মঙ্গলবার, ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

বাড়াতে হবে খাদ্য উৎপাদন

প্রিন্সিপাল এম এইচ খান মঞ্জু

বাড়াতে হবে খাদ্য উৎপাদন

কৃষিনির্ভর দেশে যুগ যুগ ধরে কৃষিই ছিল অবহেলিত পেশা। এ পেশাকে মর্যাদাহীন বলে মনে করতেন সমাজের অবস্থাপন্নরা। শিক্ষিতজনেরা নাক সিটকাতেন কৃষিকাজ করার কথা ভেবে। দেরিতে হলেও কৃষিকে উপেক্ষা করার কান্ডজ্ঞানহীন প্রবণতার অবসান ঘটছে। এ খাতে শিক্ষিত তরুণরা এখন যোগ দিচ্ছেন। ফলে কৃষি খাত আগের তুলনায় অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। ধান, পাট, আম, পেয়ারা, আলু প্রভৃতি ফসল ও ফল উৎপাদনে বাংলাদেশ শীর্ষ আটটি দেশের মধ্যে রয়েছে। বাঙালির জীবন-জীবিকায় কৃষিই সব। কৃষি কাজে সম্পৃক্ত অর্ধেকের বেশি জনগোষ্ঠী। সারা বছর বীজ বুনে ফসল ফলায় আবার কেটে গোলা ভরে কিংবা বেচাকেনায় হয় নিমগ্ন। ১ মণ ধান বেচে সংসারের জন্য দরকারি জিনিস কেনা বাঙালি মধ্যবিত্ত কৃষকের পুরনো চর্চা। তবে ভূমিহীন কৃষকের পক্ষে তা দুষ্কর। দেশে জনসংখ্যা বাড়ছে কিন্তু কৃষিজমি বাড়ছে না। দেশি ও আন্তর্জাতিক গবেষণা তথ্য বলছে, নিকট ভবিষ্যতে বিশ্বজুড়ে খাদ্যশস্যের সরবরাহ বিঘ্নিত হতে পারে। বৈশ্বিক খাদ্যসংকটের জন্য প্রধানত দায়ী করা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবকে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে গমের সরবরাহ নিয়েও সংকট তৈরি হয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্যবিষয়ক সংস্থা বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি গত সেপ্টেম্বরেই বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকটের আগাম সতর্কতা জারি করে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার উচ্চ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিতে থাকা ৪৫টি দেশের মধ্যে আছে বাংলাদেশ।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক দি ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের গ্লোবাল ফুড সিকিউরিটি ইনডেক্স ২০২২-এর সূচকে ১১৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮০তম। আর জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ক্রপ প্রসপেকটাস অ্যান্ড ফুড সিচুয়েশন শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের ৪৫টি দেশে ঘাটতিজনিত উচ্চ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা রয়েছে। এ তালিকায় এশিয়ার ৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। আবার আয়ারল্যান্ডভিত্তিক সংস্থা কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড ও জার্মানভিত্তিক ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফ যৌথভাবে প্রকাশিত বিশ্বক্ষুধা সূচকে আট ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। ২০২২ সালে ১২১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৪-তে নেমে এসেছে। এ সূচকে বাংলাদেশ মাঝারি ক্ষুধার ঝুঁকিতে রয়েছে বলা হয়েছে। তিন বছর ধরে এ সূচকে অবনমন হচ্ছে বাংলাদেশের। খাদ্যের মজুদ যথেষ্ট থাকার পরও বাংলাদেশ এক ধরনের চাপের মধ্যে রয়েছে। সরকার এরই মধ্যে ওএমএস কার্যক্রম শুরু করেছে। অন্যদিকে চলছে টিসিবির কার্যক্রম। ভবিষ্যতে এ কার্যক্রমের আওতা বাড়াতে হতে পারে। কারণ যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বিশ্বের সব দেশেই খাদ্যসংকটের আশঙ্কা রয়েছে।

খাদ্যশস্য সংরক্ষণ পরিস্থিতির দ্রুত উন্নয়ন করতে বাংলাদেশকে সম্ভাব্য সব উৎস থেকে আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। খাদ্য মন্ত্রণালয় নতুনভাবে কর্মপরিকল্পনা করছে। আগের চুক্তি অনুযায়ী দ্রুত চাল পাওয়া নিশ্চিত করতে এবং আরও চাল আমদানির চুক্তি করার উদ্যোগ নিতে থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার সঙ্গে দেনদরবার চলছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশকে প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য আমদানির পাশাপাশি একই সঙ্গে উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। যে কোনো মূল্যে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। দেশে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো জরুরি। স্বল্প পরিমাণ জমিতে অধিক খাদ্য উৎপাদনের পদক্ষেপ নিতে হবে। এজন্য কৃষি গবেষণার কাজে মনোযোগী হতে হবে। প্রয়োজনে শিক্ষার্থীর জন্য কৃষিতে ব্যবহারিক শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে। শিক্ষিতরা কৃষিকাজ যাতে অপছন্দ না করে সেজন্য তাদের সচেতনতা বাড়াতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থায় কৃষির ব্যবহারিক শিক্ষা থাকা বাঞ্ছনীয়। কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের কাজ বিস্তৃত হলে ফসল উৎপাদন বাড়বে। অব্যবহৃত জমি সমবায়ের ভিত্তিতে আবাদ করা গেলে খাদ্যাভাব হ্রাস পাবে। জমি চাষ, ফসল কাটা, ফসল আলাদা করা সবই মেশিন দিয়ে করা গেলে উৎপাদন শ্রম হ্রাস পাবে। পাশাপাশি কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প গড়ে তোলা জরুরি। নতুন প্রজন্মকে কৃষিকাজে আগ্রহী করে তোলা গেলে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ থাকবে দেশ। কৃষিনির্ভর যে দেশ, সে দেশে কৃষিকে গুরুত্বহীন রাখা যায় না। সমাজ জীবনের প্রতিটি স্তরে কৃষিকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হবে, যাতে এ খাত স্বনির্ভর থাকে সব সময়। উচ্চফলন ও লাভজনক লাগসই নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও অবলম্বনের মাধ্যমে কৃষিতে অর্জিত সাফল্যের ধারাবাহিকতা রক্ষাকল্পে টেকসই কৃষিব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। ছোট ছোট খামারভিত্তিক চাষাবাদের কারণে প্রায়ই জমিতে উন্নত যন্ত্র ব্যবহার করা সম্ভব হয় না। এ ক্ষেত্রে সমবায়ের ভিত্তিতে উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করা যেতে পারে। পাশাপাশি ছোট খামার উপযোগী যন্ত্র উদ্ভাবন করতে হবে। টেকসই কৃষিব্যবস্থায় চাষাবাদের সঙ্গে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত অন্য দিকগুলোর মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন। টেকসই খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা অর্জনে সুষম ও টেকসই মাটি ব্যবস্থাপনা আবশ্যক। স্বল্প উপকরণ সহায়তার মাধ্যমে অধিকতর খাদ্য উৎপাদন কৌশল বের করতে হবে। একই সঙ্গে খাদ্যশস্য অপচয় ও বিনষ্ট হওয়া থেকে রক্ষায় কার্যকর মজুদ ব্যবস্থাও গড়ে তুলতে হবে। কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার ফসল ও ফসল উত্তোলন-পরবর্তী ক্ষতি কমায়, উৎপাদন ব্যয় ও খাটুনি কমায়, উচ্চমানসম্মত পণ্য উৎপাদনে দ্রুততম ও সময়ানুগ পরিচালনা নিশ্চিত করে।

মূলত কৃষিতে পাওয়া ঈর্ষণীয় সাফল্য পুঁজি করেই বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা ও স্বনির্ভরতা অর্জন সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশ এখন দেশি চাহিদা মিটিয়ে নিরাপদ স্তরে আপৎকালীন মজুদ রেখেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করছে উদ্বৃত্ত খাদ্য ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাত পণ্য। কৃষিতে যুগোপযোগী পরিকল্পনা, উন্নত প্রযুক্তি, বীজ ও সারের ব্যবহার, কৃষিবিজ্ঞানীদের উচ্চফলনশীল নতুন জাত উদ্ভাবন বাংলাদেশের এ অর্জনের নেপথ্যে ভূমিকা রেখেছে। চলমান বিশ্বের অবস্থা পর্যালোচনায় সবাই এখন ইয়া নাফসি পর্যায়ে অবস্থান করছি। সুতরাং পরিস্থিতি বিবেচনায় খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিই আগামী দিনের প্রথম এবং সর্বোচ্চ ভরসা।

 

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও প্রিন্সিপাল, এম এইচ খান ডিগ্রি কলেজ গোপালগঞ্জ

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর