রবিবার, ২০ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

আদমজী কোর্ট : পেছনে দেখা

হোসেন আবদুল মান্নান

চাকরি জীবনের শেষ প্রান্তে এসে মাত্র কয়েক মাসের জন্য বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব নিযুক্ত হয়েছিলাম। এ কথা অনস্বীকার্য যে, সৃষ্টিশীল কর্মের কথা বিবেচনায় আনলে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি মন্ত্রণালয়। যদিও বাহ্যিক জনমতে তার প্রতিফলন সীমিত। মূলত দুটো মন্ত্রণালয়কে একীভূত করে বর্তমানে এর দাফতরিক কাজ পরিচালিত হচ্ছে। কয়েক বছর আগেও বস্ত্র এবং পাট পৃথক মন্ত্রণালয় হিসেবে চালু ছিল। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের নিরিখে দেখলে এই উভয় খাত সন্দেহাতীতভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।  বলা যায়, বস্ত্র ও পাট বাঙালির চিরকালীন জীবন-ইতিহাসেরও অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং ধারক বাহক। জানা যায়, জনস্বার্থ এবং দৈনন্দিন কাজের সুবিধার্থে ২০০৪ সালে সরকার দুটো মন্ত্রণালয়কে একত্রিত করে দেয়। বর্তমানে বেশ কতগুলো ছোট-বড় দফতর, সংস্থার সমন্বয়ে মন্ত্রণালয়টি পরিচালিত হচ্ছে। অপরাপর মন্ত্রণালয়/বিভাগের মতো এখানেও পাট এবং বস্ত্রবিষয়ক সংযুক্ত ডিপার্টমেন্টসমূহ থেকে মাঠ পর্যায়ে সরকারি নীতি ও সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়ন করে চলেছে।

২) প্রজাতন্ত্রের সরকারি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমি একান্ত ব্যক্তিগত আগ্রহে তথা কৌতূহলবশত ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহীর কয়েকটি পাটকল স্থাপনা পরিদর্শন করেছিলাম। তখন গভীর অভিনিবেশ নিয়ে লক্ষ্য করেছি এর বৃহদাকার অবয়বের নিষ্প্রাণ পরিত্যক্ততা, অনেক দিন মানুষের পদচিহ্ন পড়েনি এমন বিশাল উন্মুক্ত মাঠ, সুরম্য আবাসিক এলাকা, সুদীর্ঘ আয়তনের ভবন ও ভিতরের মূল্যবান যন্ত্রাংশের নীরব কান্না এবং নিঃশব্দ আহাজারি। বিশেষ করে চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকে গড়ে ওঠা পাটশিল্প-সংশ্লিষ্ট কারখানাগুলো আমাকে তাৎক্ষণিকভাবে নির্বাক ও বেদনার্ত করেছিল। প্রজাতন্ত্রের একজন নিরঙ্কুশ স্বদেশজীবী কর্মচারী হিসেবে প্রথম দর্শনেই অশ্রুসজল হওয়া ব্যতীত আমার কোনো উপায় ছিল না। এটা সবাই অবহিত, আমাদের দেশের প্রায় সবকটি পাটকল কোনো না কোনো নদীর তীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। যদ্দুর জানি আজ অবধি খুলনার ভৈরব নদী ছাড়া অন্য নদীগুলো যেন স্রোতহারা, দূষণাক্রান্ত এবং জীবন্মৃত। বলাবাহুল্য, এদেশে রেলওয়ে এবং পাট মন্ত্রণালয়ের স্থাবর সম্পত্তি সবচেয়ে বেশি। আজকের পাটকলের বিমর্ষ চেহারার সঙ্গে একাকার হয়ে আছে তীরবর্তী নদীর চেহারা। কালের মৌন সাক্ষী হয়ে আছে নদীগুলো। এমনকি এক সময়ের রমরমা জৌলুস-ঝরা পাটের আঁশ থেকেও যেন সরে গেছে সোনালি বাহার। মিলের কর্মহীন ছদ্ম-বেকার কর্মচারীদের দুই চোখের পাতার নিচে অনিশ্চিত বিষণ্ণœতার কালো ছায়া। মনে হয়, নদীর ঘোলাটে জলের ওপর প্রতিদিন নিভৃতে ঝরে পড়ছে এদের চোখের জল। ভাবছিলাম, আমরা কি পরিবেশবান্ধব প্রকৃতি প্রদত্ত দেশীয় জাতের পাটের আঁশ থেকে শুধু ব্যাগ বা ছালাও প্রস্তুত করতে পারি না? যেখানে খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয় পর্যাপ্ত পরিমাণে ব্যাগ ক্রয় করছে বা আমদানি করছে।

এখানে প্রাসঙ্গিক যে, বর্তমানে বিজেএমসির আওতায় ২৫টি জুট মিল রয়েছে। তা ছাড়াও ছয়টি বৃহৎ আকারের মিল আছে, যেমন- করিম, লতিফ বাওয়ানী, ইউ. এম. সি. আমিন, প্লাটিনাম জুবিলী ও ক্রিসেন্ট জুট মিল। ইতোমধ্যে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে প্রায় ৭৫ হাজার শ্রমিককে সরকার তাদের ন্যায্য দাবি ও পাওনা পরিশোধ সাপেক্ষে মিল থেকে তাদের চাকরিকালের অবসান ঘটায়। তবে এখনো ৯৫৪ জন কর্মকর্তা এবং ১ হাজার ৫৭৩ জন কর্মচারী নিজ নিজ পদে বহাল আছেন। অথচ ২০২০ সালের মাঝামাঝি থেকে মিলগুলোর উৎপাদন কাজ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ রয়েছে। জানা যায়, বর্তমান পরিস্থিতিতে অন্তত ২ হাজার ৫২৭ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর তেমন কোনো কাজ নেই। যদিও যথানিয়মে তাদের বেতন-ভাতাদি পরিশোধ করা হচ্ছে। কাজের বিনিময়েই জীবিকা হতে হয়। এর উল্টোটা হলে ফল কখনো ভালো হয় না, শুভ হয় না। মিলগুলোর ভিতরের বিরাজমান মহাকালের এমন স্তব্ধতার অবসান কবে? এর ভবিষ্যৎ কোথায়? অপেক্ষার প্রহর শেষ কবে? এমন সীমাহীন অপচয় ও বন্ধ্যত্বের জন্য দায়ী কারা?

ইতিহাস বলে, পৃথিবীতে শ্রমিক শ্রেণির শ্রমে এবং নেতৃত্বেই সভ্যতার ভিত রচিত হয়েছে। কিন্তু আমরা কতিপয় প্রাইভেট সেক্টর ছাড়া পাবলিক এন্টারপ্রাইজগুলোতে শ্রমিকের শ্রম গ্রহণ করতে পারছি না কেন? এসব পাহাড়সমান প্রশ্নের সরল কোনো উত্তর নেই। গবেষণার পর গবেষণা চলছে এবং অনাগতকাল চলবে। তবু বলব, কেবল সময় সবকিছু অবলীলায় হজম করতে পারে। সময়ই প্রকৃত নীলকণ্ঠ।

৩) আদমজী জুট মিল সম্পর্কে আমরা সবাই জানি। বলা যায়, একসময় নারায়ণগঞ্জ এবং আদমজী মিল প্রায় সমার্থক নামে পরিণত হয়েছিল। শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে প্রায় ৩০০ একর জমির ওপর গড়ে উঠেছিল এ বিশ্ববিখ্যাত জুট মিল। এদেশের পাটশিল্পের জয়জয়ন্তী ঘটে এর হাত ধরেই। রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের জন্ম নেওয়ার অব্যবহিত পরেই ১৯৫০ সালে এ পাটকলের যাত্রা শুরু হয়। এর প্রতিষ্ঠাতা আবদুল ওয়াহিদ আদমজী। তার পূর্ব পুরুষ মূলত গুজরাটের অধিবাসী ছিলেন। আদমজীকে একসময় স্কটল্যান্ডের ডান্ডির সঙ্গে তুলনা করে বলা হতো প্রাচ্যের ডান্ডি। আদমজী গ্রুপ অব কোম্পানি ছিল এর স্বত্বাধিকারী। যারা ১৯৭১ সাল অবধি এর মালিকানা ধরে রেখেছিলেন। ষাটের দশকে তারা ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তানে বেশ কিছু জনহিতকর উদ্যোগও হাতে নিয়েছিল। তারা ১৯৬০ সালে ঢাকায় আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। গুল মোহাম্মদ আদমজীর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। মতিঝিল শিল্পাঞ্চলে তারা আদমজী সন্স লিমিটেড নামে এক বিশাল পারিবারিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এর দাফতরিক কার্যক্রম পরিচালনার নিমিত্ত আদমজী কোর্ট স্থাপন করেন। উল্লেখ্য, আদমজীরা তৎকালীন পাকিস্তানের বিখ্যাত ২২ পরিবারের অন্যতম একজন ছিলেন। বলা হয়, তারা ছিলেন জাত ব্যবসায়ী।

৪) আদমজী সন্স লিমিটেডের অধীনে মতিঝিলে ৪৮.৬ কাঠা জমির ওপর নির্মিত তিনটি বহুতল ভবন রয়েছে। এতে প্রায় দুই লাখ বর্গফুট জায়গা রয়েছে। এখানে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক, বীমাসহ ৩৮টি অফিস বিদ্যমান। এতে ভাড়া বাবদ মাসিক আয় হয় প্রায় ৯০ লাখ টাকা। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত পদাধিকারবলে এর প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করেন বিজেএমসির চেয়ারম্যান। ১৯৯১ সাল থেকে পাট সচিব স্বয়ং প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তৎকালীন সচিব এম আসফ্উদ্দৌলা প্রথম প্রশাসক হন। সরকারি ব্যবস্থাপনায় চলছে বিধায় এখনো এমন মূল্যবান সম্পত্তি বেহাত হয়নি। তবে এমন আশঙ্কার যথেষ্ট কারণ বিদ্যমান আছে। ভাড়াটিয়া কর্তৃক স্থায়ীভাবে দখল করার লক্ষ্যে আদমজী সন্স লিমিটেডের পক্ষে- বিপক্ষে অন্তত ১৬টি মামলা নিম্ন এবং উচ্চ আদালতে চলমান। একাধিক রিট মামলাও রয়েছে। অনেকে ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট দায়ের করে কালক্ষেপণ করে চলেছে। মনে হয়, বিশাল এ সম্পত্তি ও রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ঐতিহাসিক এ কার্যালয়ের প্রতি সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এখনো বাস্তবভিত্তিক কোনো পরিকল্পনা নেই।

৫) এ মন্ত্রণালয়ের অধীন অনেক দফতর/সংস্থা কাজ করছে। অফিসগুলো রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্ত এবং এদিক-ওদিক অবস্থিত। বিশেষ বিশেষ দফতরসমূহের মধ্যে বিজেএমসি, বিটিএমসি, বস্ত্র অধিদফতর, পাট অধিদফতর, তাঁতবোর্ড, রেশম উন্নয়ন বোর্ড, বিজেসি, জেডিপিসি ইত্যাদি। অথচ স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ১৯৭২ সাল থেকেই সরকারি সিদ্ধান্তে আদমজী সন্স লি. একটি পরিত্যক্ত সম্পত্তি। রাজধানীর মতিঝিলে আদমজী কোর্টের বিস্তীর্ণ স্থানে একটা আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর বহুতল ভবন নির্মাণের মাধ্যমে এসব দফতর সংস্থার বেশ কয়েকটিকে স্থানান্তরিত করা যায়; একই সঙ্গে অন্যান্য প্রাইভেট অফিসের বিপরীতে ভাড়া বাবদ বছরে কোটি কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। তা ছাড়া সরকারের একচ্ছত্র মালিকানা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সৃষ্টি করা যায় ‘পাট-বস্ত্র ভবন’ অথবা ‘সোনালি আঁশ ভবন’। তৈরি করা যায় আকর্ষণীয় ঝলমলে দৃষ্টিনন্দন আকাশস্পর্শী অট্টালিকা। এ বিষয়ে বর্তমান সরকারের সক্ষমতার কোনো ঘাটতি নেই। ইতোমধ্যে সরকার অসংখ্য মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে তা প্রমাণ করেছে।  সরকারকে সব সময় সাশ্রয়ী এবং অপচয় রোধকল্পে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নেওয়ার পথে সার্বিক সহযোগিতা করার দায়িত্ব আমলাতন্ত্রের ওপরই বর্তায়। সুদীর্ঘ তিন দশক পেরিয়ে মনে হয়, আমরা এ জায়গায় পৌঁছাতে এখনো যথেষ্ট পিছিয়ে আছি।  আমরা সৎ সাহসী ও দেশপ্রেমিক গণকর্মচারী চাই। আমাদের মাতৃভূমি ও মানুষ হোক প্রথম পাঠ, প্রথম স্লোগান।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গল্পকার।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর