সোমবার, ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

ফসলের বীজের রাজনীতি

লাকী আক্তার

ফসলের বীজের রাজনীতি

বীজ হলো কৃষির মূল ভিত্তি। বীজকে বলা হয় নতুন সম্ভাবনা। বীজ মানেই বংশবিস্তার ও পরিচয়। বীজ হলো জীবন্ত প্রাণসত্তা। সুতরাং ভালো বীজ মানেই হলো ভালো ফসল। ফসলের মূল উপাদান বীজকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় নানান রাজনীতি। একই সঙ্গে রয়েছে বহুজাতিক করপোরেশনের কবলে বন্দি হয়ে, আমাদের কৃষকদের বীজের নিয়ন্ত্রণ হারানোর উপাখ্যান। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এসব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু গভীর আলোচনা, প্রতিবাদের দাবি রাখে। কেননা আমাদের দেশের সিংহভাগ মানুষ এখনো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। একটা সময় বীজ সংরক্ষণের মূল কাজের নিয়ন্ত্রণ ছিল আমাদের দেশের নারীদের হাতে। স্তরে স্তরে বীজের বাছাই, বীজকে রোদে শুকানো, সংরক্ষণ, পরিচর্যা, বিনিময় সব ধরনের কাজের এবং বীজ ব্যবস্থাপনার মূল নিয়ন্ত্রণ ছিল বাংলাদেশের গ্রামীণ নারীদের। অথচ বর্তমান সময়ে বীজের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে বহুজাতিক মনস্যান্টো, সিনজেনটা, বায়ার, কারগিল, ডুপন্টের মতো কোম্পানির হাতে। আমাদের গ্রামগুলো আজ আদিজাতের বীজ হারিয়ে ফেলে করপোরেট কোম্পানির হাতে বন্দি। জেনেটিক পরিবর্তন করে কোম্পানির গবেষণাগারের জিম্মায় জনগণের বীজের অধিকার।

কিন্তু প্রশ্ন হলো- আমাদের এই বীজ কেন করপোরেটের হাতে বন্দি হলো? কাদের নীতিমালার কারণে আমাদের দেশের কৃষকের হাতছাড়া হলো বীজ। অথচ ৫৬ হাজার বর্গমাইলের আমাদের এই জমিনে ছিল ১৮ হাজার জাতের ধানের বীজ। কালের পরিক্রমায় এসব ধানও বিলুপ্ত হয়ে গেছে। জানা যায়, এর মধ্যে ১২ হাজার ৪৮৭টি স্থানীয় ধানের নাম ছিল। অথচ এখন চলছে হাইব্রিড, উফশী এবং জিএমও বীজের বাজার। পরিসংখ্যান বলছে, দেশের সবজি বীজের পুরোটাই বহুজাতিক কোম্পানির প্যাকেটজাত হাইব্রিড বীজের দখলে।

বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তার প্রসঙ্গ এলেই সবুজ বিপ্লবের কথা উল্লেখ করা হয়। অথচ সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমেই যে উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজগুলো আনা হয়, তা ছিল আসলে সাধারণ জনতার কৃষি থেকে বহুজাতিকের দিকে কৃষিকে নিয়ে যাওয়ার একটা প্রয়াস। এরপর থেকেই বীজগুলোর অনন্য সাধারণ নামগুলো হারিয়ে যায়। আর এখন নতুন জাতের বীজের নাম মানে শুধুই কতগুলো নম্বর, সেখানে কোনো নান্দনিকতা নেই। সবুজ বিপ্লবের যন্ত্রণায় রাসায়নিকের তীব্র বিষে নীল হয়ে গেছে আমাদের ফসলের মাঠ, আমাদের কৃষি জমিন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো আমাদের বীজ-খাতে এই কোম্পানিগুলো গড়ে তুলেছে তাদের নিয়ন্ত্রিত উপনিবেশ। এখন শুধু বীজ নয়, পুরো কৃষিকেই আমাদের কৃষকের কাছ থেকে ছিনতাই করার প্রয়াস চলছে। কৃষক দিন দিন হয়ে যাচ্ছে দুর্বল, নিঃস্ব আর রিক্ত।

যেহেতু এখন আর বীজের নিয়ন্ত্রণ নেই কৃষকের হাতে। তাই সারা বছর কোম্পানির ওপর নির্ভর করতে হয় কৃষককে। প্রতি বছর পত্রিকায় পাতায় খবর বেরোয় বীজের হাহাকারে ভুগছে কৃষক। বীজ সংগ্রহের জন্য দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয়েছে কৃষকদের। এই সংকট নিত্য। মানসম্পন্ন বীজের প্যাকেট হুবহু নকল করার কারণেও প্রতি বছর বহু কৃষক নিঃস্ব হয়। যেহেতু কৃষকের নিজেদের কোনো বীজ নেই ফলে বাধ্য হয়েই তারা এসব কোম্পানির বীজ কেনে। প্রায়ই বিভিন্ন কোম্পানি বীজের প্যাকেটে নিম্নমানের এবং কম দামের বীজ ঢুকিয়ে দিয়ে কৃষকের সঙ্গে প্রতারণা করে। নকল এই বীজ প্রতিরোধে কঠোর আইন প্রণয়ন ও সামাজিকভাবে কোনো প্রতিরোধ নেই। প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে বিএডিসির নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে কৃষককে বীজ কিনতে হয়। বীজের মূল্যবৃদ্ধির দরুন ফসলের উৎপাদন খরচও দিন দিন নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। বিএডিসি কর্তৃক বীজের সরবরাহ চাহিদার চেয়ে অনেক কম। প্রশ্ন হলো, বেসরকারি কোম্পানির বীজের মূল্য নিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ দফতর কেন কিছু করতে পারে না। কেন এই কোম্পানিগুলো কোনোভাবেই কৃষি দফতরের কাছে দায়বদ্ধ নয়। মূলত নয়া উদারবাদী বেসরকারিকরণ আর বিরাষ্ট্রীয়করণের পলিসিতেই বীজ খাতকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের বীজ নীতিতে বলা আছে, ‘জাতীয় বীজ নীতি বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় সৃষ্ট অনুকূল পরিবেশে বেশ কিছু সংখ্যক বহুজাতিক বীজ কোম্পানি ও বীজ ব্যবসায়ী, বীজ উদ্যোক্তা বীজ খাতে বিনিয়োগে এগিয়ে আসছেন। মানসম্পন্ন বীজের চাহিদা পূরণে এটি একটি নতুন উদ্যোগের সূচনা করবে’। সুতরাং জাতীয় বীজ নীতিই প্রত্যক্ষভাবেই বেসরকারি খাতকে অগ্রসর করার কথা বলেছে। অথচ এই প্রশ্ন এখনো কেউ করে না, স্বাধীনতার এত বছর পরও যে কেন বিএডিসিকে স্বাধীন স্বনির্ভর বীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা গেল না। এরই ফলশ্রুতিতে প্লাস্টিকের প্যাকেটে বহুজাতিক করপোরেশনের পকেটজাত হয়েছে বীজ। অন্যদিকে বিএডিসির বীজাগারগুলো ক্রমশই নিঃশেষ হওয়ার পথে। অথচ সরকার চাইলেই বিএডিসির উদ্যোগে সারা দেশের গ্রামে গ্রামে স্বনির্ভর বীজঘর তৈরি করা যেত। এখনো সময় আছে, আমাদের লোকায়ত ও আদি কৃষি জ্ঞানকে ছড়িয়ে দিতে হবে। গ্রামে গ্রামে শিক্ষার্থীদের জানাতে হবে বীজ কীভাবে সংরক্ষিত হয়। প্রচলিত বীজের ক্ষেত্রে বিদ্যমান নানা রকম সংকট দূর করতে লড়াইকে অগ্রসর করতে হবে এবং একই সঙ্গে দেশের বীজ খাতকে বহুজাতিক কোম্পানির রাহুমুক্ত করা সময়েরই দাবি।

লেখক : বাংলাদেশ কৃষক সমিতির নেত্রী

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর