শুক্রবার, ১৮ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

কে বড় : জনগণ মন্ত্রী না অন্য কেউ

মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন

কে বড় : জনগণ মন্ত্রী না অন্য কেউ

১৯৯১ সালে চট্টগ্রামের জেলা জজ ছিলেন ইফতেখার রসুল। পরে তিনি হাই কোর্টের বিচারক হন। তখন আমি চট্টগ্রামের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলাম। পেশাগত জীবনে তাঁকে আমি চট্টগ্রাম জজ কোর্টে প্রথম সাব-জজ হিসেবে পেয়েছি। বিচার বিভাগ থেকে পদত্যাগের পর আমার প্রতি তিনি অত্যন্ত সংবেদনশীল ছিলেন এবং তাঁর কোর্টে যখন কোনো মামলা পরিচালনা করতে যেতাম তিনি আগ্রহভরে আমার মামলা শুনতেন। ১৯৯২ সালের শেষের দিকে সকালে মেয়রের দফতরে কাজ করার সময় একটি টেলিফোন এলে অন্য প্রান্ত থেকে বলেন, ‘আমি চট্টগ্রামের জেলা ও দায়রা জজ ইফতেখার রসুল, আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই আপনার অফিসে অথবা বাসায়।’ আমি তাঁকে সরাসরি বললাম, এটা সম্ভব নয়। তিনি বললেন, ‘যে ব্যাপারটা নিয়ে আমি আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চাই সেটা আদৌ আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার নয়।’ আমি বললাম, এর পরও আমি আপনার সঙ্গে আমার মেয়র অফিসে বা বাসায় দেখা করলে আপনি বিচারক হিসেবে যে সুনাম ও খ্যাতি অর্জন করেছেন তা ভূলুণ্ঠিত হবে। আর আমি একজন সাবেক সহকারী জজ হিসেবে তা করতে পারি না। বারবার অনুরোধের পরও আমি পুনরায় বললাম, তা-ও সম্ভব নয়। তিনি অত্যন্ত মন খারাপ করে টেলিফোন রেখে দিলেন। আমিও টেলিফোন রেখে দিয়ে কিছুক্ষণের জন্য ফিরে গেলাম আমার সেই আইন পেশার জীবনে। চোখের সামনে ভেসে আসছিল তাঁর মতো অনেক জজের সহযোগিতা ও সহমর্মিতা। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করলাম চট্টগ্রামের জেলা ও দায়রা জজ প্রকাশ্য অথবা গোপনে যদি মেয়রের কার্যালয়ে বা বাসায় দেখা করেন, তাহলে বিচারালয়ের আদি গৌরবের মর্যাদাহানি হবে এবং একটি ভুল বার্তা যাবে সমাজে। আমি এর আগে আর একবার এরকম ঘটনার মুখোমুখি হয়েছিলাম; যখন সিলেটের জজ কোর্টে সহকারী জজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলাম। বিএনপির তৎকালীন মন্ত্রী তৈমুর রাজা আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে আমি অ্যাভয়েড করি। কেননা আমারই আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে একটি মামলার শুনানি চলছিল। সিলেটের প্রথিতযশা আইনজীবী অ্যাডভোকেট জিতেন্দ্র বাবু, পুরকায়স্থ বাবু ও অ্যাডভোকেট গোলাম কিবরিয়া লড়ছিলেন, থাক ওসব কথা।

আমি আমার পিএসকে বললাম চট্টগ্রামের জেলা ও দায়রা জজ ইফতেখার রসুল ওইদিন সন্ধ্যায় কোথায় থাকবেন তাঁর অগোচরে তাঁর স্টাফদের কাছ থেকে সুকৌশলে জেনে নেওয়ার জন্য। আমার পিএস মহিবুল হক (বর্তমানে জয়েন্ট সেক্রেটারি) খবর নিয়ে আমাকে জানালেন, জেলা জজ সন্ধ্যায় তাঁর বাসভবনেই থাকবেন। আমি তাঁকেও কিছু না বলে আমার সন্ধ্যা ও রাতের সব কর্মসূচি বাতিল করলাম নিজের অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে এবং সিদ্ধান্ত নিলাম সন্ধ্যার পর যেকোনো সময় জেলা জজের বাসভবনে যাব তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য। কী কারণে তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন জানার জন্য। ভাবলাম ব্যক্তিগতভাবে তাঁর বাসায় যাওয়ার মধ্য দিয়ে সকালে যে তাঁর সঙ্গে দেখা না করায় মনঃক্ষুণ্ন হয়েছেন তা মিটে যাবে। আর আমিও জীবনে একটি সুযোগ পেলাম একজন বিচারককে তাঁর প্রাপ্য সম্মান প্রদানের এবং তাঁর প্রদত্ত সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও সহানুভূতির ঋণ পরিশোধ করার। অন্যদিকে আদালতের মানমর্যাদা সমুন্নত রাখার একটি ছোট প্রয়াসও।

সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে আমার স্ত্রী (তিনি আর এ জগতে নেই) ডালিয়াকে জেলা জজকে সকালে সাক্ষাৎ প্রদানে অস্বীকৃতির কথা এবং সন্ধ্যায় তাঁর বাসায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করায় তিনি অত্যন্ত আনন্দিত ও পুলকিত বোধ করলেন। আমি রাত ৮টায় বাসা থেকে বের হয়ে জেলা জজের বাসভবনে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কর্মচারীদের দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গেল। গাড়ি থেকে নেমে বাসভবনের বারান্দায় পৌঁছামাত্র জেলা ও দায়রা জজ ইফতেখার রসুল ব্যস্তসমস্ত হয়ে এসে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘আল্লাহতায়ালা আপনাকে অনেক বড় করবেন। আপনি যেই অসামান্য সম্মান আমাকে দেখিয়েছেন তার জন্য সারা জীবন দোয়া করব। আপনার সঙ্গে দেখা করতে না পারায় আমি খুবই মানসিক কষ্টে ছিলাম এবং ভাবতেও পারিনি আপনি আমাকে সাক্ষাৎ প্রদানে অস্বীকৃতি জানাবেন।’ তিনি আমার হাত ধরে নিয়ে গেলেন ড্রয়িংরুমে। সেখানে বসে তাঁকে বললাম জজ হিসেবে আপনার সম্মান ও মর্যাদা মন্ত্রী-মেয়রের অনেক ওপরে। মন্ত্রী-মেয়রের আদেশ আইনসম্মত না হলে আপনিই তা বাতিল করতে পারেন অর্থাৎ জজের এজলাস হচ্ছে এ দেশের মানুষের শেষ ভরসাস্থল। আপনার চেয়ারের মানমর্যাদা সমুন্নত রাখতেই আমি আপনাকে আমার অফিসে বা বাসায় সাক্ষাৎ দিইনি। এতে তিনি আনন্দে উচ্ছ্বসিত হলেন। এরপর তাঁর বক্তব্যটা শুনে ওখানে বসেই সিডিএ চেয়ারম্যানকে বলে দিলাম জেলা জজের বাসভবনের বাউন্ডারির মধ্যে কোনো অবস্থায়ই যেন কোনো সীমালঙ্ঘন না হয়। বললেন, ‘জি স্যার, হবে না’। আমি যখন ঘটনা পরিক্রমায় এ লেখা লিখছি তখন ইফতেখার রসুল হাই কোর্টের জজ হিসেবে চাকরিতে অবসর নিয়ে না-ফেরার দেশে চলে গেছেন। শুধু বলব, বিচার বিভাগ হচ্ছে সংবিধান ও জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের অভিভাবক। এর বিচ্যুতিই আজকে দেশে এ চরম সংকটকাল। এ ধরনের পরিস্থিতি অনুধাবন করে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের মধ্য দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেন। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের মধ্য দিয়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়। কোনো ধরনের অসদাচরণ বা অসামর্থ্যরে কারণে রাষ্ট্রপতির এককভাবে কোনো বিচারককে অপসারণ করার ক্ষমতার ইতি টানা হয় কাউন্সিল গঠনের বিধানে। যারা জনগণের কাছে না গিয়ে বাহিনীকে ব্যবহার করে সংসদে গিয়েছেন তাদের হাতে আমাদের ঐতিহ্যবাহী বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কতটুকু ভয়ভীতি উপেক্ষা করে চলতে পারে তা দেখার বিষয়। আসলে বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, বর্তমান সরকারের অধীনে দেশে আইনের শাসন, গণতন্ত্র, সংবিধান সুরক্ষায় কোনো সুযোগ আছে কি না? সংসদে বিনা ভোটে নির্বাচিতদের সমাহারে সত্যিকারের রাজনীতিবিদরা আজ বড় অসহায়। প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই পুলিশি মামলা। ১/১১ বিরাজনীতিকরণে যে প্রক্রিয়া শুরু করেছিল এখনো সে প্রক্রিয়া চালু রয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মেহেরবানি করে একবার ভেবে দেখুন যাদের আপনার শ্রদ্ধেয় বাবা রাস্তা থেকে নিয়ে এসে এমপি-মন্ত্রী বানিয়েছেন, আপনার বাবাকে হত্যা করার পর একজন লোকও সেদিন রাস্তায় নামেননি। এ ধরনের লোক দিয়ে মিটিং, মিছিল করা যাবে, সত্যিকারের রাজনীতি হবে না। আপনার জন্য সৌদি আরবে এক অনন্য সংবর্ধনার ব্যবস্থা ও সৌদি বাদশাহর সঙ্গে দেখা করার জন্য আমার পক্ষ থেকে আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি। আমার ম্যাডামের নির্দেশে তা করেছি। মনে করেছিলাম প্রতিহিংসার রাজনীতির দিন শেষ হচ্ছে। অথচ দেশে কী দেখলাম। ১/১১-এর সময় ২২ জন রাজনীতিবিদকে মামলায় জড়ানো হয় আপনিসহ, কাউকে জেলে থাকতে হয়নি। আমার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলায় আমাকে বারবার পাঠানো হলো জেলে। কোর্টের নির্দেশ আমাকে ডিভিশনে রাখার। সেখানে আমাকে কেরানীগঞ্জ কারাগারে যাওয়ার পর ডিভিশনে খাট, রিডিং টেবিল এবং নামাজের জন্য জায়নামাজ বিছানো হলো। জেল সুপার আমার সঙ্গে সম্মানজনক ব্যবহার করে ডিভিশনে নিয়ে গেলেন। তখন মাগরিবের সময়। এমনিতেই মানসিকভাবে বিধ্বস্ত আর অন্যদিকে আমি ডিভিশন-১ সেলে মাগরিবের নামাজের জন্য জায়নামাজ ঠিক করে দাঁড়াতেই কারারক্ষীরা এসে বলল, আপনার ডিভিশন ক্যানসেল! আমার কাপড়-চোপড়, বিছানা তারা বাইরে রেখে আমাকে নিয়ে গেল একটি সেলে। প্রায় এক থেকে দেড় বছর বন্দি থাকায় আমার বাঁ পায়ে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এখন আমার বাঁ পা দিয়ে হাঁটতে, উঠতে পারি না স্বাভাবিকভাবে। চিন্তা করলাম একি ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! যেখানে আমার ১/১১-এর মামলাটি তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা দুদকের নির্ধারিত কোর্টে না পাঠিয়ে পাঠালেন বিচারপতি নাছিম সাহেবের দ্বৈত বেঞ্চে। কেননা মামলার বাদী দুদক কর্মকর্তা, তদন্ত কর্মকর্তা এবং যিনি চার্জশিট দিয়েছেন তার সাক্ষ্য প্রদানের সময় এভাবে সাক্ষ্য দিলেন, ‘জনাব মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিনের বিরুদ্ধে মেয়র হিসেবে, জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে, রাষ্ট্রদূত হিসেবে, মন্ত্রী হিসেবে কোনো অভিযোগ পাই নাই।’ মাননীয় বিচারপতি নাছিমের বেঞ্চে এ মামলাটি ১০ দিন শুনানি হয়। ১০ দিন শুনানি শেষে মাননীয় বিচারপতি দুদকের আইনজীবীকে প্রশ্ন করলেন- এ অবস্থায় আপনারা কেন মীর নাছির সাহেবের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিলেন? এবং আদালত চলাকালীন ঘোষণা দিলেন? আমি মধ্যাহ্নবিরতির পর জাজমেন্ট দেব। আমি মসজিদে জোহরের নামাজ আদায় করে আল্লাহর কাছে শোকর করলাম, হে আল্লাহ! তুমি বড় মহান, আজকে বিচারক বললেন আমি নির্দোষ। হে আল্লাহ! আমি আর কত কষ্ট সইব। স্ত্রী, কন্যা, বোনকে রেখে আসতে হলো জান্নাতুল বাকিতে। প্রাণাধিক প্রিয়তমা স্ত্রী ডালিয়াকে, কলিজার টুকরো মেয়ে নুসরাতকে হারিয়ে আমি পাগলপ্রায়। আজকের এ রায় হয়তো আমাকে নতুনভাবে আশার আলো দেখাবে। নামাজ শেষে শুনি চিফ জাস্টিস মহোদয় বেঞ্চ ভেঙে দিয়েছেন। চরম হতাশায় বাসায় ফিরে গেলাম। তারপর দেখলাম মামলা দেওয়া হলো মাননীয় বিচারপতি আবদুল হাকিমের কোর্টে। তাঁর কোর্টে ১৫ দিন শুনানিকালে আমার আইনজীবী বিশ্বাস করতে বাধ্য হলেন, তিনিও আগের বিচারপতির মতো একই রকম দুদককে তাদের কীর্তিকলাপের জন্য প্রশ্ন করে আমাকে খালাস দেবেন। কিন্তু হিতে বিপরীত হলো। তিনি খালাস না দিয়ে কনভিকশন করে দিলেন। কোনো শক্তিকে পরোয়া না করে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখা বিচারকদের পূতঃপবিত্র দায়িত্ব।

সম্প্রতি দিল্লিতে একজন সংসদ সদস্য একজন মহিলাকে ধর্ষণ করেন। দিল্লির সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা সিদ্ধান্ত নিলেন যিনি ওই মহিলাকে ধর্ষণ করেছেন তার পক্ষে কেউ ওকালতি করবেন না। দেখা গেল একজন আইনজীবী ওই ধর্ষণকারীর পক্ষে ওকালতনামা দিয়ে কোর্টে সাধারণ আইনজীবীদের হাতে হেনস্তা হয়েছেন। আর এ ঘটনা দিল্লির সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করায় তিনি সুয়োমটো রুল ইস্যু করে কেউ তার বিচার পাওয়ার পথে বাধার সৃষ্টি করলে তার বিরুদ্ধে দিল্লির পুলিশপ্রধানকে আদেশ দিলেন ওদের গ্রেফতার করার জন্য। এই সেই গণতন্ত্রের দেশ যেখানে বিচার বিভাগ হচ্ছে সংবিধানের রক্ষক বা গার্জিয়ান। আমাদের দেশ সেদিনের অপেক্ষায় আছে। এ বিচার বিভাগ উচ্চৈঃস্বরে বলবেন, আমরা আমাদের স্বাধীনতা জীবন দিয়ে হলেও রক্ষা করব। জাতি পাবে স্বস্তির নিঃশ্বাস।

লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত, মেয়র, মন্ত্রী ও বিএনপির সহসভাপতি

সর্বশেষ খবর