শনিবার, ১৮ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

পিঁয়াজবীজের চাষ সম্প্রসারণ ঠাকুরগাঁওয়ে

শাইখ সিরাজ

পিঁয়াজবীজের চাষ সম্প্রসারণ ঠাকুরগাঁওয়ে

একসময়ের মঙ্গাকবলিত উত্তরাঞ্চল এখন ফলফসলে সমৃদ্ধ। ধান-পাট-আখ-তামাকের জায়গায় যুক্ত হয়েছে নানানরকম ফলফসল। ওপর থেকে দেখলে মনে হয় বিচিত্র ফসলের কার্পেট বিছানো ভূমি। রকমারি কৃষিই পাল্টে দিয়েছে এ অঞ্চলের অর্থনীতি, কর্মসংস্থানের হিসাব, উন্নয়নের চিত্র। কয়েক বছর ধরে এখানকার ফসলের মাঠে উচ্চমূল্যের ফলফসলের পাশাপাশি আশার রং ছড়াচ্ছে বিদেশি ফুল টিউলিপের মোহনীয় রং। আর এখন শুভ্র সাদা ফুলের মাঠে চাষ হচ্ছে সাদা সোনার, অর্থাৎ পিঁয়াজবীজের।

প্রিয় পাঠক! ফরিদপুরের অম্বিকাপুরের শাহেদা বেগম ঠাকুরগাঁওয়ের সীমান্তবর্তী দানাজপুরে প্রথমবারের মতো চাষ করেছেন পিঁয়াজবীজের। দারুণ এক সম্ভাবনার গল্পই আজ আপনাদের শোনাতে চাই। বলছিলাম উত্তরাঞ্চলের রংপুর, কুড়িগ্রাম, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী একসময় ছিল ভীষণ দারিদ্র্যপীড়িত। দারিদ্র্যের মূল কারণ ছিল কর্মহীনতা। এক ফসলি বলে বছরের দীর্ঘ সময় মানুষের কাজ থাকত না, থাকত না উপার্জন। সেচসুবিধা বৃদ্ধি, শর্ট-টার্ম ভ্যারাইটির ফসল উদ্ভাবন, তার ওপর ফসল বৈচিত্র্য পাল্টে দিয়েছে এ এলাকার চিত্র। বছর পাঁচেক আগে কৃষকের ঈদ আনন্দ অনুষ্ঠান ধারণ করতে গিয়েছিলাম কুড়িগ্রামে। সেখানে এক সন্ধ্যায় কৃষকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। কেমন আছেন জানতে চাইলে এক কৃষক বলেছিলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ বেশ ভালো আছি। আগে আমাদের চিন্তা করতে হতো কী খাব আর এখন চিন্তা করি কী দিয়ে খাব। কারণ আমাদের ফলফসলের চাষ বেড়েছে, সমৃদ্ধি এসেছে।’ সত্যি ফসল বৈচিত্র্যে দারুণ সমৃদ্ধ উত্তরাঞ্চল। অভাবের আর এক অভিশাপ ছিল তামাক চাষ। সেখান থেকেও ক্রমে বের হয়ে এসেছে কৃষক। সেই উত্তরাঞ্চলে নতুন সম্ভাবনার বীজ বপন করেছেন শাহেদা বেগম। গত সপ্তাহে তাঁর নতুন এ কার্যক্রম দেখে আসার সুযোগ হয়েছে। তিনি ঠাকুরগাঁওয়ে ৪০ একর জমিতে পিঁয়াজবীজ উৎপাদন শুরু করেছেন। অধিকাংশই লিজ নিয়েছেন চিনিকলের পতিত জমি। দানাজপুরে সীমান্তবর্তী এলাকায় ১৫ একর জমিতে পিঁয়াজবীজের চাষ দেখে অভিভূত হলাম। মাঠের পর মাঠ সাদা ফুলে ছেয়ে আছে। বাতাসে দোল তুলেছে সাদা সাদা গুচ্ছবাঁধা পিঁয়াজ ফুল। পাঠক, যারা পিঁয়াজ ফুল দেখেননি তাদের বলতে চাই পিঁয়াজফুল দেখতে অনেকটা কদমফুলের মতোই গোলাকার। লম্বা ডাঁটায় গোল সাদা সাদা ফুল। বাতাসে দোল খাচ্ছে। এক মনোরম দৃশ্য, চোখ জুড়িয়ে যায়। বছর বিশেক আগেও এখানে আখের চাষ হতো। ক্রমাগত লোকসানে সুগার মিলগুলো বন্ধ হয়ে গেলে পতিত পড়ে ছিল এসব চাষের জমি। এখন এ জমিতেই শাহেদা বেগম চাষ করছেন সাদা সোনার।

শাহেদা বেগম কৃষির এক অনন্য উদ্যোক্তা। ফরিদপুর, শরীয়তপুর, রাজবাড়ী এসব এলাকায় পিঁয়াজবীজের বাণিজ্যিক চাষের যে বিশাল কর্মকান্ড চোখে পড়ে তার সূচনা পর্বের একজন শাহেদা বেগম। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন পিঁয়াজের চাহিদার বিপরীতে এর উৎপাদন বাড়ানোর গুরুত্ব। সেই তাগিদ থেকে অল্প অল্প করে বাড়াতে থাকেন তাঁর চাষের পরিধি। সেই সঙ্গে পরিধি বিস্তৃত হয় তাঁর কৃষি সাফল্যেরও। দেশের পিঁয়াজবীজের চাহিদার বড় একটি অংশ জোগান তিনি। আমি একাধিকবার তাঁর সাফল্যের চিত্র টেলিভিশনে তুলে ধরেছি। এরপর কৃষিতে তাঁর অবদানের কথা উঠে এসেছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে। চোখে পড়েছেন রাষ্ট্রযন্ত্রের। পেয়েছেন কৃতিত্বের স্বীকৃতি। বিভিন্ন পুরস্কার আর সম্মানে ভূষিত হয়েছেন তিনি। বছরখানেক আগে সেরা নারী কৃষক হিসেবে পেয়েছেন স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড-চ্যানেল আই অ্যাগ্রো অ্যাওয়ার্ড। শাহেদা বেগম আজ প্রতিষ্ঠিত নারী কৃষি উদ্যোক্তা। পিঁয়াজ মাঠে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছিলাম তাঁর সঙ্গে। বলছিলেন তাঁর সূচনার কথা, আগামীর স্বপ্নের কথা।

‘আমার শ্বশুর পিঁয়াজবীজ চাষ করতেন। একেবারেই নিজেদের চাহিদা পূরণের জন্য যতটুকু লাগে, সামান্য জমিতে। যখন দেখলাম পিঁয়াজের চাহিদা দিন দিন বেড়ে চলেছে, পিঁয়াজ নিয়ে সংকট তৈরি হচ্ছে; কখনো কখনো দামও চলে যাচ্ছে হাতের নাগালের বাইরে; তখন বাণিজ্যিকভাবে পিঁয়াজের বীজ উৎপাদন শুরু করলাম। অল্প অল্প করেই বাড়তে থাকল। আমাদের কাজকর্ম দেখে কৃষি বিভাগ এগিয়ে এলো। কীভাবে উন্নত বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বাজারজাত করতে হয় পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দিল। আমার দেখাদেখি আরও অনেকেই যুক্ত হলো পিঁয়াজবীজ উৎপাদনে।’ একনাগাড়ে কথাগুলো বলে গেলেন শাহেদা বেগম। অতীত সাফল্যের আভা ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর চোখে মুখে। ‘গত দুই বছর গরম বেশি হওয়ায় পিঁয়াজবীজের কাক্সিক্ষত ফলন পাচ্ছিলাম না। আর একদিকে ওই অঞ্চলে এত বেশি পরিমাণ পিঁয়াজবীজের চাষ হচ্ছে যে, চাষের পরিধি বাড়ানোর জন্য নতুন জমিও মিলছিল না। উত্তরাঞ্চল তুলনামূলক বেশি ঠান্ডা থাকে আর চিনিকলের বিশাল জমি পতিত আছে যেগুলো লিজ দেওয়া হচ্ছে। তাই এখানে শুরু করলাম।’ পিঁয়াজ মাঠে কাজ করছিলেন একদল নারী শ্রমিক। সারি বেঁধে হাতে পিঁয়াজের ফুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে এগোচ্ছিলেন।

‘হস্ত পরাগায়ন চলছে?’ জানতে চাইলাম শাহেদা বেগমের কাছে। ‘হ্যাঁ, এতে বীজের গুণগত মান ভালো হয়।’ উত্তর দিলেন তিনি। মনে পড়ে গেল বছর ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মুকন্দপুরে কাঁকরোল খেতে হস্ত পরাগায়নের কাজ করছিলেন একদল নারী। তা-ও সে অঞ্চলে তখন ছিল নতুন একটি বিষয়। একইভাবে পিঁয়াজের বীজও এখানে নতুন একটি বিষয়।

কর্মীদের কয়েকজনের সঙ্গেও কথা বললাম। তাঁরা আগে কখনো এ ধরনের ফসল চাষ হতে দেখেননি। কিন্তু এখানে কাজ করতে এসে দারুণ খুশি তাঁরা। পাশের গুচ্ছগ্রামে সরকার তাঁদের ঘর করে দিয়েছে আর এখন শাহেদা বেগম দিলেন কাজের সন্ধান; তাতেই খুশি তাঁরা।

শাহেদা বেগমের পিঁয়াজবীজ ফরিদপুর থেকে ঠাকুরগাঁওয়ের শুধু চাষের বিস্তারই ঘটায়নি, এটা এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। মাঠে উপস্থিত ছিলেন ঠাকুরগাঁও কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক সিরাজুল ইসলাম। তিনিও বললেন, পিঁয়াজবীজ উৎপাদনে এ অঞ্চলের আবহাওয়া বেশ উপযোগী। আমাদের দেশে বছর বছর পিঁয়াজ নিয়ে হইচই কম হয় না। বহুবার পিঁয়াজ হয়েছে ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। বাজার পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৯ সালের আগ পর্যন্ত দেশের চাহিদা মেটাতে গড়ে ১০ লাখ টন পিঁয়াজ আমদানি করতে হতো। এর ৯০ শতাংশই আসত ভারত থেকে। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে হঠাৎ ভারত পিঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিলে দেশের বাজারে বাড়তে থাকে পিঁয়াজের দাম। তবে চাহিদার বিপরীতে আমাদের উৎপাদন একেবারে কম নয়। কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র মতে, ২০২০-২১ সালে পিঁয়াজের চাহিদা ছিল ৩৫ লাখ টন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে পিঁয়াজ উৎপাদন হয় ৩৩.৬২ লাখ টন। তাদের হিসাবে পিঁয়াজের সংগ্রহোত্তর ক্ষতি ২৫-৩০ শতাংশ। সে হিসেবে নিট উৎপাদন প্রায় ২৩.৫৩ লাখ টন। রান্নার সময় ফেলে দেওয়া অংশ ও নানাভাবে হওয়া অপচয় বাদ দিলে দেশে নিট চাহিদা ২৬ লাখ ৬১ হাজার টন। অর্থাৎ দেশে পিঁয়াজের ঘাটতি আড়াই থেকে তিন লাখ টন।

আমি একাধিকবার চেষ্টা করেছি পিঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পথে প্রতিবন্ধকতাগুলো তুলে আনার। সেখানে পিঁয়াজ সংরক্ষণ সংকট থেকে শুরু করে মৌসুমে পিঁয়াজ আমদানির বিষয়গুলো উঠে আসে। উঠে আসে পিঁয়াজের বীজ সংকটের কথাও।

যা হোক, বীজের উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি বীজের মান বৃদ্ধির জন্যও ঠাকুরগাঁওয়ের দানাজপুরে পিঁয়াজের বীজ চাষের এই সম্প্রসারণ, বলছিলেন উদ্যোক্তা শাহেদা বেগমের স্বামী বক্তার হোসেন খান। ফরিদপুরে একই মাঠে একাধিক জাতের পিঁয়াজবীজের চাষ হওয়ায় মৌমাছির মাধ্যমে পরাগায়নের ফলে জাতের বৈশিষ্ট্য অক্ষুণœ রাখা কঠিন হয়ে পড়ছিল। ঠাকুরগাঁওয়ে এ সমস্যা নেই বিধায় এখানকার বীজের মান ভালো হবে, একই সঙ্গে হস্তপরাগায়নের ফলে উৎপাদন বাড়বে বলে তাঁদের বিশ্বাস। তবে একটি সংকটের কথা উঠে আসে তাঁদের কথায়। তাঁরা বলেন, চিনিকল কর্তৃপক্ষ কৃষকের কাছে মাত্র এক বছরের জন্য জমি লিজ দিচ্ছে। হয়তো পরের বছরও তাঁরা লিজ দেবেন, তবু অনিশ্চয়তার কারণে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া যাচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে কথা বলি সেতাবগঞ্জ সুগার মিলের খামার ব্যবস্থাপক মো. আইয়ুব আলীর সঙ্গে। তিনি জানালেন সুগার মিলের অব্যবহৃত জমির পরিমাণ ৩ হাজার ৬০০ একর। এর মাঝে চাষযোগ্য জমি ২ হাজার ৭০৬ একর। একরপ্রতি ৩৭ হাজার টাকা করে লিজ দেওয়া হয়েছে ২ হাজার ৫৯০ একর; যা থেকে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হয়েছে ৯ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, মাত্র এক বছরের চুক্তিতে যে জমি লিজ দেওয়া হচ্ছে, কোনো কারণে একবার ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হলে কৃষক তো লোকসানে পড়বে, পরেরবারের চাষে সেই ক্ষতি পুষিয়ে আনার সুযোগও পাচ্ছে না। তিনিও বিষয়টি স্বীকার করলেন। কিন্তু তিনি তাঁর ওপর বর্তানো দায়িত্বই শুধু পালন করছেন। সিদ্ধান্ত আসে ওপর থেকে। আমি আশা করি ওপরমহল বিষয়টি ভেবে দেখবেন।

শাহেদা বেগমের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে তাঁর নতুন প্রজন্ম। দুই মেয়ে আর বড় জামাইও কাজ করছেন এখানে। তাঁরা বীজ প্রক্রিয়াজাত থেকে শুরু করে প্যাকেজিং, ডিজিটাল মার্কেটিং সব ধরনের কাজ করছেন প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায়। তাঁদের সঙ্গেও কথা হলো। বোঝা গেল কৃষি উৎপাদনের দারুণ সম্ভাবনার বিষয়টি তাঁরাও অনুধাবন করতে পারছেন।

কৃষির যে অনুপম শক্তি তার দেখা পেয়েছেন শাহেদা বেগম। তিনি উদ্বেলিত, তাঁর সাহস আরও অনেক পথ অতিক্রমের। নারী হয়ে নির্ভরশীলতার যে ছায়া তিনি অর্জন করেছেন, সে ছায়ায় ঠাঁই দিতে চান আরও অনেককেই। বলছিলেন, ‘আপনার অনুষ্ঠানে দেখলাম প্রধানমন্ত্রী গণভবনে যে বৈচিত্র্যময় কৃষিচর্চা করছেন। এটা আমাদের দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। তাঁর কথামতো আমরাও এক ইঞ্চি জমি পতিত রাখব না। ফলেফসলে ভরিয়ে তুলব বাংলাদেশ।’

কৃষি উদ্যোগগুলো এমনই। উৎপাদনের সুপরিকল্পনা আর সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করতে পারলে সাফল্য অনিবার্য। তার জন্য চাই একাগ্রতা আর কাজের প্রতি সততা। যে সাফল্য ধারা সূচিত হয়েছে শাহেদা বেগমের হাত ধরে, তা ছড়িয়ে পড়ুক উত্তরাঞ্চলসহ সারা দেশে। পাশাপাশি কৃষির নতুন সম্ভাবনাগুলো বিকশিত হোক। এ ধরনের ব্যক্তিগত উদ্যোগগুলোয় সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা উন্নয়নের ধারা বেগবান করবে। দেশ এগিয়ে যাবে সমৃদ্ধির দিকে।

 

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

[email protected]

সর্বশেষ খবর