টিংকু ভাই তার জীবনের প্রচন্ড হতাশা আর কষ্টের কথা বললেন, একাকিত্বের কথা বললেন। বললেন প্রতিদিন সকালে ঘুম ভেঙে গেলে মনে হয়, না ভাঙলেই বুঝি ভালো ছিল। পৃথিবীতে বেঁচে থাকাটা প্রতি মুহূর্তে প্রচ- কষ্টসাধ্য, জীবনটাকে এক ভারী বোঝা মনে হয় এখন তার কাছে। রুবেল, রাজ্জাক, টিটন, কল্লোলসহ আরও অনেকে পালাক্রমে ভালোবেসে তার সঙ্গে থাকে কেবলই তাদের আগলে রাখার জন্য। কোনো কিছু চিন্তা না করেই বলে ফেললাম, ‘এসব কিছুর জন্য আপনিই তো দায়ী।’
রেগে গেলে নাকি কষ্ট পেলে চোখ লাল হয়! এখন তার চোখ দুটো জবা ফুলের মতো টকটকে লাল, মনে হচ্ছে হয়তো রক্ত ঝরবে। কোনো উত্তর না দিয়ে বললেন, ‘চলো, ফিরি।’
গাড়ি এবার ফিরতে শুরু করল, দুজনেই নিশ্চুপ। পুরো রাস্তায় কোনো কথা হলো না, কেউ কারও দিকে তাকাচ্ছিও না। কার্জন হলে নামার আগে ক্যাসেটটি হাতে দিয়ে বললেন, আমাকে সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। বিন্দুমাত্র অপেক্ষা না করে গাড়ি ঘুরিয়ে সাঁই করে চলে গেলেন। ভীষণ খারাপ লাগছে সরাসরি আঘাত দিয়ে এভাবে বলাটা কী ঠিক হলো?
আজও সকাল ৮টায়ই ল্যাবে ঢুকেছি। কিন্তু কাজে মন বসছে না কিছুতেই। কেমন একটা অপরাধবোধ ভিতর থেকে বারবার আহত করছে।
বিকাল ৩টায় হলের ডাইনিং রুম বন্ধ হয়ে যায়। আর সন্ধ্যা ৭টায় হলের গেট। নির্দিষ্ট সময়ের এক ঘণ্টা আগেই হলে ফিরে আনমনে ডাইনিংয়ের পাশের কয়েন বক্সটার সামনে এসে দাঁড়ালাম। রিং বাজার সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে আওয়াজ এলো, ‘হ্যালো’। একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বললাম, ‘আমি দুঃখিত, টিংকু ভাই।’
টিংকু ভাই বললেন, ‘তুমিও আমাকেই অপরাধী বানিয়ে দিলে? একবার জানতেও চাইলে না কেন, কী হয়েছিল সেদিন।’
এরপর হাউমাউ করে কান্না। পুরুষের এমন কান্নার সঙ্গে পরিচিত নই। কেমন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম। কান্না থামিয়ে একটু পর বললেন, ‘আমার সঙ্গে এখন একটু দেখা করতে পারবে?
আমি বললাম, ‘আপনি হলের গেটে আসবেন?’
তিনি বললেন, ‘না, মানুষ অযথাই তোমাকে ভুল বুঝবে। ঝটপট নিউমার্কেটের বইয়ের দোকানে আসো। ১০ মিনিট যেতে লাগবে, ১০ মিনিট বইয়ের দোকানে ঘুরবে তারপর ১০ মিনিটে ফিরবে। ৭টা বাজার আগেই ফিরতে পারবে।
নিউমার্কেট আর নীলক্ষেতের বইয়ের দোকান আমার প্রিয় জায়গা। মাসের খরচ থেকে টাকা বাঁচিয়ে প্রায়ই বই কিনতে যাই। ওখানে না যাওয়ার কোনো কারণ নেই।
নিউমার্কেটে বইয়ের দোকানে ঘুরছি। হঠাৎ পেছন থেকে টিংকু ভাই এসে বললেন, ‘চল, আজ তোমাকে বই কিনে দেব’। উত্তরে বললাম, ‘আমি তো নেব না।’ তিনি বললেন, ‘বিনিময়ে তুমিও আমাকে একটি বই উপহার দেবে।’
টিংকু ভাই আমাকে সমরেশ মজুমদারের বিখ্যাত ট্রিলজি উপন্যাস উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ উপহার দিতে চাইলেন। কিন্তু আমার এগুলো পড়া হয়ে গেছে।
আমি পছন্দ করলাম হুমায়ুন আজাদের ‘নারী।’
বইটিতে তিনি আবুল হাসানের পঙ্ক্তি থেকে ধার করে লিখলেন-
‘প্রিয়তম, পাতাগুলো ঝরে যাবে
মনেও রাখবে না, আমি কে ছিলাম, কী ছিলাম
কেন আমি সংসারী না হয়ে খুব রাগ করে হয়েছি সন্ন্যাসী
হয়েছি হিরণদাহ, হয়েছি বিজনব্যথা, হয়েছি আগুন!’
নিজের পছন্দের আরেকটি বই কিনে লিখলেন, ‘দিতে পারো একশো ফানুস এনে আজন্ম সলজ্জ সাধ আকাশে কিছু ফানুস উড়াই।’
দুটো বইয়ের নিচেই লিখলেন, প্রিয় মুন্নিকে ডা. জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু।
এবার তার বই পছন্দের পালা। এত এত বইয়ের ভিড়ে শামসুল হকের ‘আমি বাসি, তুমি বাসো তো’ বইটি বেছে নিয়ে বললেন আমি এটা নেব। কিছু একটা লিখে দাও। বইয়ের নাম দেখে আমার কেঁদে ফেলার অবস্থা এই বইয়ের পেজে আমার নাম আমি কীভাবে লিখব! না লিখে উপায় নেই। অতঃপর লিখলাম, ‘টিংকু মানে নরম কোমল শিশুর ছায়া। শ্রদ্ধেয় টিংকু ভাইকে স্নেহের মুন্নি।’
১৯৯৩ সালের বইমেলায় টিংকু ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল আচমকাই। তার সঙ্গে কে কে ছিল মনে নেই, আমার সঙ্গে ছিল ছাত্রলীগের আনিস (বর্তমানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য)। সেদিন তিনি আমায় উপহার দিয়েছিলেন খলিল জিব্রানের ‘The Prophet’. বইয়ের পাতায় লিখেছিলেন, Only the skay is your limit dear Munni. তারপর তারিখ দিয়ে তার নাম।
ঘটক হিসেবে টিংকু ভাইয়ের আবির্ভাবের আগে ঘটকের তালিকায় তদানীন্তন ছাত্রলীগ নেতা সুজন ভাই, আনসারি ভাই, অসীমদা, কামাল ভাইসহ অনেক পরিচিত মুখের সঙ্গে আমার আদরের ছোট ভাই আনিসও ছিল।
আনিসের সঙ্গে পরদিন সন্ধ্যায় কার্জন হল ফিরতি আমার দেখা। আনিস অবাক চোখে বলল, ‘শামসুল হকের বইডা তো তুমি আমার লগে কিনছিলা। কিন্তু ওই বইয়ে তার অটোগ্রাফ ছিল, টিংকু ভাই রে যে বইডা দিছ হেইডায় তো সেই অটোগ্রাফ নাই। কাহিনি কি কও দেহি।’
তার মানে টিংকু ভাই আমার কাছ থেকে ওই নামের বই কিনে নিয়ে এখন সবাইকে দেখাচ্ছে! অপমানে আমার ভীষণ কান্না পেল।
বেশ কিছুদিন তার দেখা নেই।
সারা দিন আমার ঠিকানা অর্গানিক কেমিস্ট্রি ল্যাব। ‘কার্জন হলের মূল ফটক বন্ধ করার আগে আমার খোঁজ নিতে হবে আমি আছি কি নেই’ মশিউজ্জামান স্যারের নির্দেশ। ডিপার্টমেন্টের চাবিও মাঝেমধ্যে আমার কাছে থাকে। হলে পারমিশন নেওয়া আছে দেরি হলে অসুবিধা নেই।
নিলুফার ম্যাডাম প্রভোস্টের কাছ থেকে এই পারমিশন নিয়ে দিয়েছেন। দেরি হলে একটু পর পর দারোয়ানরা এসে দেখে যায়। বলে, ঠিক আছেন আপা? কিছু কি লাগবে?
ভরসন্ধ্যায় একদিন হঠাৎ টিংকু ভাইয়ের আগমন। এই সময়টা মূলত প্রেমিক-প্রেমিকাদের জন্য। চারদিকে প্রেমিকযুগল। কার্জন হল থেকে হেঁটে হেঁটে ফেরার পথে বললেন, ‘আমি ইন্ডিয়া গিয়েছিলাম। তোমার জন্য একটা শাড়ি এনেছি।’
রাগত স্বরে বললাম, এক বই-ই আপনি সবাইকে দেখাইছেন এখন আবার শাড়ি নেব, কখনো না। আমার বিনা পারমিশনে শাড়ি কিনেছেন কেন? শাড়ি সবার কাছ থেকে নিতে নেই। আমি তো নেবই না।
পাশ দিয়ে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে একটি ছেলে হেঁটে যাচ্ছিল। তার কাছ থেকে লাইটার নিয়ে বললেন, ‘আমি এক্ষণই জ্বালাইয়া দিব। ধোঁয়া উঠবে। এইখানে পোলাপান, দারোয়ান সবাই তোমাকে চেনে, তুমিই এখন সিনিয়র। সিন করতে না চাইলে শাড়িটা ব্যাগে ঢুকাও, জলদি।’
শাড়িটা নিয়ে কোনো কথা না বলে রিকশা ডেকে চলে যাওয়ার আগে বলে দিলাম, কোনো দিন পরব না আমি।
পরদিন বেহায়া লোকটি আবারও এসেছেন। হাসতে হাসতে বলছেন, কালকের ব্যবহারের জন্য দুঃখিত। তার মাঝে এমন এক সম্মোহনী শক্তি ছিল, না হেসে উপায় নেই। হাসতে হাসতেই কত গল্প। এতদিনে তিনি জেনে গেছেন এটা আমার হলে ফেরার সময়। হাসতে হাসতেই বলে ফেললেন, ‘তোমার ইঞ্জিনিয়ারকে বাদ দিয়ে আমাকেই বিয়ে করছ না কেন?’
ভীষণ রেগে যেয়ে দৃঢ়ভাবে বললাম, ‘এসব কথা পছন্দ করছি না আমি একদম।’ আমার গলায় এমন কিছু ছিল, যা তাদের আহত করল। নিচু গলায় আর্দ্রস্বরে বললেন, ‘আমি জানি, আমার যোগ্যতা নেই তোমাকে বিয়ের প্রপোজ করার।’
আমার কেমন মায়া হলো।
একদিন রাতে হাউস টিউটরদের রুম থেকে ডাক এসেছে ফোন এটেইন করার জন্য। বন্যায় কক্সবাজার আটকে আছেন তিনি। বলছেন, তোমায় দেখতে না পেয়ে দম বন্ধ হয়ে আসছে মুন্নি। লাইনে ডিস্টার্ব তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিয়ে বাঁচলাম।
আমার থিসিস পেপার জমা দিতে আর মাত্র এক মাস বাকি। তার পরই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ, আমার মুক্তি। টিংকু ভাইয়ের সঙ্গে আর কোনো দিন গাড়ি চড়ে বেড়াতে যাইনি, ক্যাম্পাসের বাইরেও না, এক রিকশায়ও উঠিনি কোনো দিন। পুলসিরাতের মতো বড় সাবধানে পথ হেঁটেছি।
ফোন দিয়ে বললাম, আমায় আজ লং-ড্রাইভে নিয়ে যাবেন টিংকু ভাই? খানিকটা অবাক হয়ে বললেন, ‘আসছি।’
গাড়ি ছুটছে, ক্যাসেটে গান বাজছে। আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোনো কারণে তোমার কি আজ খুব মন খারাপ?’
সম্মতিসূচক মাথা নাড়ালাম। চাইলে আমার সঙ্গে শেয়ার করতে পার। আমি বললাম, ‘আজ আমার ইঞ্জিনিয়ারের বিয়ে।’ গাড়ি সজোরে ব্রেক কষলেন, কিন্তু ধাক্কা খেলেন নাকি খুশি হলেন ঠিক বুঝলাম না। আমার হাতের ওপর আলতো ছোঁয়া লাগিয়ে বললেন মন খারাপ কর না। ফিরতি পথে শাহবাগের ফুলের দোকান থেকে বিশাল এক গোলাপের তোড়া কিনে দিলেন।
কদিন পর রুমে পত্র এলো। এরপর আসতেই থাকল। প্রথম দিকের চিঠিগুলো বিষণœতায় ভরা। কিন্তু পরেরগুলো যেন এক একটি কবিতা। মানুষ এত মেধাবী হয়, এত সুন্দর লিখতে পারে কী করে!
কদিন থেকে আমার ভীষণ মন খারাপ। জামালপুর গেলাম। আমাদের পরিবারে সবাই সবার বন্ধু। অনেক দিক থেকে আমার অনেক স্বাধীনতা এখানে। সবচেয়ে বড় স্বস্তির জায়গা ‘আম্মা’। আম্মাকে আমি সবকিছু বলতে পারি।
বললাম আম্মা, ‘আমার মন খারাপ ইঞ্জিনিয়ার তো বিয়া কইরা ফালাইলো।’
আম্মা বললেন, ‘মা-হারা ছেলেটার দোষ কী? তুমি ওরে বেশি কষ্ট দিছ, অনেকবারই ওর সঙ্গে বিয়ার কথা কইছে, তাগিদ দিছে, তুমিই তো পরীক্ষা আর থিসিসের অজুহাতে কেবলই পিছাইলা। কয়দিন ছাত্রলীগের নেতায় তোমারে ডিস্টার্ব করল, সে আর কত সইবে।’
আম্মা আমাকে এবার সাবধান করে বললেন, ‘এইবার তুমি টিংকুর কথা বেশি গল্প করতাছ, তুমি অবিবাহিত মেয়ে, মায়ায় ভর্তি নরম মন, স্পর্শকাতর। অভিজ্ঞ ওই পোলা তোমারে পটাইয়া ফেলব। ওর সঙ্গে দূরত্ব মেইনটেইন কর। আর মিশবা না।’
আমি ঢাকায় ফিরে এলাম। অ্যাপ্লাইড কেমেস্ট্রির এক বড় ভাই বললেন, কাল রাতে তোমায় দেখেছি ‘তুমহারি অমৃতা’ (শাবানা আজমির পত্রনাটক) দেখতে গিয়েছিলে। আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম, প্রশ্নই ওঠে না। ছেলেটি আবারও বলল, তবে আমি কাকে দেখলাম?
বিকালবেলা টিংকু ভাই এলেন। আমরা দুজন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের বিল্ডিংয়ের সামনের সিঁড়িতে দেয়ালে হেলান দিয়ে মুখোমুখি বসে কথা বলছি। গোটা কার্জন হলের এই বিল্ডিংটা সবচেয়ে বেশি সুন্দর। আবার একই সঙ্গে ভয়ংকর। ভয়ংকর বলার কারণ হচ্ছে, এখানে বসে আমাদের সব পরীক্ষা সম্পন্ন করতে হয়।
তিনি জানালেন, ‘তুমহারি অমৃতা’ দেখতে গিয়েছিলেন। হাসতে হাসতে বললাম, সঙ্গে নিশ্চয়ই গার্লফ্রেন্ড ছিল। অপ্রস্তুত টিংকু ভাই এবার পাল্টা প্রশ্ন করলেন, কে বলছে তোমাকে? আমি উত্তর দিলাম, কার্জন হলের অনেক ইয়াং টিচার ভাবছে, আপনি বুঝি আমার প্রেমিক একই সঙ্গে ডাবল গেম খেলছেন। আমরা ভালো বন্ধু, কিন্তু বন্ধুত্বটা সবাই বোঝে না। প্রশ্ন করলাম, কে সেই নারী? টিংকু ভাই লজ্জা পেলেন। কিন্তু উত্তর দিলেন না। আমি নিশ্চিত তার অন্য কোনো নারীর সঙ্গে সম্পর্ক চলছে।
লেখক : মানবতাবাদী লেখিকা