শিরোনাম
মঙ্গলবার, ৪ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা

মোদির পক্ষে মমতার সাফাই

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

মোদির পক্ষে মমতার সাফাই

ভারত এখন কোন পথে? সাম্প্রতিককালে বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে যা ভারতবাসী মেনে নিতে পারছে না। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরাও বুঝে উঠতে পারছেন না, আমরা কোন পথে চলেছি। সংবিধানের মৌলিক অধিকার অস্বীকার করে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করার আরএসএস নির্দেশ অনুযায়ী দিল্লির সরকার এবং অন্যান্য রাজ্যের বিজেপি সরকারগুলো কাজ শুরু করে দিয়েছে। সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি চিরদিনের মতো অবলুপ্ত করে দেওয়ার আয়োজন এবং আরএসএস কায়দায় প্রচার শুরু হয়েছে। উৎসবের মরশুমে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি আকাশছোঁয়ায় মানুষ যখন খেতে পাচ্ছে না, গরিব মানুষ ছেলেমেয়েদের জন্য জামাকাপড় কিনতে পারছে না, তখন সম্রাট আওরঙ্গজেবের মতো নরেন্দ্র মোদি শুধু লম্ফঝম্ফই করছেন না, ২০২৪-এ ক্ষমতায় ফেরার জন্য অসাংবিধানিক যত ধরনের কাজ ইতোমধ্যে শুরু করে দিয়েছে। সরকারের উদ্যোগে যে সব কাজ হয় অথবা সরকারি কারখানায় যা উৎপাদন হয়, সেখানেও মোদির ছবি দিয়ে প্রচার শুরু হয়েছে। সেই একই কায়দায় পশ্চিমবঙ্গেও মমতা ব্যানার্জির ছবি দিয়ে চলছে পরোক্ষ প্রচার। খাদ্যবস্তুর প্যাকেট থেকে শুরু করে ধূপকাঠি সর্বত্রই হয় নরেন্দ্র মোদি, আর না হয় মমতা ব্যানার্জির ছবি। অথচ এই দুই সরকারই প্রশাসনিক কাজে সম্পূর্ণ ব্যর্থ।

অতি সম্প্রতি ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বঙ্গেশ্বরী মমতা ব্যানার্জির কয়েকটি কাজের নমুনা দিলেই পাঠকদের কাছে বিষয়টি খানিকটা স্পষ্ট হবে। একাধিকবার তিনি বিভিন্ন সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছেন, আরএসএস আদৌ খারাপ কোনো সংগঠন নয়। উল্টো শৃঙ্খলাবদ্ধ সংগঠন বলে আরএসএসকে তিনি প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন। এর পাশাপাশি যখন দুই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই এবং ইডি তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীদের কার্যত তাড়া করে বেড়াচ্ছে একের পর এক দুর্নীতির মামলায়, তখন তিনি মন্তব্য করেছেন, সিবিআই এর এই বাড়াবাড়ি রকমের তদন্তের পিছনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হাত আছে বলে তিনি মনে করেন না। বরং তিনি এর পিছনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের হাত দেখতে পেয়েছেন। যদিও বাস্তব ঘটনা হলো, সিবিআই নামক কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাটি ডিওপিটির (ডিপার্টমেন্ট অব পার্সোন্যাল অ্যান্ড ট্রেনিং) অধীনে। যে বিভাগটি সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে প্রধানমন্ত্রীর দফতর (পিএমও)। ফলে মমতা যে পরোক্ষে মোদিকে  আড়াল করতে চাইছেন, তা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।

এ ধরনের উল্টোপাল্টা মন্তব্য কিন্তু আলটপকা করা নয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মমতা ব্যানার্জির এ ধরনের মন্তব্যের পিছনে নির্দিষ্ট একটা হিসাব রয়েছে। তা হলো পাহাড় সমান দুর্নীতির অভিযোগ বর্তমানে মুখ্যমন্ত্রীর পরিবার পর্যন্ত এসে গিয়েছে। আরও বড় বিপদ থেকে শেষ মুহূর্তে মোদি যাতে তাকে এবং তার পরিবারকে বাঁচিয়ে দেন, সেই পথ খোলা রাখতেই। ‘নরেন্দ্র মোদি ভালো কিন্তু অমিত শাহ খারাপ’ এই লাইন নিয়েছেন বঙ্গেশ্বরী। সম্প্রতি ভারতের উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময়ও মমতা ব্যানার্জির এই ভূমিকা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। বিজেপিবিরোধী জোটের প্রার্থীকে তৃণমূল ভোট দেয়নি। যুক্তি দেখিয়েছিল, তাদের সঙ্গে আলোচনা না করেই বিরোধীরা প্রার্থী ঠিক করে ফেলেছিল। তৃণমূল ভোটদান না করায় অনায়াসেই ওই পদে জয়লাভ করে পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়। যে ধনখড়ের সঙ্গে তৃণমূল সরকারের আকচাআকচি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা ছিল।

তৃণমূল ছাড়া বাকি বিরোধীরা কিন্তু সর্বভারতীয় স্তরে বিজেপি বিরোধিতায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কংগ্রেসের সাংগঠনিক নির্বাচনের পাশাপাশি দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতারা সোনিয়া গান্ধী ও রাহুল গান্ধীর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছেন। সম্প্রতি তার ‘দেশ জোড়া’ রাজনৈতিক পদযাত্রায় কেরলে এক সমাবেশে রাহুল গান্ধী বলেছেন, ‘নরেন্দ্র মোদি তার ধনী বন্ধুদের পাশে দেশের দরিদ্র মানুষদের দেখতে পান না। গোটা ভারতে পেট্র-পণ্যের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। রান্নার গ্যাস ও সিলিন্ডার কিন্তু ১ হাজার টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছে। রাহুল বলেন, ক্ষমতায় আসার আগে নরেন্দ্র মোদি দরিদ্রদের কথা বলে কেঁদে ভাসাতেন। এখন তার আমলে দ্রব্যমূল্য এতটাই বেড়েছে যে, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের প্রায় নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড় হয়েছে। মোদি বা স্মৃতি ইরানিদের তা নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। মোদি ব্যস্ত রয়েছেন তার দুই গুজরাটি শিল্পপতি বন্ধু গৌতম আদানি এবং রিলায়েন্সের মালিক মুকেশ আম্বানিকে নিয়ে।

বেশি দিনের কথা নয়। ইউপিএ-২ আমলে ড. মনমোহন সিং তখন প্রধানমন্ত্রী। সংসদে একটি আইন পাস করিয়েছিলেন ফুড সিকিউরিটি অ্যাক্ট বা খাদ্য নিরাপত্তা আইন। অর্থাৎ দেশের সমস্ত নাগরিকের দুই বেলার খাদ্য নিশ্চিত করার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের। বর্তমানে এই প্রকল্প প্রায় বন্ধ হওয়ার মুখে। কারণ দেখানো হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গ ঝাড়খন্ডসহ পাঁচটি রাজ্যে এবার ধানসহ অন্যান্য ফসল উৎপাদন কম হয়েছে। ভারতের রিজার্ভ ব্যাংকের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন সরকারের এই দাবি উড়িয়ে দিয়েছেন। তার বক্তব্য, ফুড করপোরেশনের গুদামে দেশের ১৪০ কোটি মানুষের খাদ্যসামগ্রী মজুদ রাখার কথা। সেই খাদ্যসামগ্রীতে গোটা দেশকে দুই বছর খাওয়ানো যায়। তা কোথায় গেল? ২০১৩ সালে গরিবদের জন্য বছরে বিনামূল্যে রান্নার গ্যাসের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেই প্রকল্পও এখন বন্ধ হওয়ার মুখে। এ ব্যাপারে আরএসএসও টুঁ-শব্দটি করছে না।

উল্লেখযোগ্য, এক সময় (সিপিএম শাসনামলে) জ্যোতিবসু বলেছিলেন, গ্রাম থেকে গরিবরা কলকাতায় এসে ভিক্ষা করবে না। তারা গ্রামেই কাজ পাবেন। সে সময় কেন্দ্রীয় সরকার ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প শুরু করেছিল। অর্থাৎ গ্রামের মানুষ বছরে অন্তত ১০০ দিনের কাজ পাবেন। অথচ বর্তমান অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন বলছেন, ১০০ দিনের কাজ প্রকল্প চালিয়ে যাওয়ার মতো অর্থ কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে নেই। কেন্দ্রীয় সরকারের এই দাবি বিশ্বাসযোগ্য নয়। তারা যে পরিসংখ্যান দিচ্ছে, তার কোনো ভিত্তিই নেই। বিশ্বব্যাংক আইএমএফ এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও জি-৮ দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা অভিযোগ করছেন, মোদি সরকার স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছতায় গোটা বিশ্বকে ভুল পরিসংখ্যান দিয়ে যাচ্ছে, যা মানা যায় না। এবার সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে তাকানো যাক। ২০২৪-এ লোকসভা নির্বাচন এবং চার বছর আগে ভারতের সাতটি রাজ্যে নির্বাচনকে ঘিরে এক অনিশ্চয়তার দিকে ভারত এগিয়ে চলেছে। মহারাষ্ট্রের স্ট্রংম্যান শরৎ পাওয়ায়, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী লালু প্রসাদ সম্প্রতি হরিয়ানায় এক জনসভায় বক্তব্য রেখে দিল্লিতে সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে বৈঠক করেন। এই তিন নেতাসহ আরও একাধিক অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা ঘোষণা করেছেন যে, কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে বিজেপিমুক্ত ভারত করা যাবে না। এটাই এখন তাদের মূল স্লোগান। বিজেপিমুক্ত ভারত গড়তে হলে কংগ্রেসকে নেতৃত্ব দিতে হবে। বঙ্গেশ্বরী মন্তব্য করেছেন,  কংগ্রেসকে নিয়ে কোনো জোট হবে না। পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস নেতারা বিশেষ করে সভাপতি অধীর রঞ্জন চৌধুরী প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, বিধানসভায় দাঁড়িয়ে মমতা বলেছেন, মোদি ভালো বিজেপি খারাপ। ছাত্রদের এক সভায় তিনি বলেছেন, আরএসএসের সঙ্গে কাজ করতে তার কোনো অসুবিধা হয় না। এই আরএসএস-ই জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করেছিল। মমতার ভাষায় সেটা পুরনো ব্যাপার। প্রকাশ্যে দাদা-দিদি যাই বলুক, তাদের মধ্যে যে একটা লেনদেনের গভীর আঁতাত আছে, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই কোনো রাজনৈতিক দলের। এতে কি প্রমাণ হয় না যে, আরএসএস বিজেপি মমতা একই পথের পথিক? ১৯৯৭ সালে কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে লালকৃষ্ণ আদভানির হাত ধরে তিনি যে বিজেপির হাত ধরেছিলেন সেই থেকে আরএসএসের প্রতি তিনি অনুরক্ত।

২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গার পর গোটা দেশ যখন নরেন্দ্র মোদির বিরোধিতায় মুখর হয়েছিল সে সময় মমতা মোদির পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। সে সময় তিনি দিল্লিতে একটি আরএসএস অফিসের উদ্বোধনও করেন। তিনি মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গে প্রায় এক হাজার আরএসএস প্রশিক্ষণ স্কুলসহ একাধিক সংগঠন খোলার অনুমতি দেন। এই স্কুলগুলো বেশির ভাগ খোলা হয়েছে মুসলিম এলাকাগুলোতে। মমতার সরকারই এই স্কুলগুলো খোলার জমি-জায়গা দিয়েছে। বিগত একাধিক নির্বাচনে এই আরএসএস ক্যাডাররাই তৃণমূলের সঙ্গে হাতে হাত রেখে কাজ করেছিল। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে সেই পথেই হাঁটার জন্য দাদা-দিদি কোমড় বেঁধে নেমে পড়েছেন। তাই তিনি বারবার নরেন্দ্র মোদি এবং আরএসএসের প্রচার করছেন। এই আরএসএসই এখন বাংলাদেশে মতুয়াদের মধ্যে কাজ করছে। তারা ইতোমধ্যে বাংলাদেশের ৬৪টি জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। সবারই জানা পশ্চিমবঙ্গের বিগত বিধান সভার নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরকালে মতুয়াদের ভোট অর্জনের জন্য বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ ও সাতক্ষীরা সফর করেছিলেন। মতুয়া মন্দিরে পূজা দিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিমবঙ্গের মতুয়াদের ভোট বিজেপির পক্ষে নেওয়া। বাংলাদেশের গরিব মতুয়াদের মধ্যে আরএসএসের প্রচারের সূত্রপাত কিন্তু এপার বাংলা থেকেই। তা না হলে দীর্ঘদিন পর নতুন করে আরএসএসের প্রশংসা করতে শুরু করলেন কেন মমতা? এই প্রশ্ন এখন দুই বাংলার ওয়াকিবহাল মহলের মাথায় ঘুরছে। বঙ্গবন্ধুর হত্যার ষড়যন্ত্র হয়েছিল কলকাতায়। বর্তমানে শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধেও ষড়যন্ত্র হচ্ছে কলকাতা থেকে। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই, জামায়াত এবং ধর্মীয় উগ্রবাদীদের সঙ্গে ঘন ঘন কলকাতায় বৈঠক করছে কেন? এ প্রশ্নই উঠছে দুই বাংলায়।

                লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর