বৃহস্পতিবার, ১৭ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

কী খেলা তুমি নতুন করে যাবে আবার খেলে

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

কী খেলা তুমি নতুন করে যাবে আবার খেলে

আধুনিক বাংলা গানের প্রবাদ পুরুষ শিল্পী মান্না দের কণ্ঠে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা এবং প্রভাস দের সুর করা গান ‘যে ক্ষতি আমি নিয়েছিলাম মেনে’ একসময় জনপ্রিয়তার শীর্ষে ছিল। বিচ্ছেদি ঢঙের এ গানের দ্বিতীয় লাইনটি হলো- ‘কী খেলা তুমি নতুন করে যাবে আবার খেলে’। দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে গানের এ দ্বিতীয় লাইনটি যেন বারবার শুনতে পাই। কারণ চারদিকেই কথা উঠেছে- কারা যেন নতুন করে আবারও এক খেলা শুরুর ইঙ্গিত দিচ্ছে। আরও মনে পড়ছে ছোটবেলায় পড়া গ্রিক দার্শনিক, তাত্ত্বিক ও শিক্ষামূলক ছোট গল্পের কথক ও লেখক ঈশপের একটি গল্পের কথা। গ্রিসের মেসেমব্রিয়ায় (Mesembria) আজ থেকে প্রায় ২ হাজার ৮৪২ বছর আগে অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ৬২০ সালে জন্ম নেওয়া ঈশপের এ অনুগল্পে দেখা যায়- একদল বালক একদিন খেলার ছলে একটি ডোবার কিছু ব্যাঙের দিকে একের পর এক পাথরের টুকরা ছুড়ে মারছিল। এতে পর পর বেশ কিছু ব্যাঙের করুণ মৃত্যু ঘটে। জানে বেঁচে থাকা কিছু ব্যাঙ তখন চিৎকার করে বলে- “হে বালক দল, দোহাই লাগে, তোমাদের এই নিষ্ঠুর খেলা বন্ধ কর। এটা তোমাদের জন্য নিতান্ত খেলা বা কৌতুক হলেও আমাদের জন্য তা মৃত্যু ডেকে আনছে।”

গান-গল্প ছেড়ে এবার বাস্তবতায় আসা যাক। কঠিন বাস্তবতা হলো একের পর এক বিপৎসংকেত দিয়ে কালের আবর্তে হারিয়ে যেতে বসেছে ঘটনাবহুল ২০২২ সাল। এ বছরের শেষ ভাগে বিশ্বমন্দা, ডলার সংকট, জ্বালানির অভাব, দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনা প্রভৃতি নিয়ে দেশ-বিদেশের পত্রপত্রিকা ব্যস্ত থাকলেও বলা চলে বছরজুড়েই বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে আলোচনার শীর্ষে ছিল ‘খেলা হবে’ কথাটি। এ দুটি শব্দকে বাক্য বিন্যাসের কোন শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করা যায়, তার নির্ণয়ে নানাজানের নানা মত থাকাই স্বাভাবিক। কারণ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে খেলা বলতে ক্রীড়া, লম্ফঝম্প বা শারীরিক কসরতমূলক আনন্দ-বিনোদনকে নির্দেশ করা হয়। তবে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে খেলা শব্দটি নানামুখী রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। ১৯১৫ সালের ৫ মার্চ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পূজা পর্বের একটি গানে স্রষ্টার প্রতি আমাদের যথাযথ দায়িত্ব পালনে হেলাফেলাকে খেলা হিসেবে গণ্য করে লিখেন- “তোমায় নিয়ে খেলেছিলেম খেলার ঘরেতে, খেলার পুতুল ভেঙে গেছে প্রলয় ঝড়েতে। থাক তবে সেই কেবল খেলা, হোক না এখন প্রাণের মেলা...।” জাতীয় ও বিদ্রোহী কবি নজরুলের চোখে বিশ্বের বুকে স্রষ্টার অপরিসীম ক্ষমতা প্রয়োগ যেন নিতান্ত খেলার মতোই সহজ, সরল ও স্বাভাবিক বিষয়। তাই ৩৫ বছর বয়সেই কবির ভাবুক হৃদয় গেয়ে ওঠে- “খেলিছ এ বিশ্বলয়ে, বিরাট শিশু আনমনে। প্রলয় সৃষ্টি তব পুতুল খেলা, নিরজনে প্রভু নিরজনে”।

কবি সুফিয়া কামাল তার আজিকার শিশু কবিতায় লিখেছেন- “আমাদের যুগে আমরা যখন খেলেছি পুতুল খেলা, তোমরা এ যুগে সেই বয়সেই লেখাপড়া করো মেলা”। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে শব্দসৈনিক এম আর আখতার মুকুল রচিত ও পঠিত চরমপত্র শিরোনামের জনপ্রিয় রম্য ধারাবর্ণনায় অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল ‘খেইল খতম’ অর্থাৎ খেলা শেষ কথাটি। এখানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দখলদারিত্ব ও মিথ্যা বাহাদুরীকে তাদের অনৈতিক খেলা আর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তাদের ধরাশায়ী হওয়ার কাহিনিকে এম আর আখতার মুকুল ‘খেল খতম’ হিসেবে দেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগে রাজ্জাক-কবরী অভিনীত বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম সফল চলচ্চিত্র ‘রংবাজ’ সিনেমায় সদ্য প্রয়াত গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা গানে সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাওয়া ‘সে যে কেন এলো না, কিছু ভালো লাগে না’ গানের মাঝে বেজে ওঠে ‘প্রজাপতি তারে গিয়ে বল না, আমি কি তার হাতের খেলনা’। দেশ-বিদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি এবং এসব গল্প, গান ও কবিতার সূত্র ধরে মনে একের পর এক প্রশ্ন জাগে, আমাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতা তথা শোষণ ও শঙ্কামুক্ত সোনার বাংলায় রাজনীতি ও নির্বাচন তবে কি অন্যের খেলার পুতুলে পরিণত হচ্ছে? এক বা একাধিক মানবরূপী প্রভু কি নিরজনে (নির্জনে বা গোপনে) বসে খেলছেন আর প্রলয় সৃষ্টি করছেন আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, শিক্ষানীতি এমনকি ধর্ম নিয়ে? আমাদের সন্তানেরা যখন তথাকথিত কম্পিউটার গেম বা অবাস্তব কিছু খেলায় নিমগ্ন, তখন আশপাশের দেশের তরুণ-যুবকরা তৈরি পোশাক শিল্পের মাঝ পর্যায় ও উচ্চ পর্যায়ের পদ দখল করছে হেসেখেলে। বলা যায় এ খেলায় তারা যেন এক প্রকার ওয়াকওভার পেয়ে যাচ্ছে আর মোটা অঙ্কের ডলার বেতন ও ভাতা নিয়ে কী সুন্দর নিজ নিজ দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে, যখন আমাদের দেশ রয়েছে চরম ডলার সংকটে। ধান্দাবাজ আর লুণ্ঠনকারীদের ‘খেল খতমের’ চরমপত্র লেখার মতো কিংবা ‘গেদু চাচার খোলা চিঠি’ লেখার মতো আর কেউ কি নেই এদেশে? তবে কি সত্যি সত্যি খেলার বা হাতের পুতুল হয়ে গেল সবাই?

বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই। সদ্য সমাপ্ত টি-২০ বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশের স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত বিদায় ঘটেছে। দরজায় কড়া নাড়ছে কাতারে অনুষ্ঠিতব্য বিশ্বকাপ ফুটবল ২০২২। এমন আসরে বাংলাদেশের উপস্থিতি বিগত ৫০ বছরে স্বপ্নই রয়ে গেল। অথচ দেশের স্বনামধন্য ক্লাবগুলোতে যখন হরদম ক্যাসিনো নামের জুয়া খেলা চলছিল তখন তা দেখার কেউ ছিল না। আসল খেলা বাদ দিয়ে নকল খেলায় ব্যস্ত ধান্দাবাজের দল। দেশের ক্রিকেটের এক বরপুত্র খেলার মাঠে যতটা সরস, তার চেয়ে অনেক বেশি সরস পুঁজি বা শেয়ারবাজারে। তাঁর বিষয়ে সাম্প্রতিককালের তথ্য বিশেষত একটি তথাকথিত স্বাধীন কমিশনের শুভেচ্ছা দূতের তালিকা থেকে তাঁর নাম বাদ পড়ার মধ্য দিয়ে আবারও প্রমাণিত হলো যে, শেয়ার বেচাকেনার ট্রেনিং হাউসে বহুল উচ্চারিত ও বহুল শ্রুত বায়বীয় চরিত্র ‘খেলোয়াড়’রাই মূলত শেয়ারবাজার নিয়ে যাচ্ছে তাই খেলেন আর রেফারিদের ঘোল খাওয়ান। দেশের রাজনীতিতে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের দাবিতে মাঠ গরম করছে একদল। আর রেফারিরা বলছেন কোন দল মাঠে এলো বা এলো না তা দেখার দায়িত্ব রেফারিদের নয়। মাঠ যেমনই হোক আর মাঠ খেলোয়াড় কিংবা দর্শকশূন্য যা-ই হোক, খেলা হবে। আর এ খেলার জন্য চাই আরও নতুন বাঁশি। তাই নতুন বাঁশি কেনার জন্য চরম ডলার সংকটের মধ্যে প্রচুর অর্থ দাবি করেছেন রেফারিরা। তাদের আস্থা এ অর্থ দিয়ে নতুন বাঁশি কিনলেই ‘নাইট ম্যাচ’ বন্ধ করা সম্ভব হবে এবং সব ‘ডে ম্যাচ’ হবে। কিন্তু খেলোয়াড়রাই না এলে কে ম্যাচ খেলবে কার সঙ্গে তা জানা নেই কারও। ৩০০ খেলোয়াড়ের তালিকায় নাম লেখাতে মুখিয়ে আছেন কেউ কেউ। নিজ যোগ্যতার বিচারে নাম উঠবে এমন ভরসা কেউ করতে পারছে না। তাই দিল্লি, লন্ডন, পিকিং কিংবা ওয়াশিংটন থেকে টনিক আনাচ্ছেন অনেকেই। অন্যদিকে আরেক দল মনে করেন কোনো দলের ১১ জনের সঙ্গে যদি স্বয়ং রেফারিরা ১২ বা ১৩ নম্বর খেলোয়াড় হয়ে মাঠে নামেন, তবে সেই খেলায় না নামাই ভালো। তবে আশ্চর্যের বিষয় এক সময় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও এনজিও কোন দেশে কে কীভাবে খেলছে তা পরখ করত। এখন তারাই একদিকে প্রয়োজনে কিংবা নিজ স্বার্থে খেলার ফাউল না দেখার ভান করে আবার অনেক সময় খেলায় পক্ষপাতিত্বের ধুয়া তুলে লাল কার্ড দেখায়। ২০২২ সাল জুড়েই তারা ইউক্রেন, তাইওয়ান, উত্তর কোরিয়া কিংবা সিরিয়া ও পাকিস্তানের মতো মুসলিম বিশ্ব নিয়ে নানাবিধ খেলায় ব্যস্ত ছিল। সেখানে বাংলাদেশের ২০২৩ বা ২০২৪ সালের খেলা তাদের কাছে কতটা অগ্রাধিকার পাবে তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

দেশের খেলাধুলার বিষয়টি প্রকৃতপক্ষে দেখভাল করার জন্য একজন তরুণ প্রতিমন্ত্রী রয়েছেন। তবে দেশের কয়টি স্টেডিয়াম বর্তমানে মাদকসেবী কিংবা ঘাস-জঙ্গলের দখলে, তা মাঝেমধ্যেই সংবাদ শিরোনাম হয়। সরকারি অর্থ ব্যয়ে নির্মিত সুইমিং পুল আছে জেলায় জেলায়, তবে পানি নেই। এসব পরিত্যক্ত স্থাপনার কাছে দাঁড়িয়ে কেউ বলছে না ‘খেলা হবে’। এ প্রতিমন্ত্রীর চেয়ে অন্য মন্ত্রী বা মন্ত্রণালয় অনেক বেশি খেলা উপহার দিয়ে চলেছেন। এক মন্ত্রীর মুখের কথায় চলে জাদুর খেলা! তিনি ব্যবসায়ীদের সামনে মুখ খুললেই তেল-চিনির দাম বেড়ে যায়। বাচ্চাদের খেলনাঘর তৈরির মতো সারা দেশে বিশেষত নিজ জেলায় বিগত কয়েক বছরে সরকারি শত শত কোটি টাকায় বিভিন্ন স্থাপনা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন এক ডাক্তার মন্ত্রী। তাঁর খেলা এখানেই শেষ। জনবল ও যন্ত্রপাতির অভাবে পরিত্যক্ত খেলনার মতো বেকার পড়ে রয়েছে সেসব স্থাপনা। মাটিতে বা বালিতে খেলার ছলে নদনদী, সেতু ও রাস্তা বানিয়ে খেলে ছোট শিশুরা। তবে বড়রাও এমন খেলায় কম যান না। সারা দেশে একাধিক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীরা গড়েছেন এমন শতাধিক সেতু। অথচ দুই পাশে কোনো সংযোগ সড়ক না থাকায় নির্মিত এসব সেতু কেবল সেলফি তোলার কাজে ব্যবহৃত হয়। ১০ বছর ধরে রাজধানীর উত্তরে একটি রাস্তা নিয়ে সার্কাস খেলা দেখাচ্ছে দেশি-বিদেশি খেলোয়াড় নিয়ে গড়া একটি সার্কাস দল। এ রাস্তার কারণে কার কী যন্ত্রণা হলো বা কতজনের প্রাণ গেল তা দেখার সময় নেই। তারা খেলা নিয়ে খুবই ব্যস্ত। বোট ক্লাবে জিন-পরীদের জলকেলি খেলা চলে, নৌকাবাইচ হয় না। জলকেলি হয় তিস্তার পানি নিয়ে। এতে চোখের পানি ঝরে অভাগা কৃষকের। শিশুতোষ খেলার অংশ হিসেবে বাচ্চারা কাগজের বিমান বা এরোপ্লেন বানিয়ে আকাশে উড়ায়। আর বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস মিসর থেকে দুটি বিমান এনে তা উড়াতে না পারলেও চুক্তিগত কারণে প্রতি মাসে ৪৭ মিলিয়ন বা ৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা দিতে বাধ্য হয়েছে। কাগজের বিমান ঘরে পড়ে থাকলে ক্ষতি নেই। কিন্তু এ বিমান দুটি ঠিক করে মিসরে ফেরত পাঠাতে বাধ্য বিমান বাংলাদেশ। বাংলাদেশ বিমান নিয়ে এমন খেলা চলছে প্রায় ৫০ বছর ধরেই। বর্ষায় কাগজের নৌকা বানিয়ে পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া বাচ্চাদের প্রিয় একটি খেলা। এদেশের বহু টাকার শ্রাদ্ধ করে সদরঘাট-টঙ্গী নৌপথে ওয়াটার বাস নামিয়ে খেলায় মেতে ছিলেন একদল অর্বাচীন। কাগজের নৌকার মতোই নৌপথ থেকে হারিয়ে গেছে সেই ওয়াটার বাস। খেলনা গাড়ির মতো প্রকল্প শেষে হারিয়ে যায় প্রকল্পের টাকায় কেনা বহু গাড়ি। তাই বলা যায় যে দেশে এমনিতেই খেলার শেষ নেই সে দেশে নতুন করে আর কী ‘খেলা হবে’?

একটু পেছন ফিরে তাকালেই দেখা যায় স্বাধীনতার পর পরই মাঠে নামে একদল সুযোগ সন্ধানী খেলোয়াড়। তারা কম্বল, ধান, পাট, কেরোসিন ইত্যাদি নিয়ে খেলতে শুরু করলে বিব্রত হন স্বয়ং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘চোর না শোনে ধর্মের কাহিনি’। এসব অসাধু, মজুদদার, চোরাকারবারি ও লুটেরার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ঘোষণার পরপরই ৭৫ এর ১৪ আগস্ট নৈশ প্রশিক্ষণের নামে রাস্তায় নামে উত্তরপাড়ার মধ্যরাতের খেলোয়াড়রা। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের শুরু হয় রক্তের হোলি খেলা। ধারাপাত কিংবা বর্ণমালা পড়ার বইয়ের মতো খেলার ছলে সংবিধান পরিবর্তন শুরু হয় এ পঁচাত্তরেই। ১৫ আগস্ট এবং ৩ নভেম্বরের খুনিদের সংবিধানে ঠাঁই দেওয়া হয় সূর্য সন্তান হিসেবে। সংবিধানে লেখা মুক্তিযুদ্ধের চারটি মূল নীতির সঙ্গে ছেলেখেলা করে এগোতে থাকে পঁচাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশ। ফলে শুরু হয় নতুন নতুন খেলা। বাঙালি বনাম বাংলাদেশি, জয় বনাম জিন্দাবাদ, সেকুলার বনাম উগ্র, আমলা বনাম কামলা, মিলিটারি বনাম সিভিলিয়ান, পুলিশ বনাম ফুলিশ (বিরোধী দল), পাহাড়ি বনাম বাঙালি, স্বাধীনতার পক্ষ বনাম বিপক্ষ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্বপক্ষ বনাম বিরোধী, লগি বনাম কাস্তে, আগুন বনাম পানি, আটক বনাম নাটক, গুম বনাম চুম- এমন বহুবিধ মতবাদ, দল, উপদলের আজব খেলার এক সেরা স্টেডিয়ামে পরিণত হয়েছে আজকের বাংলাদেশ। এদেশে কখনো হাতুড়ি-কাস্তেখচিত লাল পতাকা, কখনো চাঁদ-তারাখচিত সবুজ পতাকা, আবার কখনো পদ্মখচিত গেরুয়া পতাকা শোভিত মাঠে খেলতে চায় খেলোয়াড়েরা। অথচ কথা ছিল আমাদের সন্তানেরা একটি সবুজ শ্যামল সমতল মাঠে লাল-সবুজের পতাকা উড়িয়ে ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির’ বলে ক্রমেই এগিয়ে যাবে। বাস্তবে দেখা যায় আজ ঘরের শিশুটিও বলতে শিখেছে ‘খেলা হবে’। 

সামরিক ইতিহাসে ‘রণ হুংকার’ বা ‘ব্যাটেল ক্রাই’ বলে একটি কথা আছে। মুক্তিযুদ্ধে এক পক্ষ যখন ‘হায়দার’ বা ‘ইয়া আলি’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়ত, তখন ‘জয় বাংলা’ বলে পাল্টা জবাব দিত আরেক দল। ভারতের সঙ্গে পাকিস্তান বা চীন সীমান্তে উত্তেজনা দেখা দিলে প্রায়ই ‘জয় হিন্দ’ বলে গর্জে ওঠে ভারতীয় সেনারা। ৩০০ বছর আগে থেকেই শুরু করে আজকের ইউক্রেন যুদ্ধ পর্যন্ত সমান তালে রাশিয়ার সৈন্যরা ‘উররাহ’ বলে যুদ্ধ শুরু করে। তবে দুঃখের বিষয় এদেশে দুটি সমাজ যেন দুটি পরাশক্তিতে পরিণত হয়েছে। আর জনগণ যেন দুটি পরাশক্তির কাছে তাদের পাশের ক্ষুদ্র রাষ্ট্র। তাই ‘খেলা হবে’ বলে তারা রণ হুংকার দিলেই জনগণ ভয় পায়। যুদ্ধ বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে তারা ভয় পায় না। তাদের ভয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, আগুন সন্ত্রাস কিংবা বেকারত্ব নিয়ে। তারা যেন মাঠের সবুজ নরম ঘাস যার ওপর দিয়ে হাতি চলাচল করে। এখানে এখন হাতি প্রেম করলেও ঘাসের বিপদ, আর ঝগড়া করলে তো কথাই নেই। সুতরাং এ তথাকথিত খেলোয়াড়দের সব খেলা তথা অশুভ তৎপরতা বন্ধ হোক এটাই কাম্য।

শুরু করেছিলাম মান্না দের গাওয়া গানের কথা দিয়ে। গানে গানেই শেষ করতে চাই আজকের লেখা। ১৯৮২ সালে তথা বাংলা সিনেমার গৌরবের দিনে আমজাদ হোসেনের ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’ নামের সিনেমায় তারই লেখা ও আলাউদ্দিন আলীর সুর দেওয়া মূল গান ‘জন্ম থেকে জ্বলছি মাগো’  আলাদাভাবে গেয়েছিলেন সাবিনা ইয়াসমিন ও সৈয়দ আবদুল হাদী। গানের দ্বিতীয় লাইন হলো ‘এবার আদেশ করো তুমি আদেশ করো, ভাঙনের খেলা খেলবো’। আজ জাতির জনকের কথা মনে পড়ে। ৭ মার্চে যিনি আদেশ করেছিলেন ভাঙনের খেলা শুরুর। ৯ মাসের সেই খেলাই আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিল। কিন্তু আজ যে খেলা শুরুর ইঙ্গিত পাচ্ছি তা যেন কষ্টার্জিত স্বাধীনতা সুফল লাভের অন্তরায়। ‘আজ পাশা খেলবোরে শ্যাম’ বলে মিষ্টি করে গান গাইতে জানে না এই নেপথ্যের খেলোয়াড়রা। তাদের দেখলেই আশির দশকে রফিকুল আলমের গাওয়া একটি গান মনে পড়ে। ‘একি খেলা চলছে হরদম! এক দিকে নিরন্ন মানুষ, আরেক দিকে এটম! খেলা চলছে, খেলা চলছে, খেলা চলছে হরদম’!

লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট।

email: [email protected]

সর্বশেষ খবর