারেন এই ভারতবিরোধী চক্রান্ত করা হয়েছে পাকিস্তান এবং ওয়াশিংটনের উদ্যোগে। এমনকি বরকত এমন অভিযোগও করেছিলেন যে, বাংলাদেশ যে দরখাস্ত পেশ করেছে তা জুলফিকার আলী ভুট্টোর তৈরি করে দেওয়া। বাংলাদেশের প্রতিনিধি আব্বাস বা কাইসার এর কোনো জবাব না দিয়ে একতরফাভাবে ভারতকে গালিগালাজ করে দায়িত্ব সেরেছেন। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের কূটনৈতিক মহল মনে করে, ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গের বঙ্গেশ্বরী এখন উপদেশ নিচ্ছেন তার মন্ত্রিসভার সদস্য ববি হাকিমের কাছ থেকে।

এই ববি হাকিমই ২০১৪ সালে বাংলাদেশের নির্বাচনের আগে একটি টিভি চ্যানেলে বলেছিলেন, তিস্তা চুক্তি করে আমরা শেখ হাসিনাকে ফের ক্ষমতায় আনার ব্যাপারে সাহায্য করতে চাই না। তাকে পাল্টা প্রশ্ন করা হয়, বাংলাদেশের মসনদে তাহলে আপনি কাকে দেখতে চান? খালেদা জিয়াকে? তিনি প্রশ্নের সরাসরি জবাব না দিয়ে বলেন, আপনাদের যা মনে হয় বুঝে নিন।

মমতার অঘোষিত ‘বিদেশমন্ত্রী’ এখন ববি হাকিম কলকাতার বাংলাদেশ উপ-দূতাবাসের ডেপুটি হাইকমিশনার গত ৫-৬ মাস ধরে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে দেখা করতে যে চিঠি দিয়েছিলেন, তাকে বলা হয় বাংলাদেশের ব্যাপারে কথা বলতে হলে ববি হাকিমের সঙ্গে কথা বলতে হবে। যেহেতু আওয়ামী লীগের কয়েকজন বড় মাপের ব্যবসায়ীর সঙ্গে ববি হাকিমের সখ্য আছে, তাই অনেকেই মনে করেছিলেন এবার হয়তো তিস্তা চুক্তি হয়ে যাবে। অন্যান্য বারের মতো এবার আর মমতা ব্যানার্জি এই চুক্তিতে বাধা দেবেন না। কিন্তু তা হলো না। তার বদলে কী হলো? ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কুশিয়ারা নদীর জল বণ্টন নিয়ে চুক্তি হলো। রোহিঙ্গা ইস্যু শুরু হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ বারবার ভারতের কাছে এ ব্যাপারে সাহায্য চেয়ে এসেছে। ভারত বরাবরই মনে করে এসেছে এ বিষয়টি বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যকার বিষয়। রোহিঙ্গা নিয়ে বাংলাদেশের দীর্ঘকালের দাবি- অঞ্চলের সবচেয়ে বড় দেশ হিসেবে মিয়ানমারের ওপর সরাসরি চাপ দিক ভারত। যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আঞ্চলিক পরিস্থিতির সাপেক্ষে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে আসা ১০ লাখেরও বেশি শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়া বাংলাদেশের এই উদ্যোগের প্রশংসা করেছে ভারত। এ ব্যাপারে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ উভয়কেই সহায়তা করার ব্যাপারে তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ভারতই একমাত্র দেশ, যে দুটি দেশেরই প্রতিবেশী। শরণার্থীদের স্বচ্ছ এবং পাকাপাকিভাবে দ্রুত নিজেদের দেশে ফেরার ব্যাপারে ভারত সহায়তা করবে। শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের পর ভারতের অবসরপ্রাপ্ত বিদেশ সচিবের সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয়েছে। তারা বলেছেন,  প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে জল, স্থল এবং নৌ ইত্যাদি বিষয়ে সুষ্ঠু সমাধান একমাত্র আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই সম্ভব। এটাই তাদের অভিজ্ঞতা বলে। মনমোহন সিংয়ের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন আমার দীর্ঘদিনের পুরনো বন্ধু। তাকে এই সফর নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ২০১১ সালে ড. মনমোহন সিং যখন প্রথম ঢাকায় যান, তার আগে পর পর চারবার আমি কলকাতায় গিয়ে মমতার সঙ্গে কথা বলেছি। মমতা জিদ ধরে থাকেন যে তিনি ড. মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে ঢাকায় আসবেন না এবং তিস্তা চুক্তি করতে দেবেন না। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ব্যাপারে মমতা যে কিছুই বোঝেন না, সে ব্যাপারে আক্ষেপ করেছিলেন মেনন। কিন্তু খোঁচা দিয়ে বলেন, দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার ভারতের একমাত্র প্রতিবেশী দেশ হলো বাংলাদেশ। জিয়া এবং তার বিধবা স্ত্রী খালেদার সময় ছাড়া এই বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক রাখার চেষ্টা করে গেছে ভারতের পূর্বতন কংগ্রেস সরকার। তারা অনেক ক্ষেত্রেই সফলও হয়েছে।

শেখ হাসিনা যতবার ক্ষমতায় এসেছেন, সন্ত্রাসবাদ থেকে শুরু করে গরু পাচার পর্যন্ত সব ইস্যুতে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার চেষ্টা করেছেন। তার আমলেই বাংলাদেশের মাটি থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতের সন্ত্রাসবাদীদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়। এটা ভারতের একটা বড় পাওনা। তিস্তার ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যে ষোলোআনা সদিচ্ছা আছে, তা ফাইলে লিখে দিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তার আমলেই দুই দেশের মধ্যে তিস্তা চুক্তির খসড়া তৈরি করা হয়েছিল। বামপন্থি দলগুলো মনে করে, মমতার এই জিদের পেছনে রয়েছে সিআইএর ন্যান্সি পাওয়েল। তিনি এক সময় ঢাকায় ছিলেন। পরে তিনি কলকাতায় আসেন। কলকাতার রাজনৈতিক মহল মনে করছে, ন্যান্সি পাওয়েলকে সঙ্গে নিয়ে প্রাক্তন সেক্রেটারি অব স্টেট হিলারি ক্লিনটন উপদেশ দিয়েছিলেন, তোমরা কিছুতেই তিস্তা চুক্তি সই করবে না। আমরা ফারাক্কা চুক্তি আটকানোর চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু পারিনি। কথায় বলে, নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ। বাংলাদেশে জিয়ার পার্টি বিএনপি এবং জামায়াত তাদের প্রভুদের কাজে লাগিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে ভেঙে চুরমার করতে চাইছে। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ বারবার প্রমাণ করেছে কে প্রকৃত বন্ধু আর কে প্রকৃত শত্রু। তাই এক কথায় বলা যেতে পারে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সদ্য দিল্লি সফরে উভয় দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও জোরদার করার ওপর জোর দিয়েছেন।

নিউইয়র্কের ইস্ট ইয়র্কের জল এনে ফারাক্কা চুক্তি হয়নি। ফারাক্কা চুক্তি হয়েছে গঙ্গার জল দিয়েই। এবার দেখা যাক, কীভাবে শেখ হাসিনা উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ’৯৬ সালে প্রথম মন্ত্রিসভায় বড় মাপের মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রাজ্জাককে পানি ও সেচমন্ত্রী করেছিলেন। শপথ নিয়ে রাজ্জাক সাহেব চলে আসেন ভারতে বঙ্গবন্ধু তনয়ার নির্দেশেই। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তখন জ্যোতি বসু। তিনি তখন দিল্লিতে। সেখানে জ্যোতি বসু-রাজ্জাকের সাক্ষাৎকারে জ্যোতি বাবু রাজ্জাককে বলেছিলেন, কলকাতায় গিয়ে আপনি প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্র এবং আনন্দবাজারের এই লেখকের সঙ্গে দেখা করে তাদের সঙ্গে নিয়ে বরকত সাহেবের কাছে যাবেন। রাজ্জাক সাহেব কলকাতায় ফিরে সোমেন মিত্র এবং আমাকে ফোন করে হোটেলে দেখা করতে বলেন। আমরা একই সময় গিয়ে পৌঁছাই। তিনি ঘর ফাঁকা করে তার সঙ্গে জ্যোতি বাবুর কথাবার্তা খুলে বলেন। বরকত সাহেব তখন মালদহে। আমরা যে মালদহে যাচ্ছি, তা বরকত সাহেবকে জানায়নি। তার বোন রুবী নূরকে আমরা ফোন করেছিলাম। তিনি আমাদের মালদহের গৌড় ভবনে থাকার ব্যবস্থা করেন। সেখান থেকে সোজা কোতোয়ালিতে আমরা বরকত সাহেবের বাড়ি যাই। জ্যোতি বাবু রাজ্জাক সাহেবকে বলেছিলেন, বরকতকে রাজি করাতে পারলে তার কোনো আপত্তি নেই। বরকত সাহেব আমাদের দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন, আপনারা আমাকে না জানিয়ে কেন মালদহে এসেছেন? তার পাশে দাঁড়িয়ে তার বোন বিধায়ক রুবী নূর। রুবীকে হাসতে দেখে বরকত সাহেব আরও উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। রাজ্জাক সাহেবকে দেখিয়ে বললেন, আপনাদের সঙ্গে এই লোকটি কে? সোমেন বললেন, ইনি বাংলাদেশের সেচমন্ত্রী। তিনি আরও উত্তেজিত হয়ে বললেন, বঙ্গবন্ধুকে যারা হত্যা করেছে, আপনারা তাদের নিয়ে এসেছেন? এখনই আপনারা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। সোমেন সেই উত্তেজিত বরকত সাহেবকে পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে জ্যোতি বাবুর সঙ্গে রাজ্জাকের সাক্ষাৎ এবং গঙ্গার জলচুক্তির প্রসঙ্গটি বলেন। তখন বরকত বলেন, আমি জাতিসংঘে যা বলেছি, তা ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশ এবং নীতি অনুযায়ী। বিদেশমন্ত্রক থেকে আমাকে তার খসড়া তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল। এর পরই বরকত সাহেব তার সরকারি প্যাডে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এইচডি দেবগৌড়াকে একটি চিঠি লিখে জানান, ফারাক্কা চুক্তিতে তার এবং কংগ্রেসের কোনো আপত্তি নেই। সেই চিঠির একটি কপি তিনি পাঠিয়ে দেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে। এভাবেই সেই ফারাক্কা চুক্তির মূল বুনিয়াদ তৈরি হয়েছিল। এ বিষয়টি আমি ভুলেই গেছিলাম। কয়েক বছর আগে ঢাকায় গিয়ে আমি তোফায়েল আহমেদের বাড়িতে যাই। যেখানে আরও কয়েকজন অতিথি ছিলেন। সেই সময় এ কথাটি তোলেন তোফায়েল সাহেব। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, আপনি এ ঘটনা কেমন করে জানলেন? তিনি বলেন, দিল্লি এবং কলকাতা থেকে ফিরে আসার পর শেখ হাসিনা ক্যাবিনেট বৈঠকে গোটা বিষয়টি রিপোর্ট করেছিলেন। ক্যাবিনেটের সবাই সেদিন এ ঘটনা জানতে পেরেছেন। শেখ হাসিনার মতোই এ বঙ্গের মানুষও মনে করে তিস্তা চুক্তি হবেই। আর গুজরাটের কোনো নদী বা কালীঘাট থেকে নয়, সেই তিস্তা চুক্তি হবে তিস্তার পানি দিয়েই।          

                লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর