শনিবার, ১১ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা
মুক্তিযুদ্ধ

ক্র্যাক প্লাটুনের পুনর্মিলনী

জিল্লুর রহিম দুলাল

ক্র্যাক প্লাটুনের পুনর্মিলনী

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ‘ক্র্যাক প্লাটুন’র বৃত্তান্ত পটভূমি এবং বিজয় দিবস পর্যন্ত এ বাহিনীর আত্মত্যাগ দেশপ্রেমের এক বিস্ময়কর কাহিনি। যুগে যুগে দেশপ্রেমিকদের কাছে এ ‘ক্র্যাক প্লাটুনের’ কথা প্রবহমান থাকবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসের লগ্নে প্রতি বছরই এ সংগঠনের পুনর্মিলনী উৎসব হয়। যারা তখন তরুণ জীবনের সমস্ত রক্ত দিয়ে এ আত্মবিসর্জনের সংগঠন নির্মাণ করেছিলেন তারা এখনো যেন তরুণ প্রজন্মের মতোই দীপ্তিমান। তাদের অবিচলিত বিশ্বাস দেশপ্রেমিক মানুষ কখনো বৃদ্ধ হয় না। অচল হয় না। দেশপ্রেম রক্তে রক্তে তারুণ্যের উজ্জ্বলতা সৃষ্টি করে।

বঙ্গবন্ধুর অটল নেতৃত্বে সারা বাংলাদেশে তখন অসহযোগ আন্দোলন সমগ্র বিশ্বকে আকর্ষণ করেছে। স্বাধীনতার দুর্বার আন্দোলনে সমগ্র বাঙালি যে ঐক্য সৃষ্টি করেছে তার কোনো পরিমাপ নেই। পাকিস্তানের কাপুরুষ শোষকরা যখন ২৫ মার্চের অন্ধকারে ঢাকায় এবং সারা দেশে হত্যাযজ্ঞ শুরু করল তখন আমরা যারা এসব হামলার অনুমান করছিলাম তারাও অসীম সাহস নিয়ে পরিস্থিতির মোকাবিলা শুরু করলাম। সেই এক দীর্ঘ কাহিনি। খুব দ্রুততার সঙ্গে আমাদের উদ্দেশ্য এবং কাজকে সুসংহত রূপ দিতে হলো। ৫৬ ভজহরি সাহা স্ট্রিটে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ভাইয়ের বাড়িতে পরামর্শ-সভা বসল। সবাই একসঙ্গে শপথ নিলাম- ভারত গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেব।

এপ্রিলের শেষদিকে রওনা দিলাম আমরা। ছোট ছোট গ্রুপ করে আমাদের যাত্রা শুরু হলো আগরতলার দিকে। কারণ বড় গ্রুপ নিয়ে গেলে পাকসেনা ও তাদের দালালদের কাছে ধরা পড়তে হবে এবং অত্যাচারের পর নির্ঘাত হত্যার শিকারে পরিণত হওয়া। পথঘাট অচেনা, খুবই সন্তর্পণে আস্তে আস্তে বুঝেশুনে এগোতে হবে প্রতিটি মুহূর্তে।

একটু ভুল করলেই মহাবিপদ। আমরা কুমিল্লার কসবা হয়ে সতর্কতার সঙ্গে এগোতে লাগলাম। বহু খেত-খামার, অলিপথ, ঝোপ-জঙ্গল পেরিয়ে অবশেষে সীমান্তে পৌঁছতে পারলাম। সেখানে আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদ সদস্য অভ্যর্থনা-শিবিরের প্রধান। তিনি বাছাই করে সার্টিফিকেট দিয়ে দেন- কাদের মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। তাদের ভয় ছিল গোলেমালে পাকসেনাদের কোনো এজেন্ট যেন মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সুকৌশলে ঢুকতে না পারে। ওই সময় এরকম ঘটনা ঘটেছিল। তাই নেতারা খুবই সতর্ক ছিলেন। আমরা সবাই ত্রিপুরার মতিনগর পৌঁছলাম। সেখানে ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স আমাদের আটকে দিল। ইতোপূর্বেই বাংলাদেশ থেকে একজন বাঙালি মেজর অবস্থান করছিলেন। তার সুপারিশে ছাড় পেলাম এবং সেখান থেকে পায়ে হেঁটেই মেলাঘর ক্যাম্পে পৌঁছলাম। মেলাঘর খুবই পরিচিত জায়গা। মেলাঘর ক্যাম্পের প্রশিক্ষণ প্রার্থীদের প্রথম ব্যাচ। আমরা নিবিষ্টভাবে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। দুই প্রতিপক্ষকে কীভাবে ঘায়েল করে নিজের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে সেসবের তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক বিষয়াদি হাতে-কলমে শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিল। প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন আমাদের মুক্তিবাহিনীর নন-কমিশন্ড অফিসাররা আর ভারতীয় কিছু সামরিক অফিসার। আমাদের বলা হয়েছিল- পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে কীভাবে আতঙ্ক সৃর্ষ্টি করতে হবে। আমরা নানারকম অস্ত্র নিয়ে ঢাকায় ঢুকলাম। সৃষ্টি হলো ‘ক্র্যাক প্লাটুন’। একদল গেরিলা যোদ্ধার অবিস্মরণীয় সংগ্রাম। সমগ্র ঢাকা শহরে সেই আট মাসে প্রায় শ খানেক অপারেশন হয়েছিল। মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, হাবিবুল আলম, আবু সাঈদ খান, গাজী গোলাম দস্তগীর, আলী আহমেদ জিয়াউদ্দীনসহ আরও অনেকে ঢাকার পাওয়ার স্টেশন বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেওয়াসহ আরও অনেক অপারেশনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। অন্য যেসব গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনে প্রত্যক্ষভাবে সক্রিয় ছিলাম গেরিলারূপে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল অপারেশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্র, জিন্নাহ এভিনিউর ‘গ্যানিস’ স্টোর অপারেশন। এ অপারেশনগুলো ঢাকার পাকিস্তান আর্মিদের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করেছিল। কতবার যে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছি #কিন্তু আমরা মৃত্যুভয় ভুলে গিয়েছিলাম। আমাদের আত্মায় ছিল শুধু ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’। আমাদের এ প্লাটুনের নামকরণ করেছিলেন ২ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়লগ্নে আমাদেরই প্রিয় নেতা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা প্রথম উত্তোলন করেছিলেন ঢাকার বুকে। সেদিন থেকেই ‘ক্র্যাক প্লাটুন’ পূর্ণতা পেল বাংলাদেশের অন্তহীন সংগ্রামের অনন্ত ধারায়। এখন যে প্রতি বছর আমাদের পুনর্মিলন হয় সেটাও মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া এবং তারই সহধর্মিণী রিনি চৌধুরীর সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানে। আমাদের এ পুনর্মিলন ধীরে ধীরে একটি জাতির জন্য তরুণ প্রজন্মের সৈনদল সৃষ্টির প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। বাংলার জনগণের সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে ‘ক্র্যাক প্লাটুন’ এক অনিবার্য নাম।

সর্বশেষ খবর