২৫ ফেব্রুয়ারি ছিল বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক আমার প্রিয় নঈম নিজামের ছেলে মাহির আবরারের বউভাত। দাওয়াত করেছিলেন অনেক দিন আগে। ব্যক্তিগতভাবে এসে কার্ড দেননি বা দিতে পারেননি বলে সে যে কত দুঃখ, কতবার মাফ চেয়েছেন বলে শেষ করা যাবে না। তাই ঠিক করেছিলাম কোনোভাবেই নঈম নিজামের ছেলের বউভাতে না গেলে চলবে না। ২৪ ফেব্রুয়ারি ছিল বোয়ালী কলেজ মাঠে জনসভা। ২৫ তারিখ ছিল মির্জাপুরের লতিফপুরে আরেক জনসভা। আমি টাঙ্গাইলে, বেগম সাহেবা ঢাকায়। আমরা দুজন গোড়াই গফুরের বাড়িতে খেয়েছিলাম। গফুর আমার বহুদিনের একনিষ্ঠ কর্মী। ওর ছেলে কাব্যকে কোলে নিয়েছি। সেখান থেকে গিয়েছিলাম লতিফপুর স্কুলমাঠের জনসভায়। বছর পনের আগে এক ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে জোরজুলুম জাল ভোট বন্ধ করার জন্য উৎসুক জনতা ম্যাজিস্ট্রেটের গাড়ি ভেঙেছিল। তার জন্য এ এলাকার হাজারো মানুষকে নির্যাতন করা হয়েছিল, জেলে পোরা হয়েছিল। সে সময় আমি গিয়েছিলাম, সঙ্গে আমার স্ত্রীও। তাই সেদিনও স্ত্রীকে নিয়ে গিয়েছিলাম। মহিলা থাকলে সভায় আসা মহিলারা উৎসাহবোধ করেন এবং তার সঙ্গে নিঃসংকোচে কথা বলতে পারেন, অভাব- অভিযোগ জানাতে পারেন। তাই বেগম সাহেবাকে নিয়ে গিয়েছিলাম। সুন্দর মিটিং হয়েছে। বেগম সাহেবাকে পেয়ে মহিলারা দারুণ খুশি। আর কিছু না হোক বেগম সাহেবার জন্য অন্তত ১০০ জন সমর্থক বেড়েছে। ৬টা ৫ মিনিটে মিটিং শেষ করে ঢাকার পথ ধরেছিলাম। নঈম নিজামের ছেলের বউভাতে বেগম সাহেবাকেও নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তিনি অত লম্বা জার্নি করে পেরে উঠছিলেন না তাই যাননি। রাত পৌনে ১০টায় আমি বসুন্ধরার ১ নম্বর কনভেনশন হলে নঈম নিজামের ছেলের বউভাতে হাজির হয়েছিলাম। হলে ঢুকেই আসাদ ভাইয়ের মেয়েজামাই ৭১ টিভির বাবুর সঙ্গে দেখা। এরপর নঈম নিজাম ছুটে আসেন, ছুটে আসেন আরও অনেকেই। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী প্রিয় ওবায়দুল কাদের আমার দু-এক মিনিট আগে হলে পৌঁছেছিলেন। যে-ই খেতে বসেছিলাম আমার উল্টো পাশে ওবায়দুল কাদের, তাঁর ডানে মায়া। আমার ডান পাশে পরম স্নেহের নারায়ণগঞ্জের শামীম ওসমান। মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের কিছু মুখে দেননি। তিনি অনেক দূর থেকে এসেছেন। আমি মাংস খাই না। খাবার মধ্যে শুধু মাংস ছিল, মাংস আর মাংস। তাই মাংসের মধ্য থেকে এক চামচ ভাত নিয়ে খাচ্ছিলাম। সে সময় নঈম নিজামের স্ত্রী ফরিদা এসে হাজির, ‘ভাই মাংস নিলেন না!’ বলেছিলাম, আমার জন্য বাইজা মাছ, মলা মাছ, পুঁটি মাছ কই? বলেছিলেন, ‘বাড়িতে নিয়ে খাওয়াব।’ তকদিরে থাকলে হয়তো ওসব তাদের বাড়িতে গিয়ে খেতে পারব। বেরিয়ে আসার পথে ছেলে-বউকে দেখতে গিয়েছিলাম। নঈমের ছেলে মাহির আবরার নঈমের মতোই সুন্দর। প্রায় ৩০ বছর আগে লাঙ্গলকোটে গিয়েছিলাম। তখন নঈম ছেলের মতোই ছিল। নঈমের মা গিয়েছিলেন নাতির বউভাতে। হুইলচেয়ারে বসা ছিলেন। তাঁর পাশেই সিঁড়িতে বসে নঈমের মাকে সালাম করে এসেছি। যখন খাচ্ছিলাম তখন বউ নিয়ে আলাউদ্দিন নাসিম আমার পিঠের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ‘নাতি’ বলতেই বুঝতে পেরেছিলাম। আমার দাদার নাম আলাউদ্দিন সিদ্দিকী। তাই তাঁকে দাদু বলেই ডাকি। ওঁর স্ত্রী বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর। মিলনের সঙ্গেও তাঁর স্ত্রীসহ দেখা হয়েছে। ইমদাদুল হক মিলন আমার ছোটবোন শুশুর সঙ্গে পড়ত। সাগরসহ ওরা বেশ কয়েকজন অনেক বড় হয়েছে। অনেক ক্ষমতাও হয়েছে। মিলন সস্ত্রীক ছিলেন। মিলনকে খুবই ভালোবাসি, সেও অসম্ভব সম্মান করে। সর্বোপরি নঈম নিজামের ছেলের বউভাতে হাজির হতে পেরে সত্যিই ভালো লেগেছে। পরম প্রভু দয়াময় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছি, মাহির আবরার এবং মালিহা জাহান ইতির বিবাহিত জীবন যাতে সার্থক ও সুন্দর হয়।
দুই মাস কয়েক দিন হলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বোন শেখ হাসিনার সঙ্গে একটা বৈঠক হয়েছে। তিনি ফোনে ডেকেছিলেন। পুরো পরিবার নিয়ে যেতে বলেছিলেন। ছেলে বাইরে তাই দুই মেয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমার স্ত্রী নাসরীন অনেক সময় বোনের সঙ্গে চলাফেরা করেছেন। সেই আন্তরিক টান আগের মতোই আছে। কিন্তু এমন একটি সাধারণ দেখায় এভাবে আসমান ভেঙে পড়বে ভাবিনি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বোনের সঙ্গে দেখা করে বাবর রোডের বাড়ি ফেরা পর্যন্ত কোনো সাংবাদিকের সঙ্গে দেখা বা কথা হয়নি। কিন্তু সারা দেশ মনে করেছে গণভবন থেকে বেরিয়েই সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছি, যা মোটেই সত্য নয়। তবে বুঝতে পারিনি কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ গঠন করেছিলাম ’৯৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর। অনেক গোলাগুলির মধ্য দিয়ে আমাদের পার হতে হয়েছিল। ১০৪ জন আহত হয়েছিলেন। তিনজন চোখ খুইয়েছিলেন, চার-পাঁচ জনের পায়ের ক্ষতি হয়েছিল, ডান-বাম দুই হাত মিলিয়ে আট-নয় জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। কেন জানি সেই ২৪ ডিসেম্বর ২০২২ আওয়ামী লীগ তার জাতীয় সম্মেলনের তারিখ ঠিক করেছিল। ছোটবেলায় আমাদের এলাকার দু-এক জন রাজনৈতিক মুরব্বি ছিলেন। তাঁরা বলতেন, ‘এমন কর্মী তৈরি করবে নেতা হাঁ করলে যেন তারা হামিদপুর বুঝতে পারে।’ আমরাও অনেকটা বঙ্গবন্ধুর অমন কর্মী ছিলাম। কিন্তু আমরা অমন কর্মী খুব বেশি তৈরি করতে পারিনি। তবু কমবেশি কিছু কর্মী ছিল যারা হাঁ করলে হামিদপুর বুঝে যেত বা বুঝে ফেলত। আমার অবস্থা অনেকটা তেমনি। বোনের সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা হয়। তাঁর মধ্যে গভীর আন্তরিকতার কোনো অভাব ছিল না। কিছুক্ষণ পর দুই মেয়েকে পাশের ঘরে বসিয়ে ছিলাম। স্ত্রী পাশেই ছিলেন। তাঁর এখন শুনতে একটু কষ্ট হয়। এক ঘণ্টার বেশি আমরা নিভৃতে কথা বলেছি। হঠাৎই একপর্যায়ে নেতা ও মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে নিয়ে কথা উঠেছিল। ওবায়দুল কাদের সম্পর্কে তাঁর কথায় বুঝেছিলাম সামনে জাতীয় নির্বাচন। এ নির্বাচনের সময় তিনি কোনো ঝুঁকি নিতে যাবেন না। আওয়ামী লীগে অনেকেই আছেন যারা সেক্রেটারি হওয়ার উপযুক্ত। আমার ধারণায় ২০-২৫ জন হবেন। সেই ২০-২৫ জনের মধ্য থেকে কাউকে সাধারণ সম্পাদকের পদ দিলে বাকিরা মনঃক্ষুণ্ন হবেন। একে তো সাধারণ সম্পাদকের পদ গুছিয়ে নিতে নতুনের বেশ কিছুটা সময় লাগবে, অন্যদিকে বাকি যারা হতে পারেননি তাদের মনে কষ্ট থাকবে। সেই মনঃকষ্ট দূর হতে হতে নির্বাচন এসে যাবে। তাই দলকে প্রস্তুত করার খুব একটা সময় নতুন কেউ পাবেন না। সেজন্য অভিজ্ঞ নেত্রী যা ছিল তা-ই রেখেছেন। ২৪ ডিসেম্বর ছিল সম্মেলন। দাওয়াত পেয়েছিলাম এবং বড় জোরদার অনুরোধ ছিল সম্মেলনে যাওয়ার। তাই গিয়েছিলাম। যাওয়ার পথে কয়েকটি টিভি চ্যানেল ভীষণ চাপাচাপি করছিল। তাই ওবায়দুল কাদেরই সাধারণ সম্পাদক থাকছেন কথাটি জোর দিয়ে বলেছিলাম। বয়স হয়েছে। বাতাসে কান পেতে অনেক কিছুই শুনতে পারার কৌশল শিখেছি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বেশ কিছুটা সময় চলেছি। তিনি বড় বেশি আদর ও বিশ্বাস করতেন। তাই বলেছিলাম ওবায়দুল কাদেরই সাধারণ সম্পাদক হচ্ছেন। এতে অনেকে ধরেই নিয়েছিলেন আমি একজন বড়সড় মাপের গণক বা অ্যাস্ট্রোলোজার। গণকটনক বা অ্যাস্ট্রোলোজার আমি নই। আমি মানুষের চোখমুখ দেখে তার মনের কথা কিছুটা হলেও বুঝতে পারি, বুঝবার চেষ্টা করি। সেখান থেকে ওবায়দুল কাদেরের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার কথা বলেছিলাম। বছর কয়েক আগে গাজীপুরের সিটি নির্বাচনেও বলেছিলাম, আমার যদি সামান্য রাজনৈতিক জ্ঞান থেকে থাকে, আমি যদি মানুষ চিনতে ভুল না করি তাদের চোখের ভাষা বুঝবার ক্ষমতা মহান আল্লাহ যদি আমায় দিয়ে থাকেন তাহলে বিএনপির প্রার্থীর কাছে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ১ লাখের বেশি ভোটে হারবেন। সেবার তা-ই হয়েছিল। ১ লাখ ৩-৪ হাজার ভোটে অধ্যাপক মান্নানের কাছে নৌকার প্রার্থী হেরেছিলেন। রাস্তাঘাটে যা দেখি, যা শুনি তা হৃদয় দিয়ে অনুধাবনের চেষ্টা করি। তাই দু-একটি সঠিক হয়, বেশির ভাগই ভুল প্রমাণিত হয়।
আমাদের ২২তম রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। নাম ঘোষণার আগে শতকরা পাঁচজনও ভাবিনি জনাব চুপ্পু প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন। মাননীয় সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগের ক্ষমতা দিয়েছিলেন সদস্যরা। এদিক থেকে নেত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক। এখানে কোনো ত্রুটি নেই, বিচ্যুতি নেই। তবে যারা দায়িত্ব দিয়েছিলেন তারা একজনও সাহাবুদ্দিন চুপ্পু নাম স্বপ্নেও ভাবেননি। আমিও একসময় নেত্রীকে বলতে চেয়েছিলাম আমির হোসেন আমু অথবা ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের নাম। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। আমীর-উল ইসলাম পাকিস্তান হাইকমিশনে গিয়েছিলেন এক দাওয়াতে। সেখানে বঙ্গবন্ধুর খুনি ফারুক-ডালিম-রশীদদের কেউ কেউ গিয়েছিল। এটা নব্বইয়ের দশকের কথা। তখন আমি কেবলই দেশে ফিরেছি। যে মিটিংয়ে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে বহিষ্কার করা হয় আওয়ামী লীগের সেই ওয়ার্কিং কমিটির আমি এক নম্বর সদস্য ছিলাম। আমার কাছে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের বহিষ্কারটা মনে হচ্ছিল লঘু পাপে গুরুদণ্ড। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম কোনো রাস্তার মানুষ ছিলেন না। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ বিপ্লবী সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদের ব্যক্তিগত সচিব। আর ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের ব্যক্তিগত সচিব ছিলেন বিএনপির প্রবীণ নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। যিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত হয়েছেন। কিন্তু আমীর-উল ইসলাম তেমন কিছুই হতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুর সময় একজন প্রতিমন্ত্রী ছিলেন মাত্র। যাক ওসব কথা। আওয়ামী লীগে অনেক সময় এ রকম অনেক কিছু হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা করে খন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। রাষ্ট্রপতি এমপিদের রাষ্ট্রপতি ভবনে আহ্বান করেছিলেন। সেখানে সেই বৈঠকে একজন এমপিও রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাককে স্বীকার করেননি। বিশেষ করে বর্তমান আইনমন্ত্রীর বাবা সিরাজুল হক খন্দকার মোশতাককে চোখেমুখে বলেছিলেন, ‘তুমি খুনি, তোমাকে আমরা রাষ্ট্রপতি হিসেবে মানি না।’ বঙ্গভবনে যাওয়ার পথে এমপিরা অনেকেই মোশতাকের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে দিতে বঙ্গভবনের ফটক পার হয়েছিলেন। একসময় গাড়ি থেকে নামলে অনেক সংসদ সদস্যের বুকে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী খুনিরা রাইফেল ধরেছিল। তা-ও তাদের থামাতে পারেনি। বিশেষ করে গফরগাঁওয়ের এমপি আবুল হাশেমকে। আমির হোসেন আমুর কোনো এক আত্মীয়ের গুলশানের বাসায় সিরাজুল হকের বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। যেহেতু সেদিন নিজে উপস্থিত ছিলাম। নেতা আমির হোসেন আমুসহ আমি এবং আরও কয়েকজন অ্যাডভোকেট সিরাজুল হকের বহিষ্কার সমর্থন করতে চাইনি। একপর্যায়ে মনে হয়েছিল নেত্রী বোন হাসিনারও তেমন মত নেই। তবু সিরাজুল হককে বহিষ্কার করা হয়েছিল। তাঁর অপরাধও খুব একটা বড় কিছু ছিল না। তিনি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের উকিল হয়েছিলেন। পরে দেখেছি, কতজন পাকিস্তানের কত দালাল সেজেছে, কত বঙ্গবন্ধুবিরোধী আওয়ামী লীগে ঠাঁই পেয়েছে। কিন্তু যাদের হাত ধরে স্বাধীনতা এসেছে তারা বড় বেশি নিন্দিত হয়েছেন। সিরাজুল হকের ছেলে আনিসুল হক আমার বোনের মন্ত্রিসভার আইনমন্ত্রী। কত সময় কত না-বুঝের মতো কথা বলেন। এই যে সেদিন বললেন, ‘বেগম খালেদা জিয়ার রাজনীতি করতে কোনো বাধা নেই।’ কেন বাধা থাকবে না? বেগম খালেদা জিয়ার দণ্ড স্থগিত রেখে মানবিক কারণে জেলখানায় না রেখে বাড়িতে রাখা হয়েছে। তিনি যদি স্বাধীন মুক্ত মানুষ হন তাহলে বিদেশে চিকিৎসা করতে যেতে পারছেন না কেন? এখানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং তথ্যমন্ত্রী যথার্থ বলেছেন, ‘বেগম খালেদা জিয়ার রাজনীতি করার কোনো সুযোগ নেই।’ আইনমন্ত্রী আমার বোনের মতামত নিয়ে যদি এ কথা বলে থাকেন সেটা ভিন্ন কথা। আইনের কোনো ধারা তাঁকে এ কথা বলতে অনুমোদন করে না। তাঁর রাজনৈতিক অধিকার যদি সুরক্ষিত রাখতে হয় তাহলে তাঁর মোকদ্দমায় আপিল বা রিভিউ পিটিশন যা-ই করা হয়ে থাকুক কোর্ট এটা গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে দেওয়া দণ্ড প্রশ্নবিদ্ধ। সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তের আগ পর্যন্ত তিনি দোষীও না, নির্দোষও না। হ্যাঁ, সুপ্রিম কোর্ট যদি তাঁকে জামিন দিয়ে দেন তাহলে তিনি মুক্ত মানুষ হিসেবে যা খুশি তা করতে পারতেন। কিন্তু তেমন তো হয়নি। তাঁর দণ্ড স্থগিত রেখে তাঁকে বাড়িতে থাকতে দেওয়া হয়েছে। দেশের ভিতরে যে কোনো স্থানে তাঁর চিকিৎসার সুযোগ দেওয়া হয়েছে এটুকু। কিন্তু আমাদের মান্যবর আইনমন্ত্রী নিজেই একটা ত্রুটিপূর্ণ আইন করে ফেললেন।
আজ প্রায় ১০-১২ বছর একজন ফাঁসির আসামি নিয়ে আমি অনেক দৌড়াদৌড়ি করেছি, অনেক নাড়াচাড়া করেছি। কুমিল্লার দেবিদ্বারের রাখাল চন্দ্র নাহার একটি খুনের মামলায় ফাঁসি হয়। স্বাধীনতার পরপরই সিদ্ধান্ত হয়েছিল কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে কোনোভাবেই আইনের দ্বারা প্রাণনাশ করা যাবে না। তাই ’৯৯ সালে রাখাল চন্দ্র নাহাকে খুনের আসামি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়াই অন্যায় এবং ভুল ছিল। অন্যদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে তাঁকে ফাঁসি দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। হঠাৎই বিকালের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্রছাত্রী রাখাল চন্দ্র নাহার ছেলেসহ আমার মোহাম্মদপুরের বাড়িতে এসেছিল। দীর্ঘ সময় কথাবার্তা শুনে মহামান্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সময় ঠিক না করেই বঙ্গভবনে গিয়েছিলাম। জানি না কেন যেন সেদিন মহামান্য রাষ্ট্রপতি আমাকে সময় দিয়েছিলেন। রাখাল চন্দ্র নাহার পরদিন রাতে ফাঁসি হবে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এটা মেনে নিতে পারিনি। মহামান্য রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ বলেছিলেন, ‘সিদ্দিকী সাহেব! আমি রাষ্ট্রপতি বটে। কিন্তু আমার কিছু করার নেই। যা করার তত্ত্বাবধায়ক সরকার করবে।’ আমি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান ফখরুদ্দীনের অফিসে গিয়েছিলাম পরদিন সকাল ১০টায়। তিনি যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে আমার কথা শুনেছিলেন। একসময় বলেছিলেন, ‘বঙ্গবীর, আপনি সরল সোজা মানুষ। এ ব্যাপারে আমার কিছুই করার নেই। যা কিছু করার করতে পারেন সেনাপ্রধান।’ সেখান থেকেই সেনাপ্রধানের দফতরে গিয়েছিলাম। তিনি যথেষ্ট আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। আমার কথা শুনে মইন উ আহমেদ বলেছিলেন, ‘কোনো মুক্তিযোদ্ধার ফাঁসি হোক এটা আমরাও চাই না।’ তিনি সঙ্গে সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান ফখরুদ্দীন আহমদের তেজগাঁও দফতরে লোক পাঠিয়েছিলেন। সেখান থেকে রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছিল। দিনের সূর্য ঢলে পড়েছিল। আমরা সবাই উদ্বিগ্ন ছিলাম। রাত ১১টায় বঙ্গভবন থেকে ফোন করে জানানো হয় কুমিল্লার দেবিদ্বারের রাখাল চন্দ্র নাহার ফাঁসির আদেশ রদ করে তাঁকে যাবজ্জীবন দেওয়া হয়েছে। আগে যাবজ্জীবন ছিল ২০ বছর। জেলের ভিতর ভালো ব্যবহার করলে ছয় বছর বাদ দিয়ে ১৪ বছরে একজন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আসামি মুক্তি পেতেন। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন অনেকের চোখে বিরাট ভালো মানুষ। আমার চোখেও তিনি খারাপ নন। তবে মুক্তিযুদ্ধের সময় একজন ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে পুরো যুদ্ধকালীন চাকরি করেছেন, বেতন নিয়েছেন, তিনিই মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন। তিনি একবার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আবার আওয়ামী লীগ সমর্থিত রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। এসবই আমাদের কপাল! আমি অন্তত ১০ বার রাখাল চন্দ্র নাহার মুক্তির জন্য চেষ্টা করেছি। আগে যাবজ্জীবন ছিল ২০ বছর। সাহাবুদ্দীন সাহেব সেটাকে ৩০ বছরে উন্নীত করেছেন। ৩০ বছর হলেও নাহার যে বিচার হয়েছিল সেটা সাহাবুদ্দীন সাহেবের ঘোষণা অথবা নির্দেশের আগে। স্বাভাবিক কারণেই তাঁর ক্ষেত্রে আগের দণ্ড মৃত্যুদণ্ড অবৈধ ছিল এবং যাবজ্জীবন ছিল ২০ বছর। তাঁর ক্ষেত্রে ২০ বছরই কার্যকর হওয়া উচিত ছিল। এখন পর্যন্ত রাখাল চন্দ্র নাহা ২২ বছর কয়েক মাস কারাদণ্ড ভোগ করেছেন। এ বছর জুনের মধ্যে তাঁর মুক্তি হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আমার সঙ্গে একমত হয়ে না হলেও ১০ বার আইনমন্ত্রীর কাছে ফাইল পাঠিয়েছে। কিন্তু তিনি বেঁকে বসে আছেন- রাখাল চন্দ্র নাহাকে মৃত্যুদণ্ড থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে আনা হয়েছে। তাই তাঁর ক্ষেত্রে আর মাফ মুক্তি চলবে না। আমি এসব নিয়ে আইনকানুন অনেক দেখেছি। সরকারের ইচ্ছা হলে যে কোনো সময় যে-কারও দণ্ড মাফ করতে পারেন। জেলের মেয়াদ থাকার পরও তাদের বাইরে পাঠিয়ে দিতে পারেন। বাইরে ঘোরাফেরা করা মুক্তভাবে কাজকর্ম করা জেলের আসামিদেরও বাড়িঘরকে জেল ধরে সময় পার করে দেওয়া যেতে পারে। কত বিজয় দিবস যায়, স্বাধীনতা দিবস যায়, ঈদ যায়, পূজা যায় এসব উপলক্ষে সরকার যে-কাউকে মুক্তি দিতে পারে। কিন্তু আনিসুল হকের কলম চলে না। একজন মুক্তিযোদ্ধার ক্ষেত্রে তাঁর কলমের কালি থাকে না! মাননীয় মন্ত্রী একজন অ্যাডভোকেট। বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে তিনি অমন মন্তব্য কেন করলেন, বুঝলাম না।
শুরুতেই বলেছিলাম, বোনের সঙ্গে সাক্ষাতে এমন কী হয়েছে? আসমান কোথায় ভেঙে পড়ল তা-ও বুঝতে পারলাম না। এর মধ্যেই কয়েক শ লোক এসেছে যাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। কিছু লোক এসেছে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের চিঠি নিয়ে কাজ করিয়ে দিতে হবে। তবে সাক্ষাৎপ্রার্থীই বেশি। অনেকে আবার অনেক উপঢৌকন নিয়েও আসছেন। বউয়ের জন্য শাড়ি, আমার জন্য লুঙ্গি-পাঞ্জাবি আরও অনেক কিছু। ঝাঁকা ঝাঁকা ফলমূল, প্যাকেটবোঝাই মিষ্টি তো আছেই। কজনকে না করব? না করলেও শোনে না। অনেকেই মনে করে আমি ইচ্ছা করলেই পারি। কিন্তু অযথাই না করছি। কী যে করি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।
লেখক : রাজনীতিক
www.ksjleague.com