রবিবার, ২০ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

সামাজিক অপরাধ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়

জহিরুল হক শামীম

দেশে সামাজিক অস্থিরতার কারণে খুন-ধর্ষণসহ নানা ধরনের সামাজিক অপরাধের ঘটনা বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। পত্রপত্রিকার পাতা খুললেই দেখা যায়, সন্তানের হাতে বাবা খুন, বাবা কিংবা মায়ের হাতে সন্তান, স্বামীর হাতে স্ত্রী, স্ত্রীর হাতে স্বামী অথবা ভাইয়ের হাতে ভাই। এমন সংবাদে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ছে জনসাধারণের মাঝে। শিশু হত্যা, শিশু ধর্ষণ, গণধর্ষণ, পারিবারিক ও সামাজিক কোন্দলে হতাহতের মতো অপ্রত্যাশিত ঘটনাও প্রায়ই ঘটছে। বাংলাদেশ প্রতিদিন-এ ১১ নভেম্বর ২০২২-এ সামাজিক খুনোখুনি বর্বরতা শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত কয়েকটি খবরের শিরোনাম তুলে ধরলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে-‘গুপ্তধনের আশায় ভাগিনাকে নদীতে ফেলে হত্যা’, ‘সিলেটে নারীর গলা কাটা লাশ উদ্ধার’, ‘হত্যার পর ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল প্রান্তির লাশ’ ও ‘বান্দরবানে মাদরাসার দফতরি খুনে যুবক গ্রেফতার’। এ ছাড়াও গত ৩১ অক্টোবর ২০২২ প্রকাশিত খবরের শিরোনাম ‘ছোট বোনের প্রেমিক খুন করল বড় বোনের প্রেমিকাকে’, ৬ নভেম্বর প্রকাশিত খবরের শিরোনাম-‘শিশুর সামনে বাবাকে হত্যা’, ‘স্কুলছাত্র খুন’, ৮ নভেম্বর প্রকাশিত খবরের শিরোনাম ‘কুষ্টিয়ায় বাড়িতে স্কুলশিক্ষিকাকে কুপিয়ে হত্যা’, নারায়ণগঞ্জে ঘুমন্ত মাকে কুপিয়ে হত্যা করল ছেলে’, ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জে ছেলের হাতে বাবা খুন’ ইত্যাদি। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে, ২০২২ এর ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে ধর্ষণের পর ৩১টি হত্যার ঘটনা ঘটেছে। ৬৪১ জন নারী যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে। শিশুদের বিরুদ্ধে ৭৭০টি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৩৯২টি শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার, ৩৪৭টি শিশুকে হত্যা এবং ৯৫টি শিশুকে নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়েছে। এ ছাড়া ৩২৪টি হত্যার ঘটনা ঘটেছে পরিবারের মধ্যে। এর মধ্যে ১৩৪টি হত্যার ঘটনা ঘটেছে স্বামীর দ্বারা। উচ্চ আদালতের তথ্য অনুযায়ী গত ৩০ জুন ২০২২ পর্যন্ত দেশের ৯৯টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৪২ হাজার ১১৪টি। এসব আদালতে মোট বিচারাধীন মামলা ১ লাখ ৭৮ হাজার ২৩১টি। এসব মামলার অধিকাংশই ধর্ষণ, যৌতুকের দাবিতে নির্যাতন ও হত্যা, অপহরণ, যৌন নিপীড়ন, আত্মহত্যার প্ররোচনা, দাহ্য পদার্থ দিয়ে ক্ষতি করা, ভিক্ষাবৃত্তির উদ্দেশ্যে শিশুর অঙ্গহানি সংক্রান্ত। পুলিশ সদর দফতরের তথ্যানুসারে ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে সারা দেশে ৬০০-র বেশি থানায় ৭ হাজার ৩৫০টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ৩ হাজার ৫২৩টি ধর্ষণ মামলা। সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করছেন, মূল্যবোধের অভাব তথা নীতিহীনতা শিশু ও নারীর প্রতি সহিংসতার অন্যতম কারণ। অপরাধ বিশ্লেষক, সমাজবিজ্ঞানী ও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, সামাজিক অস্থিরতা, বিচারের দীর্ঘসূত্রতা ও বিকৃত মানসিকতা শিশুর প্রতি সহিংসতা বাড়ার কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম। মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের শিক্ষক উমর ফারুক তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, দেশের ৫ থেকে ১২ বছরের শিশু-কিশোরীদের মধ্যে ৭০ শতাংশ কোনো না কোনোভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার। এ ছাড়া স্কুল ও কলেজপড়ুয়া ছেলেমেয়েদের ৬৫ শতাংশ যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। দুই ক্ষেত্রেই যৌন নির্যাতনকারীরা পরিবারের নিকটাত্মীয়, যা প্রকাশ হয় না। অপরাধ বিজ্ঞানীদের মতে, বিচার দীর্ঘায়িত হলে বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা হারিয়ে যায়। অপরাধী ভুল বার্তা পায়। অভিযোগ রয়েছে মামলা সাক্ষ্য গ্রহণের পর্যায়ে সবচেয়ে দেরি হয়। সাক্ষীর ঠিকানা পরিবর্তন, সাক্ষ্য দিতে অনাগ্রহ ইত্যাদির কারণেও মামলা জট বাড়ে। দীর্ঘ বিরতিতে মামলার শুনানির তারিখ, আদালতের স্থান সংকট, বিচারক সংকটও মামলা জটের অন্যতম কারণ। মামলার বিচার ১৮০ দিনে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও পাঁচ বছর ধরে চলছে এমন বিচারাধীন মামলার প্রায় ৫০ শতাংশ। আইনে ‘অতি দ্রুত’ ও ‘যুক্তিসংগত’ সময়ের মধ্যে মেডিকেল পরীক্ষা শেষ না করলে দায়ী চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা থাকলেও ডিএনএ প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দিষ্ট সময়ের উল্লেখ নেই। এ বিষয়ে মামলা তদন্ত সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ মেডিকেল ও ডিএনএ প্রতিবেদনের জন্য ঘুরতে ঘুরতে পুলিশের জুতার তলা ক্ষয় হয়ে যায়।

সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রতিটি পরিবারেরই ভিন্ন ভিন্ন সমস্যা থাকে। আর অনেক কারণ একত্রিত হয়ে এ ধরনের পারিবারিক হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়। তবে এর পেছনে উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে হতাশা, পরকীয়া, আবেগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কমে যাওয়া, নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ইত্যাদি। নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের অভাবে পরিবারিক বন্ধন ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। পাশাপাশি সহনশীলতার মাত্রা কমে যাচ্ছে। সমাজের একাংশ এতটাই ভোগবিলাসী জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে যে, এই সমাজে পারিবারিক কাঠামো থাকলেও তা নামমাত্র। কোনো ধরনের স্বাভাবিক বোঝাপড়া তাদের মধ্যে নেই। ফলে বাবা-মা-সন্তানের মধ্যেও স্নেহের বন্ধন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া সোশ্যাল মিডিয়া এবং সমাজ বাস্তবতা থেকেও অপরাধের পাঠ নিচ্ছে কিশোর-তরুণরা। এ পরিস্থিতি সামাল দিতে পারিবারিক বন্ধন জোরদার করতে হবে। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বোঝাপড়া বাড়াতে হবে। চাহিদা এবং প্রাপ্তির মধ্যে ব্যবধান কমাতে হবে। ছোটবেলা থেকেই সন্তানকে নৈতিক শিক্ষা এবং সামাজিক মূল্যবোধ সম্পর্কে শিক্ষা দিতে হবে। ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান এবং সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দোষারোপ করে বা তাদের ওপর দায় চাপিয়ে সামাজিক অপরাধ কমানো যাবে না। বাস্তবতা হলো পুলিশের বা অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একার পক্ষে সামাজিক অপরাধ সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। এ জন্য দরকার পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের নিরন্তর চর্চা। সহিংসতা প্রতিরোধে পরিবারকে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর