সোমবার, ৬ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

সাহিত্য ও পদক বাণিজ্য

আফরোজা পারভীন

সাহিত্য ও পদক বাণিজ্য

লেখালেখির প্রায় সাড়ে চার যুগ ধরে জেনে এসেছি, সাহিত্য সাধনার জিনিস। তার জন্য প্রয়োজন নিষ্ঠা একাগ্রতা আত্মমগ্নতা পড়াশোনা। আজ মনে হয় ভুল জেনেছি। এখন চারদিকে চোখ মেলে দেখছি, সাহিত্য মানে দৌড়ঝাঁপ, পিঠ চুলকানো, সংগঠন, পুরস্কার বাণিজ্য। আগে জানতাম অসাধারণ কিছু করলে পুরস্কার মেলে। এখন দেখি হালে যিনি লেখালেখির জগতে এসেছেন তিনিও পদক, পুরস্কার পাচ্ছেন।  ক্রেস্ট বা উত্তরীয়র ছবি ফেসবুকে দিচ্ছেন। দেদার মন্তব্য আর লাইক পড়ছে তাতে। এই লেখকরা মনে করছেন তিনি সত্যিই লেখক হয়েছেন। কেউ কেউ নামের আগে ‘কবি’ জুড়ে দিচ্ছেন, কেউ জুড়ে দিচ্ছেন ‘লেখক’। এসব ক্রেস্টের বেশির ভাগই নাকি কেনা। যাকে দেওয়া হয় তার কাছ থেকে বেশি চাঁদা নিয়ে কম খরচে পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। অনেককে একসঙ্গে দিলে ভালো বাণিজ্য আর সঙ্গে সংগঠন এবং তার কর্ণধারদের নাম প্রচার হয়। পুরস্কার দেওয়ার অসিলায় দেশের নামকরা লোকদের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন, তাদের ডাকছেন। তাদের সঙ্গে বসছেন, আলাপ করছেন। পরে সেটা কাজে লাগিয়ে বাণিজ্য করছেন। অন্য কাজ হাসিল করে নিচ্ছেন। এরা আবার বেশ চালাক। বিনা চাঁদায় দু-চারজন ভালো লেখককে পুরস্কার দিয়ে বিষয়টা জায়েজও করে নিচ্ছেন। এমন সংগঠন অসংখ্য। প্রতিদিন নতুন নতুন গজাচ্ছে। এদের দু-চারটি ছাড়া কারও রেজিস্ট্রেশন আছে বলে মনে হয় না।

এ অবিরাম পদক ব্যবসা শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক না, চলছে দেশজুড়ে। সারা বছরই বিভিন্ন স্থানে লেগে আছে সাহিত্য সম্মেলন। এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত। কবি-সাহিত্যিকরা দল বেঁধে ঝাঁকের কৈ বা পিঁপড়ের সারির মতো সেখানে যাচ্ছেন, স্টেজ আলোকিত করে বসছেন, বক্তৃতা দিচ্ছেন। দু-চারজন বড় লেখকের সঙ্গে ছবি তুলে নিজেদেরও বড় মনে করছেন। আমার প্রশ্ন, এত ছোটাছুটি করলে লেখকরা লিখবেন কখন? লেখার জন্য তো সময় দরকার, দরকার নিভৃতি, মগ্নতা। লেখাটা কখন হবে? শুধু তাই নয়, কোনো কোনো সংগঠন সম্ভাব্য বেশ কয়েকজন লেখকের নাম একসঙ্গে ফেসবুকে পোস্ট করে, একটি একটি করে নাম বাদ দিয়ে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত লেখক/ লেখকদের নামে পুরস্কার ঘোষণা করছেন। এতে যে অন্যদের অসম্মান হয় তা আয়োজকরা বোঝেন না। আশ্চর্য ব্যাপার যাদের নাম বাদ দেওয়া হয় তারা প্রতিবাদও করেন না! আমরা কী এতটাই কাঙাল হয়ে গেলাম!

যদি সম্মানজনক কোনো পুরস্কার হয় তার জন্য লেখকের আকাক্সক্ষা থাকতেই পারে। সবাই তার কাজের স্বীকৃতি চায়। কিন্তু এসব হঠাৎ গজিয়ে ওঠা সংগঠনের জন্য এত বুভুক্ষা কীসের! এত হ্যাংলামি কীসের! হাপিত্যেশ কীসের! অনেক সময় ভালো লেখকদের এই কাতারভুক্ত হতে দেখে কষ্ট পাই!

আবার এটাও ভাবী, তাদেরই বা দোষ কী! এখন পুরস্কারের জন্য মান যতটা যাচাই করা হয় তার চেয়ে অনেক বেশি বিবেচনায় আসে ব্যক্তিগত পরিচয়, মাখামাখি, লেনাদেনা ইত্যাদি। এসব করতে গিয়ে কেউ কাউকে সোনার চেন দেন, কেউ দেন অন্য কিছু। কী কী দেন তার সবকিছু তো আবার বলাও যায় না! লজ্জা বলে তো একটা শব্দ আছে অভিধানে! এতে সত্যিকার লেখকরা বাদ পড়ে যান। প্রতীক্ষায় থাকতে থাকতে অস্থির হয়ে এক সময় তাদেরও মনে হয়, এই ছোটাছুটি ধরাধরিই বুঝি পথ। যারা তা করেন না, তাদের বড় অংশই পুরস্কার বঞ্চিত থেকে যান।

পুরস্কার প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে সাহিত্য সম্মেলনের সংখ্যা। সম্মেলনে পাশের দেশের কবি-সাহিত্যিকরা আসছেন দল বেঁধে। আমাদের কবি-সাহিত্যিকরা যাচ্ছেন দল বেঁধে। তবে এই আসা আর যাওয়ার দলে প্রায়শই একই মুখ দেখা যায়। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক কবি সম্মেলনও হচ্ছে দেশের বিভিন্ন জায়গায়। আসছেন, ক্রেস্ট উত্তরীয় নিচ্ছেন। এ কবিদের নামধাম আমরা তেমন জানি না। দেশের যারা যাচ্ছেন তাদের অনেকেরই লেখাজোখাও তেমন নেই। যেসব সংগঠন এই সম্মেলন করছেন তারা স্পন্সরও পেয়ে যাচ্ছেন। কিছু মানুষের টাকার অভাব নেই। তারা কিছুটা খরচ করে টাকার ভারও মুক্ত হচ্ছেন, সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে নামও যুক্ত হচ্ছে। কালো টাকাও খানিকটা জায়েজ হচ্ছে। এ সুযোগ কে ছাড়ে! এমনও শুনি স্টেজে বসার জন্য, প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি হওয়ার জন্যও অনেকে টাকা দেয়।

সাহিত্য ক্ষেত্রে লেখকের জন্মদিন পালনের কালচারের দিন দিন ব্যাপ্তি ঘটছে। কখনো লেখকরা নিজেরাই জন্মদিন পালন করছেন, কখনো কোনো সংগঠনকে কিছু টাকা পয়সা দিয়ে করাচ্ছেন। জন্মদিন উপলক্ষে নিজের নামে গ্রন্থ বের করছেন বন্ধুদের দিয়ে লিখিয়ে। পত্রিকায় নিজের ওপর লেখা ছাপাচ্ছেন। পত্রিকাগুলোও ছাপছে। এতে কী লাভ হয় আমার জানা নেই! হ্যাঁ ফেসবুকের কারণে কিছু লোক দেখে, লাইক দেয় এই তো। এর বেশি কি কিছু হয়? এখন শুধু দেশি লেখকদের নয়, বিদেশি লেখকদেরও জন্মদিন পালিত হচ্ছে এদেশের মাটিতে। কেন তাদের দেশে কি তার জন্মদিন পালনের সুযোগ নেই? তাহলে আমার দেশে কেন? এর কারণ একটাই, যিনি পালন করছেন পরেরবার তার জন্মদিন পালিত হবে ওদেশের মাটিতে। এ একরকম সমঝোতা। তখন কষ্ট পাই যখন এদেশের ভালো ভালো কবি-লেখক অন্য দেশের তদাপেক্ষা ছোট কবি লেখকের স্তুতি করেন। নিজের ওজনটা তারা বোঝেন না। এ বড় বেদনার!

আগে সাহিত্য সম্মেলন বলতে আমরা জানতাম সার্ক সম্মেলন, হলদিয়া সাহিত্য উৎসব, টাঙ্গাইল সাহিত্য সম্মেলন, ফরিদপুর সাহিত্য সম্মেলনসহ আরও দু-একটা। সার্ক সম্মেলনে প্রায় প্রতি বছর একই কবি-লেখকরা যেতেন। তারাই ছিলেন নির্বাচকদের আশীর্বাদপুষ্ট। যেন ওই কয়েকজন ছাড়া দেশে আর কোনো কবি-সাহিত্যিক নেই! ওরাই দেশ উদ্ধার করে দিচ্ছেন। তাদের সঙ্গে অনির্বাচিত কয়েকজন যেতেন নিজেদের পয়সা খরচ করে। ধরে পড়ে একটা কবিতা বা গল্প পড়ার জন্য তাদের এই যাত্রা। মূল উদ্দেশ্য কতিপয় বিদেশির সঙ্গে পরিচিত হওয়া, ছবি তোলা। পরে সেই পরিচয় ঝালিয়ে বিভিন্ন দেশে যাওয়া। হলদিয়ার ব্যাপারটাও অনেকটা তাই। আয়োজকদের সঙ্গে যারা ব্যক্তিগত যোগাযোগ করতেন তারাই যেতেন। এখনো নিশ্চয়ই একই তরিকা বজায় আছে। আজকাল আর এসবের খবর রাখতে রুচি হয় না।

কতকগুলো সংগঠন আছে যারা নিজেরাই নিজেদের পুরস্কার দেয়। নাম শুনলে মনে হয় বিরাট কিছু তারা। কিন্তু এসব সংগঠনের সদস্যদের লেখাপড়া, লেখাজোখা কিছুই নেই। এরাও দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। কোনো কোনো সংগঠন গড়ে উঠেছে একক ব্যক্তির স্তুতি করার জন্য।

অধিকাংশ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একটা করে বলয়। কোনো কোনো লেখকের লেখা বারবার ছাপা হচ্ছে ভালো বা মন্দ হোক। অনেক ভালো লেখা জায়গা পাচ্ছে না। লেখককে সম্মানী দিতে নারাজ অধিকাংশ পত্রিকা। শব্দ সংখ্যা বেঁধে দেওয়ায় অনেক লেখক লিখছেনও না। কারণ যা তারা লিখতে চান ওই সীমাবদ্ধ শব্দসংখ্যায় তা সম্ভব না। কাগজের দাম ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় প্রকাশকরা আগের মতো বই ছাপতে চাইছেন না। একশ্রেণির প্রকাশক টাকা নিয়ে বই ছাপছেন, একশ্রেণির লেখক টাকা দিয়ে বই ছাপিয়ে লেখক নাম কিনছেন।

এই তো শেষ হলো বাংলা একাডেমির বইমেলা। সেখানেও একই চিত্র। লেখক মঞ্চে এমন কিছু লেখক/কবি/গবেষক কথা বললেন যাদের নাম অনেকেই জানে না। নাম জানতেই হবে এমন কথা নেই। কিন্তু সেই মানের লেখা তো থাকতে হবে। আছে কি তেমন সবার। কাটপিস গবেষকও কথা বললেন। অথচ অনেক প্রতিষ্ঠিত লেখক কথা বলার সুযোগ পেলেন না। ওই যে পছন্দের লোক নেওয়া হয়েছে। আর প্রকৃত আত্মমর্যাদাসম্পন্ন লেখক তো বলবে না, ‘আমাকে লেখক মঞ্চে কথা বলার সুযোগ দাও’। তাই বেশ কয়েকজন সত্যিকার লেখক কথা বলার সুযোগ পেলেও অনেকেই বঞ্চিত হলেন।

এই ঘোর কলিকালে টিমটিম করে জ্বলছে কিছু লিটলম্যাগ। তারা এখনো ধরে রেখেছে সাহিত্যের দীপশিখাটি।

এই যদি হয় অবস্থা সত্যিকার লেখকরা কী করবেন! যতই তারা ভাবেন না কেন, এসব দেখব না, নিজের মনে লিখে যাব, স্বীকৃতির দরকার নেই, পাঠকের স্বীকৃতিই বড় স্বীকৃতি কিন্তু সমাজ তা ভাবতে দেয় না। তারাও তো সমাজে বাস করেন। চারপাশে যখন এসব ঘটে, পরিবার থেকে যখন বলে, সবাই পায় তুমি পাও না কেন, সবাইকে ডাকে তোমাকে ডাকে না কেন, তুমি বোধহয় অযোগ্য তখন সে উপেক্ষা বুকে বড় লাগে! এসব সয়ে লিখে যাবে এমন মনের জোর সবার থাকে না। তাই কিছু প্রকৃত লেখক হতাশায় নিমজ্জিত হন। এক সময় ভাবতে থাকেন লিখে কী হবে!

সমস্যা গোড়ায়। কী ভুঁইফোড় সংগঠন, কী প্রতিষ্ঠিত সংগঠন কোথাও নিরপেক্ষতা নেই। শর্ষের মধ্যে ভূত আছে। নির্বাচকমন্ডলীকে হতে হবে সৎ তবেই না যোগ্য ব্যক্তি পুরস্কৃত হবে। কদাচিৎ সেটা ঘটে দৈবক্রমে। অযোগ্যরাই বেশি নির্বাচিত হয় ধরাধরি করে। তার মাঝে যোগ্যতার ভিত্তিতে যে দু-চারজন হন তাদের জোর কপাল!

কালোত্তীর্ণ সাহিত্য টিকে থাকে। তার জন্য ধরাধরি করে পুরস্কার নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। বিশ্বসাহিত্য তো বটেই, এই বাংলাদেশেও অনেক বড় সাহিত্যিক ‘গণ্য করা হয়’ এমন পুরস্কার পাননি। পেয়েও প্রত্যাখ্যান করেছেন এমন নজিরও আছে। কিন্তু তারা হারিয়ে যাননি।  সদর্পে বেঁচে আছেন। হারিয়ে গেছেন তারা যারা ধরে পড়ে লাজ লজ্জা খুইয়ে পুরস্কার নিয়েছেন। তাই শেষ বিচারে ভালো লেখাই শেষকথা।

সাহিত্য নিয়ে এই বেসাতি ভালো লাগে না। লেখকরা সমাজের বিবেক। তাদের লেখা পড়ে মানুষ অনুপ্রেরণা পাবে, সত্য মিথ্যার তফাত বুঝতে পারবে,  মঙ্গলের পথে হাঁটবে। সেই লেখকরাই যদি ভুল পথে পা বাড়ান তাহলে সমাজের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। মহৎ সৃষ্টি সম্ভব হবে কীভাবে!

কাজেই সময় এসেছে সঠিক পথ অনুসন্ধানের। আত্মমর্যাদা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার। সবাই এক হলে দূর হবে এসব অনাচার।

লেখক : কথাশিল্পী, প্রাবন্ধিক, সাবেক যুগ্ম সচিব

 

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর