গত এপ্রিলে নেদারল্যান্ডস যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে রটারডাম বন্দরের পাশে দেখেছি বিশ্বের প্রথম ভাসমান গরুর খামার। পিটার ভ্যান উইঙ্গারডেন ও মিনকে ভ্যান উইঙ্গারডেন দম্পতির পরিচালনায় গরুর খামারটি সারা পৃথিবীতেই সাড়া ফেলেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আঁচ করেই পৃথিবীর মানুষ খুঁজছে আগামীর নিরাপত্তা, বিভিন্ন অভিযোজন কৌশল। সেই প্রেক্ষাপট থেকেই ভাসমান খামার ব্যবস্থাপনা চলে এসেছে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভাসমান কৃষি ব্যবস্থাপনা নিয়ে বিস্তর গবেষণার প্রয়োজন আছে। বিশেষ করে যেসব দেশ সমুদ্রতীরবর্তী। নেদারল্যান্ডসের মতোই আমাদের বাংলাদেশ একটি ব-দ্বীপ রাষ্ট্র। গরুর খামার না হোক, আমাদের রয়েছে শত বছরের পুরনো ভাসমান চাষের ঐতিহ্য। দেশের দক্ষিণ-মধ্যাঞ্চলে ৩০০-৪০০ বছর ধরে ভাসমান বাগানে সবজি চাষ হয়ে আসছে। স্থানীয় ভাষায় এ পদ্ধতিকে বলে ধাপ বা বায়রা। প্রকৃত অর্থে বাগানগুলো মূলত ভাসমান কৃত্রিম দ্বীপ। জোয়ার-ভাটায় পানির স্তরের হ্রাস-বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ধাপগুলোও ওঠানামা করে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের আদি এক চাষ পদ্ধতি এ ভাসমান চাষ। দক্ষিণাঞ্চলের বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি ও গোপালগঞ্জের কিছু অংশে ভাসমান পদ্ধতিতে চাষাবাদ হয়ে আসছে বছরের পর বছর। আশির দশকের মাঝামাঝি এ চাষ পদ্ধতি প্রথম জনসম্মুখে তুলে আনার সুযোগ হয়েছিল বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। তারপর চ্যানেল আইয়ের হৃদয়ে মাটি ও মানুষের ক্যামেরাতেও বহুবার দেশের প্রাচীন এ চাষ পদ্ধতি আমি তুলে ধরেছি।
আমাদের আদি ঐতিহ্যের এ ভাসমান চাষ ব্যবস্থাপনা কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের জীবন-জীবিকার পরিচিতির প্রশ্নেও অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করছে। যা বিবেচনায় এনে ২০১৫ সালে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা দক্ষিণের ভাসমান চাষ ব্যবস্থাকে বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী চাষ পদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। গত নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে এক ভোরে রওনা হলাম পিরোজপুর থেকে নাজিরপুরের দিকে। পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার নিচু এলাকা দেউলবাড়ি দোবড়া, মালিখালী ও দীর্ঘা ইউনিয়নের মুগারঝোর, কলারদোয়ানিয়া, দীর্ঘা, বৈঠাকাঠা, খলনি, মেদা, সাচিয়া, পাকুরিয়া, গাঁওখালী, পদ্মডুবি অনেক গ্রামে ভাসমান পদ্ধতিতে চাষাবাদ হচ্ছে। মুগারঝোর এলাকায় সবচেয়ে বেশি জায়গাজুড়ে চাষ হয় বলে আমাদের গন্তব্য ছিল সেখানেই। সকালের রোদ তখনো উঁকি দেয়নি। নাজিরপুরে পথের ধারের এক হোটেলে নাস্তা সেরে আবার চলা শুরু হলো। শীতের আগমন বেশ টের পাওয়া যাচ্ছিল। কালীগঙ্গা নদীর তীর ঘেঁষে আমরা চলছিলাম, আর দেখছিলাম বরিশালের চিরায়ত গ্রাম-বাংলার রূপ। প্রতিটি বাড়ির সামনে ছোট্ট নৌকা বাঁধা। নৌকাই এ অঞ্চলের প্রধান বাহন। কেউ কেউ নদী থেকে মাছ ধরে ফিরছে। কেউবা নৌকায় করে যাচ্ছেন সকালের হাটে।
![](/assets/archive/images/Print-Edition/2022/December/11-12-2022/BD-Pratidin_2022-12-11-24.jpg)
মুগারঝোরে যখন পৌঁছালাম ততক্ষণে সূর্য উঠে গেছে। জোয়ারের পানি নামতে শুরু করেছে। একটা নৌকা নিয়ে দ্রুত নেমে গেলাম ভাসমান চাষের মাঠে। বিশাল এলাকায় সারি সারি শাকসবজির বেড। নিচু জমিতে জমে থাকে কচুরিপানা, শ্যাওলা, দুলালী বন, ফেনা ঘাসসহ বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদের স্তূপে তৈরি সারি সারি ধাপ। পানির ওপরে ভাসমান এই একেকটি ধাপ ৭০ থেকে ৮০ ফুট লম্বা ও ৫ থেকে ৬ ফুট চওড়া। অনেকটা ভেলার মতো কাঠামো। এভাবেই গড়ে ওঠে ছোট ছোট দ্বীপ আকারের ভাসমান সবজি খেত। এরপর সেখানে বিশেষ পদ্ধতিতে সবজির চারা রোপণ করা হয়। তবে এর আগে যখন সন্ধ্যা নদী পাড় হয়ে বানারিপাড়া, উমরের চর গিয়েছিলাম ভাসমান চাষ পদ্ধতি দেখতে, তখন ধাপগুলো এত লম্বা ছিল না। একেকটি ধাপ ছিল ৪০ থেকে ৫০ ফুট লম্বা। তখন যারা ধাপ তৈরি করতেন তারাই মূলত চাষ করতেন। আর এখন কৃষক ধাপ তৈরি করে জমির মতোই লিজ বা ভাড়া দেন। ভাসমান বা ধাপ পদ্ধতিতে সরাসরি বীজ বপন সম্ভব না হওয়ায় কৃষক প্রতিটি বীজের জন্য এক ধরনের আধার তৈরি করেন। অর্থাৎ একমুঠো টেপাপানা বা কচুরিপানা ও নারিকেল ছোবড়ার গুঁড়া দিয়ে তৈরি করা ছোট বলের মতো স্তূপ। স্থানীয় ভাষায় যাকে বলা হয় দৌলা। এ দৌলাতেই প্রথম বীজ বপন করা হয়। যা পরে স্থানান্তর করা হয় এসব ধাপে। এভাবে সম্পূর্ণ অর্গানিক পদ্ধতিতে উৎপাদিত সবজি চারার দারুণ চাহিদা রয়েছে সারা দেশে। শুধু দেশেই নয়। কয়েক দিন আগে মালয়েশিয়ায় গিয়েছিলাম। সেখানে বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের হাতে সম্প্রসারিত হচ্ছে সেখানকার কৃষিবাণিজ্য। তাদের কাছেও শুনেছি এখানকার সবজি চারার সুনাম। লাউ, কুমড়া, পেঁপে, বেগুন, বাঁধাকপি, করলা, ঝিঙে, শিম, বরবটি, টমেটো ও শসাসহ বিভিন্ন সবজির চারা উৎপাদন করা হচ্ছে এখানে। যা কিনতে প্রতিদিন কৃষক ও পাইকার আসে। একদিকে চলছে পরিচর্যা, অন্যদিকে বেচাবিক্রি।
বেডের পরিচর্যা করছিলেন কৃষক আক্তারুজ্জামান। তিনি প্রায় ৩০ বছর ধরে এ কৃষির সঙ্গে যুক্ত। এর আগে তার বাপ-দাদারাও এ পদ্ধতিতে চাষাবাদ করেছেন। কথা বলি তার সঙ্গে। তিনি বলেন, জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব তারা বেশ ভালোভাবেই টের পাচ্ছেন। আগে এখানে কোনো রকম সার বা কীটনাশক ছাড়াই চারা উৎপাদন ও সবজি চাষ করা যেত। কিন্তু এখন চারাতে এক ধরনের মরিচার মতো দাগ দেখা যায়, বাড়ছে নানান রকম ভাইরাসের আক্রমণও। বেশ কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারলাম। বেশ পরিবর্তন এসেছে এখানকার চাষ ব্যবস্থাপনায়। শতভাগ প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে চলা এ কৃষি অনুশীলনেও এখন ব্যবহার হচ্ছে সার-কীটনাশক। কৃষি বাণিজ্যমুখী হওয়ায় ফসলের অধিক উৎপাদন ও উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় টিকে থাকার প্রশ্নে কৃষক দিনে দিনে বাড়িয়ে চলছে সার ও কীটনাশকের ব্যবহার। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় কৃষি বিভাগের প্রশিক্ষণকে দায়ী করেছেন কয়েকজন। একজন বললেন, ‘তারা আমাদের ট্রেনিং দেন। কিন্তু আমরা এটা করে আসছি শৈশব থেকে, আমরাই তাদের শিখিয়েছি। এখন তারা আমাদের শেখাচ্ছে। তারা বলে সার দিতে, কীটনাশক দিতে, কিন্তু আগে কখনো আমাদের এসব ব্যবহার করতে হয়নি।’
কৃষকদের কাছ থেকে সবজি চারা কিনে নেন পাইকারি বিক্রেতারা। তারপর বৈঠাকাটা ভাসমান বাজার হয়ে সেই চারা চলে যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। আগেই বলেছি এ অঞ্চলের সবজি চারারা বিশেষ চাহিদা রয়েছে। বেশির ভাগ কৃষক ভাসমান ধাপ বা বেড ভাড়া নিয়ে চাষ করছেন। ছোট একেকটি বেডের ভাড়া ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা। কৃষক শহিদুল জানালেন, ৩২টি ধাপে সবজি ও চারা উৎপাদন করে আগে ভালো লাভ হলেও দিনে দিনে লাভের পরিমাণ কমছে। সার-কীটনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় বাড়ছে উৎপাদন খরচও। চাষিরা বলছিলেন নিজস্ব জমি নেই বলে দরকারে ঋণ পান না তারা। আবার প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ফসলহানির মুখেও পড়তে হয় তাদের। এ জন্য সেখানে দরকার ফসলের বীমা চালু করা। নিরাপদ সবজি উৎপাদনের অন্যতম ক্ষেত্র দক্ষিণাঞ্চলের ভাসমান চাষকে টিকিয়ে রাখতে দরকার সরকারের আরও সুপরিকল্পনা। তা না হলে জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা কারণে আগামীতে এ চাষব্যবস্থা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। জলবায়ু পরিবর্তনের বৈরিতা মোকাবিলায় কৃষকরা নিজেদের ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থার সংবেদনশীলতা অনুধাবন করেই ফিরে আসছেন ভাসমান চাষাবাদে। বরিশাল এবং পিরোজপুর ছাড়াও গোপালগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জসহ বেশকিছু জেলায় ভাসমান চাষাবাদ এখন খুব সহজেই চোখে পড়ে।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ভূমিহীন জনসংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এ অবস্থায় ২০৫০ সাল নাগাদ দেশে সাতজনের একজন বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়বেন বলে আশঙ্কা করছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। এ কারণেই চাষাবাদ ছেড়ে জীবিকা নির্বাহের বিকল্প উপায় বেছে নিচ্ছেন অনেক কৃষক। অন্যদিকে পানির কাছাকাছি বসবাসকারী জনগোষ্ঠী খাদ্যের নিরাপদ সংস্থানেই আবিষ্কার করেছে ভাসমান পদ্ধতি। তারা নিজেদের মতো করে টিকে থাকার কৌশল আয়ত্ত করে নিচ্ছিল। জলবায়ু পরিবর্তনে বিপুল জনসংখ্যা নিয়ে ঝুঁকির মুখে থাকা বাংলাদেশে এ কৃষি অনুশীলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (ফাও) মতে, ভাসমান এ চাষব্যবস্থা প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থানকে বিঘ্নিত না করে, জলবায়ু পরিবর্তন সহনশীল কৃষির সম্ভাবনা যোগ করেছে অতীত ঐতিহ্য সংরক্ষণের মধ্য দিয়ে। শত শত বছর আগে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের কৃষক নিজেদের প্রয়োজনে নিজেরা ভাসমান কৃষিকে উদ্ভাবন করেছিল। যা অনুশীলনের মাধ্যমে এ অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ জীবিকা নির্বাহ করছে। এ পদ্ধতিটিকে মডেল হিসেবে নেওয়া যেতে পারে দেশের প্রায় ৩০ লাখ হেক্টর নিচু বা অতি নিচু এলাকার জন্য। বন্যা ও জলাবদ্ধতাপ্রবণ এলাকায় কৌশলটি ব্যবহার করে উৎপাদন হতে পারে সবজি, মসলা ও দরকারি ফসল। যা আগামীর পরিবর্তিত জলবায়ু মোকাবিলা করে টিকে থাকার ক্ষেত্রেও রাখতে পারে বড় অবদান। আমার বিশ্বাস, দেশের ঐতিহ্যবাহী ভাসমান কৃষিকে ধরে রাখতে এবং এর বাণিজ্যিক রূপ দিতে আগামীতে প্রয়োজনীয় নীতি-সহায়তা ও প্রণোদনা প্রদানে সরকারের আরও বাস্তবমুখী পরিকল্পনা থাকবে।
লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।