শনিবার, ১৮ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

‘এই চোর কোথা থেকে পয়দা হয়েছে তা জানি না’

সৈয়দ বোরহান কবীর

‘এই চোর কোথা থেকে পয়দা হয়েছে তা জানি না’

সৈয়দ বোরহান কবীর

১৭ মার্চ বাংলাদেশ গভীর শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় পালন করল জাতির পিতার জন্মদিন। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন ‘সোনার বাংলা’। আধুনিক, উন্নত, সুখী, সমৃদ্ধিশালী এক স্বনির্ভর বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণের এক রূপকল্প তৈরি করেছিলেন। মাত্র সাড়ে তিন বছরে তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত, ধ্বংসস্তূপে পরিণত এক দেশকে পুনর্গঠনে অসাধারণ সাফল্য দেখিয়েছিলেন। কিন্তু জাতির পিতার অতৃপ্তি ছিল। ছিল পদে পদে বাধা। এসব বাধার কথা, উন্নয়নের শত্রুদের কথা তিনি প্রকাশ্যে বলতেন, কোনো রাখঢাক ছাড়াই। ২৬ মার্চ, ১৯৭৫ সালে মহান স্বাধীনতা দিবসে শহীদ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ভাষণে তিনি দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন। ওই ভাষণে জাতির পিতা বলেছিলেন, ‘রাজনৈতিক স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যায়, যদি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না আসে। যদি দুঃখী মানুষ পেট ভরে খেতে না পারে, কাপড় পরতে না পারে, বেকার সমস্যা দূর না হয়; তাহলে মানুষের জীবনে শান্তি ফিরে আসতে পারে না। আজ কে দুর্নীতিবাজ? যে ফাঁকি দেয়, সে দুর্নীতিবাজ। যে ঘুষ খায়, সে দুর্নীতিবাজ। যে স্মাগলিং করে, সে দুর্নীতিবাজ। যে ব্ল্যাক মার্কেটিং করে, সে দুর্নীতিবাজ। অর্থ পাচার করে যে, সে দুর্নীতিবাজ। যারা কর্তব্য পালন করে না, তারা দুর্নীতিবাজ। যারা বিবেকের বিরুদ্ধে কাজ করে, তারা দুর্নীতিবাজ। যারা বিদেশের কাছে দেশকে বিক্রি করে, তারাও দুর্নীতিবাজ। এই দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম শুরু করতে হবে। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়তে হবে। সে দুর্গ গড়তে হবে দুর্নীতিবাজদের খতম করার জন্য। বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের দুঃখ মোচন করার জন্য। ... এ তো চোরের চোর, এই চোর যে কোথা থেকে পয়দা হয়েছে তা জানি না। পাকিস্তান সব নিয়ে গিয়েছে কিন্তু এই চোরদের তারা নিয়ে গেলে বাঁচতাম।’ (সূত্র : শেখ মুজিব বাংলাদেশের আরেক নাম - ড. আতিউর রহমান। পৃষ্ঠা : ২৬৭-২৬৮)

বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে হাঁটছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গত ১৪ বছরে বাংলাদেশ অর্জন করেছে অভাবনীয় সাফল্য। কিন্তু এখনো সেই চোরের উৎপাত। সেই দুর্নীতিবাজদের উৎসবের নৃত্য। এই দুর্নীতিবাজ, অর্থ পাচারকারী লুটেরা এবং ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা এখন দেশের অর্থনীতি, অগ্রগতির সবচেয়ে বড় বাধা। এরা এ দেশের জন্য ব্যাধি। এরা ভয়ংকর ক্যান্সার। এদের প্রতিহত করতে না পারলে আমরা ‘সোনার বাংলা’ গড়তে পারব না। আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তিও হবে অসম্ভব। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। মুদ্রাস্ফীতি আট ভাগের বেশি। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের সম্মেলনে যোগ দিয়ে বলেছেন, ‘দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মানুষের কষ্ট হচ্ছে।’ বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ৩০ বিলিয়ন ডলারের খানিকটা বেশি। এ কথা সত্য, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমাদের অর্থনীতিতে বড় একটা ধাক্কা লেগেছে। কিন্তু যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনীতি আরও অনেক শক্ত অবস্থানে থাকত। যদি অর্থ পাচার বন্ধ করা যেত, ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণের পাহাড় না হতো। বঙ্গবন্ধু যে ‘চোর’দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন, তারা এখন ‘ডাকাত’ নয়, ‘দানব’-এ পরিণত হয়েছে। এরা আমাদের সব স্বপ্ন, সব অর্জন রক্তচোষার মতো চুষে খাচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ করতেই হবে। এদের পরাজিত করতেই হবে।

বাংলাদেশ এখন বিশ্বে অন্যতম অর্থ পাচারকারী দেশ। দেশ থেকে এ পর্যন্ত কত অর্থ পাচার হয়েছে, তার সঠিক তথ্য কারও কাছেই নেই। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে অর্থ পাচারের যে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য-উপাত্ত আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, তা একসঙ্গে যোগ করলে এর পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। বিদেশে পাচার না হয়ে যদি এ অর্থ দেশে থাকত, তাহলে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হতো ১৩০ বিলিয়ন ডলার। আমরা বিশ্বে ২০তম অর্থনৈতিক শক্তির দেশে পরিণত হতাম। অর্থ পাচার নিয়ে এখন আর কোনো লুকোচুরি নেই। সবাই জানে কারা অর্থ পাচার করেছে। কোথায় করেছে। কিছু কিছু অর্থ পাচারের ঘটনা প্রমাণিত। এই যেমন হঠাৎ করে সংসদ সদস্য বনে যাওয়া শহিদ ইসলামের কথাই ধরা যাক। ২০১৮ সালের নির্বাচনে সবাইকে চমকে দিয়ে শহিদ লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য হলেন। সংসদ সদস্য থাকা অবস্থায় মানব পাচার, ভিসা জালিয়াতি এবং অর্থ পাচারের অভিযোগে কুয়েতে তাকে গ্রেফতার করে সেখানকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কুয়েতের অপরাধ তদন্ত সংস্থা আদালতে প্রমাণ করে যে, শহিদ ৫৩ মিলিয়ন কুয়েতি দিনার (১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা) পাচার করেছেন। চার বছরের কারাদন্ডে দন্ডিত হয়ে শহিদ এখন কুয়েতের কারাগারে। তার সংসদ সদস্য পদ বাতিল হয়েছে বটে। কিন্তু পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। ২০২০ সালে বাংলাদেশে একজন ‘গৃহবধূ’র বিপুল বিত্তের খবর বিশ্ব গণমাধ্যমে তোলপাড় সৃষ্টি করে। শামীমা সুলতানা জান্নাতী নামে বাঙালি এক গৃহবধূ কানাডায় ১৪ লাখ ৫৬ হাজার কানাডিয়ান ডলারে বাড়ি কিনে হইচই ফেলে দেন। জান্নাতী একজন সংসদ সদস্যের স্ত্রী। শুধু জান্নাতী কেন? কানাডায় বাংলাদেশিদের অর্থ পাচারের তালিকা এত দীর্ঘ হবে যে, পুরো ‘বাংলাদেশ প্রতিদিনে’ তার স্থানসংকুলান হবে না। কানাডায় আলোচিত অর্থ পাচারকারী প্রশান্ত কুমার হালদার কিছুদিন আগে ভারতে আটক হয়েছেন। অথচ বাংলাদেশে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকার পরও প্রশান্ত অবলীলায় পালিয়ে যান। দুর্নীতি দমন কমিশন বলেছিল, প্রশান্ত কুমার হালদার ৫ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন। কিন্তু ভারতে আটক হওয়ার পর জেরার মুখে প্রশান্ত বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে পাচার করা টাকার পরিমাণ ১০ হাজার কোটির কাছাকাছি। ভারতের তদন্ত কর্মকর্তাদের প্রশান্ত বলেছেন, ‘এ টাকা তার না, তিনি বাহকমাত্র।’ টাকার মালিক কে সবাই জানেন। তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে। কানাডায় অর্থ পাচার এবং বেগমপাড়ায় বাংলাদেশিদের বাড়ির ব্যাপারে সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী কথা বলেন খোলামেলা, রাখঢাক ছাড়াই। ২০২০ সালের নভেম্বরে এক অনুষ্ঠানে ড. মোমেন বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে কানাডায় টাকা পাচারের যে গুঞ্জন আছে, তার কিছুটা সত্যতা পাওয়া গেছে। আর প্রাথমিক তথ্যানুযায়ী টাকা পাচারের ক্ষেত্রে সরকারি কর্মচারীদের সংখ্যাই বেশি।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘মনে করেছিলাম রাজনীতিবিদদের সংখ্যা বেশি হবে। কিন্তু দেখা গেল রাজনীতিবিদ চারজন। সরকারি কর্মচারীর সংখ্যাই বেশি। এ ছাড়া কিছু ব্যবসায়ী আছেন।’ অর্থাৎ কানাডায় পাচারকারীদের যাবতীয় তথ্য সরকার জানে। এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফরিদপুরের দুই অখ্যাত ছাত্রনেতা বরকত ও রুবেলের কথা এখন আর কোনো গোপন বিষয় নয়। আগে ছাত্রদল করতেন, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ফরিদপুরের ‘জমিদার’ হিসেবে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর বরকত-রুবেল ছাত্রলীগ হয়ে যান। এরপর শুরু হয় ফরিদপুরে লুটপাটের রাজত্ব। ফরিদপুরে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ রাজত্বের অবসানের পর গ্রেফতার হন রুবেল-বরকত। সিআইডি জানায়, প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন এ দুজন। মোশাররফ চক্রের বেশ কয়েকজনকে অর্থ পাচারের অভিযোগে গ্রেফতার করেছে সিআইডি। এদের বিরুদ্ধে মোট ৫ হাজার কোটি টাকা পাচারের তথ্যপ্রমাণ খুঁজে বের করেছে সিআইডি। কিন্তু এ টাকা উদ্ধারের কোনো অগ্রগতি জাতি জানে না। অর্থ পাচার প্রতিরোধে বাংলাদেশ ব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) গঠন করেছে। বিএফআইইউর বার্ষিক প্রতিবেদনে (২০২১-২২) বলা হয়েছে, ২০ থেকে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত মূল্য বাড়ানো দেখিয়ে কোনো কোনো পণ্য আমদানি করা হয়েছে। এর অর্থ দাঁড়ায়, ১০০ ডলার দিয়ে আমদানি করে তা ২০০ ডলার দেখানো হয়েছে। সে ক্ষেত্রে কী পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে কিছুটা হলেও অনুমান করা যায়। ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিগত ১৪ বছরে বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালেই বাংলাদেশ থেকে ৪ হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার বা সোয়া ৪ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। জিএফআইয়ের তথ্যমতে, শুধু আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চালান জালিয়াতির মাধ্যমেই ১২ বিলিয়ন ডলারের বেশি পাচার হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব গ্রহণ করে আমদানিতে ‘ওভার ইনভয়েসিং’, রপ্তানিতে ‘আন্ডার ইনভয়েসিং’-এর লাগাম টেনে ধরেছেন আবদুর রউফ তালুকদার। এখন একটি এলসি খোলা হলে প্রস্তাবিত আমদানি পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য আগে যাচাই করা হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর পণ্য আমদানির অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। নতুন গভর্নর আসার আগে বিভিন্ন আমদানি পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্য দেখে ভিরমি খেতে হয়। যেমন ১ কেজি স্ট্রবেরি ফলের আমদানি মূল্য দেখানো হয়েছে ১ হাজার ডলার! মাল্টা ও কমলা আমদানি করা হয়েছে ৮০০ ডলার কেজিতে। এসব আজগুবি মূল্যবৃদ্ধি যে স্রেফ অর্থ পাচারের জন্যই করা হয়েছে, তা বুঝতে পন্ডিত হওয়ার দরকার হয় না। এক বছরে প্রায় ১০ হাজার কোটি ডলারের ফল আমদানি করা হয়েছে। এ ফল কে খেল? শুধু ওভার ইনভয়েসিং নয়, আন্ডার ইনভয়েসিং করে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচার করা হয়েছে। এসব অর্থ পাচারের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম, কানাডায় বেগমপাড়াসহ উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ, পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ এমনকি আফসোর দ্বীপে বিনিয়োগ করা হয়েছে। গার্মেন্ট, ফল ইত্যাদি ব্যবসায় জড়িত কারা কত টাকা পাচার করেছে, কোথায় রেখেছে তা সবাই জানে। সরকারেরও অজানা থাকার কথা নয়। সিঙ্গাপুরে কোন ব্যবসায়ী পাঁচ তারকা হোটেল কিনেছেন, সে খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। সিঙ্গাপুরের ধনীদের খাতায় নাম লেখানো বাংলাদেশির টাকা কোত্থেকে সিঙ্গাপুরে গেল? বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার করেই কেউ কেউ থাইল্যান্ডে গড়ে তুলেছেন বিশাল সাম্রাজ্য। শুধু আমদানি-রপ্তানি কেন, মোবাইল আর্থিক লেনদেনের জালিয়াতির মাধ্যমেও বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হচ্ছে। সিআইডির তথ্যানুযায়ী এ ধরনের জালিয়াতির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে ৭ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। অনেক লুটেরা দুর্নীতিবাজ টাকা পাচার করে সুইজারল্যান্ডে রাখেন। সুইস ব্যাংকগুলোকে অনেকে অর্থ জমা রাখার নিরাপদ আশ্রয়স্থল মনে করেন। ২০২১ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা টাকার পরিমাণ ৮ হাজার ২৭৬ কোটি। ২০২০ সালে ছিল ৫ হাজার ৩৪৮ কোটি। এক বছরেই সুইস ব্যাংকে পাচার করা অর্থ জমা হয়েছে ৩ হাজার কোটি। এ টাকা কারা পাচার করছে?

দেশ থেকে টাকা পাচার করে ‘কর স্বর্গ’ বা ‘ট্যাক্স হেভেন’ বলে পরিচিত দ্বীপরাষ্ট্রে কোম্পানি খুলেছেন অনেকে। এদের মধ্যে ৮৪ জনের নাম প্রকাশ করেছে ‘পানামা পেপারস’ ও ‘প্যারাডাইস পেপারস’। ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট (আইসিআইজে) তাদের ওয়েবসাইটে ওই তালিকা প্রকাশ করেছিল বেশ আগে। এ তালিকায় বিএনপির প্রভাবশালী নেতা আবদুল আউয়াল মিন্টু, তার স্ত্রী-পুত্রের নাম আছে। হাই কোর্টে দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী বলেছিলেন, এদের ব্যাপারে দুদক তদন্ত করছে। কিন্তু সেই তদন্তের পরিণতি কী কেউ জানেন না। যারা অর্থ পাচার করে তাদের অনেকেই সরকারের ঘনিষ্ঠ। সরকারের চারপাশে এদের বিচরণ দৃশ্যমান। এদের অনেকে একসময় বিএনপি এবং হাওয়া ভবনের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এখন এরা রং বদল করে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ হয়েছেন। ইদানীং পাচার করা টাকা থেকে তারা লন্ডনে পলাতক বিএনপি নেতাকেও হিসসা দেন বলে শোনা যায়। ভবিষ্যৎ শঙ্কামুক্ত রাখতেই এরা দুই নৌকায় পা রাখেন। এরা দেশের স্বার্থ দেখেন না। নিজেদের বীভৎসভাবে উপস্থাপন করতে ব্যস্ত।

অর্থ পাচারকারীরা যেমন ভয়ংকর ব্যাধি, তেমনি আমাদের অর্থনীতিতে আরেক ব্যাধির নাম ঋণখেলাপি। কিছুদিন আগে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এক ভাষণে বলেছেন, ‘অনেকে ব্যাংকের টাকা মেরে দেওয়ার জন্যই ব্যাংক ঋণ নেয়। এরা খেলাপি হয় ইচ্ছাকৃতভাবে।’ রাষ্ট্রপতি যথার্থই বলেছেন, গত কয়েক বছরে কিছু ভুতুড়ে ঋণ ব্যাংকিং খাতকে এক গভীর সংকটে ফেলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী গত অর্থবছরের শেষে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। প্যাডসর্বস্ব, নাম-গোত্রহীন কোম্পানির নামে শত শত কোটি টাকা ঋণ বরাদ্দ করা হয়েছে। স্পষ্টতই বেসরকারি খাতে প্রভাবশালী গোষ্ঠী তাদের চাকরবাকর, চামচা-চামুন্ডাদের দিয়ে কোম্পানি খুলে রীতিমতো ব্যাংক লুট করেছে। কেউ কেউ ব্যাংক থেকে ঋণ জালিয়াতি করে বিদেশে। হলমার্ক কেলেঙ্কারির টাকা উদ্ধার হয়নি। ব্যাংকের টাকা মেরে বিদেশে পালিয়ে বিলাসী জীবনযাপন করছেন বিসমিল্লাহ গ্রুপের মালিক। ছয়টি ব্যাংক থেকে তারা ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিলেন ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে। এখন এই গ্রুপের মালিক দুবাইয়ে বসবাস করছেন। এ রকম হায় হায় কোম্পানি হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে এখন বিদেশে আরাম-আয়েশের জীবন কাটাচ্ছেন। আর কষ্টে আছে বাংলাদেশের মানুষ। ব্যাংকিং খাতে মালিকদের সিন্ডিকেট হয়েছে। কয়েকজন ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে প্রায় সব বেসরকারি ব্যাংকের মালিকানা। এরা এখন নব্য আওয়ামী লীগ হয়েছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ভাষায় এরা ‘চোর’।

অর্থমন্ত্রী ২০১৮ সালে দায়িত্ব নিয়ে বলেছিলেন, আর এক টাকাও খেলাপি ঋণ বাড়বে না। অর্থমন্ত্রী কথা রাখেননি। গত চার বছরে খেলাপি ঋণ দ্বিগুণ হয়েছে। এদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি ঋণ আর উদ্ধার হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। অর্থ পাচার বন্ধেও অর্থমন্ত্রীর টোটকা কাজে লাগেনি। গত বাজেট বক্তৃতায় পাচারকারীদের জন্য অর্থমন্ত্রী সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু অর্থবছরের প্রথম আট মাসে একজনও পাচার করা অর্থের এক কানাকড়িও ফেরত আনেনি। কেউ তো আত্মস্বীকৃত চোর হতে চায় না। কাজেই ৭ দশমিক ৫ শতাংশ কর দিয়ে কেউ পাচার করা অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার ঝুঁকি নেবে না, এটা সহজেই অনুমেয়। ক্ষমা নয়, কঠোর হতে হবে। না হলে পাচারকারী ও ঋণখেলাপিদের কাছে জিম্মি হয়ে যাবে দেশের মানুষ। অর্থ পাচারকারী, ঋণখেলাপি এবং দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। যে আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন জাতির পিতা। সম্প্রতি এ ক্ষেত্রে কিছুটা আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কঠোর অবস্থান ঘোষণা করেছেন। অর্থ পাচারকারী এবং ঋণখেলাপি যে-ই হোক, তাদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী কঠোর অবস্থানের বার্তা দিয়েছেন। সেই বার্তার সূত্র ধরেই আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং জনপ্রিয় নেতা আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমের সাম্প্রতিক কিছু বক্তব্য রাজনীতিতে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। নাছিম বলেছেন, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে, স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে, লুটেরাদের বিরুদ্ধে, ঋণখেলাপি এবং ব্যাংক লুটেরাদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। এরা হলো দেশের শত্রু, শেখ হাসিনার উন্নয়ন-সমৃদ্ধির বড় বাধা। বাহাউদ্দিন নাছিমের বক্তব্য আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর আকাক্সক্ষার অনুরণন। ঋণখেলাপি, অর্থ পাচারকারী, দুর্নীতিবাজরা কারও বন্ধু হতে পারে না। এরা গণশত্রু। জাতির পিতা ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ যে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন, তাতে দুটি অংশ ছিল। এক. রাজনৈতিক স্বাধীনতা। দুই. অর্থনৈতিক মুক্তি। রাজনৈতিক স্বাধীনতার প্রতিপক্ষ যেমন ছিল রাজাকার, আলবদর এবং যুদ্ধাপরাধী। তেমনি অর্থনৈতিক মুক্তির পথে বাধা হলো দুর্নীতিবাজ, অর্থ পাচারকারী এবং ঋণখেলাপি। এরাই এ কালের যুদ্ধাপরাধী। এদের ‘না’ বলতে হবে। এদের বয়কট করতে হবে। তা না হলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ কখনো অর্জিত হবে না। জাতির পিতা এই চোরদের খতম করার ডাক দিয়েছিলেন। এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধটা শেষ করতে হবে তাঁর কন্যাকেই। এ যুদ্ধে শেখ হাসিনাকে জয়ী হতেই হবে। ’৭৫-এর পর বাংলাদেশে লুটেরা, কালো টাকার মালিক, দুর্বৃত্তরা মূলধারার রাজনীতিতে প্রবেশ করে। সামরিক স্বৈরাচার- একনায়কদের পৃষ্ঠপোষকতায় এরা রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। এই দুর্বৃত্ত-ডাকাতরা যখন যার তখন তার। সব সরকারের আমলেই এরা চাটুকারিতা করে। রাষ্ট্রের রক্ত চুষে খায়। সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ খোঁজে। টানা ১৪ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। এসব সুযোগসন্ধানী লুটেরার দল এখন সরকার ও আওয়ামী লীগে ভিড় করছে। এদের অতীত ঘাঁটলে দেখা যায়, এরা এরশাদের সময় লুট করেছে, হাওয়া ভবনের ঘনিষ্ঠ হয়ে নিজেদের বিত্তবৈভব বানিয়েছে। এখন এরা আওয়ামী লীগের চেয়েও বড় আওয়ামী লীগ হয়ে গেছে! এদের কারণে আওয়ামী লীগের ত্যাগী-পরীক্ষিতরা কোণঠাসা। টাকার জোরে এরা মনোনয়ন নেয়, অথবা তাদের পছন্দের লোকজনকে মনোনয়ন পাইয়ে দেয়। লুটেরা টাকা দিয়ে এরা আওয়ামী লীগের কমিটিতে ঢুকে যাচ্ছে। আমাদের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে এরা বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছে। এদের ছলনার চোরাবালিতে পা দিলে সরকারের সব অর্জন নষ্ট হয়ে যাবে। আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনের আগেই অর্থ পাচারকারী ও ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করুক; এটা জনগণের প্রত্যাশা। ক্ষমতার চারপাশে কোনো লুটেরাকে জনগণ দেখতে চায় না। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেই, এদের বয়কট করলেই আওয়ামী লীগের পক্ষে জোয়ার সৃষ্টি হবে। দেশ বাঁচবে। অর্থনীতি বাঁচবে। এই কঠোর অবস্থান একমাত্র শেখ হাসিনাই নিতে পারেন। অর্থ পাচারকারী, ব্যাংক লুটেরারা বাংলাদেশের ক্যান্সার। রোগ চিহ্নিত হয়েছে। এখন চিকিৎসা দরকার দ্রুত।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

[email protected]

সর্বশেষ খবর