বৃহস্পতিবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

বৈধ বিলাসিতা নিন্দনীয় নয়

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

বৈধ বিলাসিতা নিন্দনীয় নয়

ইসলাম একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। পবিত্র কোরআন ও রসুল (সা.)-এর সিরাত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পুরো ধর্মব্যবস্থাটাই একটি ভারসাম্যপূর্ণ ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা অনেকেই এই ভারসাম্যের ব্যাপারটি ভুলে যাই। আমরা জ্ঞানে-গুণে, ইবাদতে-গুনাহে একপেশে হয়ে পড়ি। বহু জ্ঞানী আছে ইবাদত করে না। আবার বহু আবেদ আছে জ্ঞান-সাধনার পথে হাঁটে না। বহু আবেদ আছে ইবাদতের অহংকারে গুনাহগারদের ঘৃণা করে। আবার বহু গুনাহগার আছে ইবাদতকারী-আল্লাহওয়ালাদের নিয়ে ঠাট্টা করে। এগুলো সবই একপেশে জীবনের চরিত্র। জ্ঞানীকে যেমন ইবাদতের পরীক্ষা দিতে হবে, আবেদকে তেমনি জ্ঞানের সংস্পর্শে থাকতে হবে। একইভাবে আবেদ যেমন গুনাহগারের দিকে তাকিয়ে নিজের ইবাদতের অহংকার করবে না, তেমনি গুনাহগারকেও গুনাহ ছেড়ে ইবাদতের পথে ফিরে আসতে হবে।

ধর্ম নিয়ে আমাদের একপেশে দৃষ্টিভঙ্গির একটি উদাহরণ হলো, একদল মানুষের ধারণা ধার্মিক মানেই তাকে জীর্ণ-শীর্ণ গরিবি জীবন কাটাতে হবে। হুজুর (সা.) ও তাঁর সাহাবিরা গরিব ছিলেন। ধনাঢ্যতাকে নবীজি ঘৃণা করতেন। না, আসল ব্যাপার তা নয়। রসুল (সা.) এবং জলিলে কদর অনেক সাহাবি ধনী ছিলেন। তাদের অনেকেই বৈধ বিলাসিতা করতেন। বৈধ বিলাসিতা করার অনেক কারণের মধ্যে একটা এমন হতে পারে, দরিদ্রতার কারণে যেন মনে রিয়া ও অহংকার চলে না আসে। ইমাম গাজ্জালি (রহ.) এহইয়াউল উলুমুদ্দিনে বিখ্যাত সুফি ইবরাহিম বিন আদহামের এটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। তিনি ছিলেন বাদশাহ। বাদশাহি বালাখানা ছেড়ে কম্বল গায়ে তিনি মারেফাতে ইলাহির সাধনায় বেরিয়ে পড়েন। পরবর্তীতে তিনি বিখ্যাত সুফি হিসেবে মানবসমাজে ফিরে আসেন। সুফিরা বিলাসী জীবন, ভালো খাবার-দাবার ত্যাগ করেছিলেন। মানুষের মাঝে এ ধারণা বাসা বাঁধে যে, ধার্মিক মানেই গরিবি জীবন, আর অধার্মিক মানে হলো বিলাসিতার জীবন। মানুষের এ ভুল ধারণা ভেঙে দিতে প্রায়ই ইবরাহিম বিন আদহাম বাজারে যেতেন। বেছে বেছে দামি ফল, দামি পানীয় কিনে আনতেন। একদিন এক ভক্ত জিজ্ঞেস করল, ‘হুজুর! আপনি সুফি হয়েও নফসানিয়াতের চাহিদা অনুযায়ী ভালো ভালো খাবার খান কেন? জবাবে ইবরাহিম বিন আদহাম বললেন, ‘জীর্ণ কম্বল গায়ে দিলেই কেউ সুফি হয়ে যায় না। সুফি হতে হয় কালবের সাধনা করে। আমার আল্লাহ যখন খাওয়ান তখন আমি খাই। আর তিনি যখন আমার রিজিক সংকুচিত করে দেন তখন আমি রোজা রাখি। আসল সুফিয়ানা জীবন এটাই।’

তাবেয়িদের মধ্যে অন্যতম সুফি ছিলেন সুফিয়ান সাওরি (রহ.)। শরিয়তের পাশাপাশি মারেফাতি ইলমেও ছিলেন দক্ষ। তাফসির-হাদিস ও ফিকহে তার তুল্য আলেম কমই ছিলেন। তিনি নামাজের জন্য বের হওয়ার আগে গোশত, আঙ্গুর ও ফালুদা খেয়ে বের হতেন। সম্ভবত তিনি রসুল (সা.)-এর ওই হাদিসের ওপর আমল করতেন যেখানে রসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা ক্ষুধা অবস্থায় নামাজে দাঁড়িয়ো না। নয়তো ক্ষুধার কারণে নামাজে মন বসবে না।’

হজরত শেখ সাদি (রহ.) গুলিস্তা ও বোস্তায় একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। এক সুফি বাদশাহর দরবারে গিয়েছেন। সঙ্গে তাঁর ছেলেও ছিল। খাওয়ার সময় তিনি খুব অল্প খেয়েছেন। নামাজের সময় দীর্ঘ নামাজ পড়েছেন। বাদশাহ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি এসে ছেলেকে বললেন, ‘বাবা! এসো আমরা আবার খেয়ে নিই। তখন পেট ভরে খেতে পারিনি।’ জবাবে ছেলে বলল, ‘হে পিতা! তাহলে নামাজটাও আবার পড়ে নিন। কেননা, আপনার খাওয়া ও নামাজ দুটোই ছিল বাদশাহকে দেখানোর উদ্দেশ্যে। এমন খাওয়ার কারণে পেট যেমন ভরেনি, এমন নামাজে রুহও তাজা হবে না।’

সুফিদের মধ্যে একজন বিখ্যাত সুফি ছিলেন মালেক ইবনে দিনার (রহ.)। মানুষ যেন তাঁকে দেখে আল্লাহওয়ালা না বলে এবং তিনি যেন রিয়া থেকে বেঁচে থাকেন এই নিয়তে সব সময় তিনি দামি পোশাক পরতেন। নবীজির কলিজার টুকরা ইমাম হোসাইন (রা.) শীতের সময় একটি চাদর পরতেন। চাদরটির দাম ছিল ৫০ দিনার। শীত চলে গেলে চাদরটি বিক্রি করে সে অর্থ দান করে দিতেন। আবার শীত এলে দামি চাদর কিনতেন। তামিম দারি (রা.) ১ হাজার দিনার দিয়ে একটি চাদর কিনেছিলেন। সে চাদর গায়ে তিনি মসজিদে নামাজ পড়তেন। আসাদুল গাবা গ্রন্থে আবদুল্লাহ ইবনে হারেস সূত্রে বর্ণিত হাদিসে বলা হয়েছে, রসুল (সা.)-এর একটি দামি পোশাক ছিল যেটি ৭০০টি উটের সমপরিমাণ মূল্য দিয়ে কেনা। (শহিদুল মেহরাব, সাইয়েদ ওমর তেলমেসানী, ১৭৫ পৃষ্ঠা)।

এসব বর্ণনা থেকে এ দলিল নেওয়ার সুযোগ নেই যে, ইচ্ছামতো বিলাসিতা করার অনুমতি ইসলাম দিয়েছে। বরং এতটুকু বলা যায়, খাবারে যেমন কিঞ্চিত লবণ প্রয়োজন তেমনি জীবনেও পরিমাণ মতো বিলাসদ্রব্য প্রয়োজন। হজরত উসমান (রা.), তালহা (রা.) ও জোবায়ের (রা.) প্রচুর বিত্তশালী ছিলেন। পাশাপাশি তাঁরা আশারায়ে মুবাশশেরার তথা জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবিও ছিলেন। তাই সতর্ক থাকতে হবে বৈধ বিলাসিতার পথ ধরে অবৈধ গর্ব অহংকার যেন অন্তরে ও আচরণে বাসা না বাঁধে। আল্লাহ আমাদের বোঝার তৌফিক দিন। আমিন।

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি, পীর সাহেব, আউলিয়ানগর।

www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর