সোমবার, ১০ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

‘স্যার’ উপাধির ইতিবৃত্ত

সাইফুর রহমান

‘স্যার’ উপাধির ইতিবৃত্ত

এক. ‘May I Come in Sir’-মুন্ডুটা কচ্ছপের মতো দরজা গলে কক্ষের ভিতরে ঢুকিয়ে কিঞ্চিৎ ভয়মিশেল গলায় উপরোক্ত কথাগুলো বললাম আমি। প্রত্যুত্তরে ভদ্রলোকটি বললেন, Yes, please come in. তাকে দেখেই একেবারে চমকে উঠলাম। মানুষটি দেখতে অনেকটাই ব্রিটেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জন মেজরের মতো।  সেই শুভ্র-সফেদ কেশবিন্যাস। দুজনেরই প্রায় একই রকম মুখাবয়ব। পার্থক্য শুধু এতটুকুই-জন মেজর খানিকটা শীর্র্ণকায় ও লম্বাটে, অন্যদিকে এই মানুষটি ঈষৎ খর্বকায় ও হৃষ্টপুষ্ট। কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদ থেকে আমাকে জানানো হয়েছিল যে, আমার কোর্স ডিরেক্টর হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছে প্রখ্যাত আইনজ্ঞ ও ডিন প্রফেসর ফিলিপ থমাসকে। আর সে জন্যই আমি এসেছি তাঁর সঙ্গে মোলাকাত করতে। আমি তাঁকে সাড়ম্বরে ‘স্যার’ সম্বোধন করে আমাদের মধ্যকার কথোপকথনের সূত্রপাত করলাম। আর এতেই ঘটল বিপত্তি। উনি খানিকটা অপ্রসন্ন ও উষ্মা মিশেল কণ্ঠে বললেন, Who is your Sir! I'm not your Sir. My name is Phillip Thomas. You can call me 'Phill'. প্রফেসর থমাসের কথাগুলো শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। এ কী বলছেন তিনি! যিনি বয়সে আমার বাবার চেয়েও বড়; তিনি কিনা আমাকে বলছেন তাঁর নাম ধরে ডাকতে! তাও আবার তাঁর প্রথম নাম ‘ফিল’ বলে! আমাদের সংস্কৃতিতে শুধু মা-বাবা, ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধবসহ একান্তই কাছের কিছু মানুষ সাধারণত আমাদের উপনামগুলো ডাকার যোগ্যতা রাখে। কিন্তু তিনি কেন আমাকে সে অধিকার প্রদান করছেন? পরে অবশ্য জেনেছি, পাশ্চাত্যে আধুনিক যুগে এটাই এখন তাদের সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে।

প্রফেসর ফিল থমাস আমাকে বললেন, ‘ঔপনিবেশিকতার যুগ অতিক্রম করে আমরা এখন বহুদূর চলে এসেছি। এখন আর স্যার-ট্যার ডাকার সুযোগ নেই। তোমরা এশিয়ানরা এখানে এসে কেন যে আমাদের স্যার ডাকা শুরু করে দাও, বুঝি না। ফিলিপ থমাস ঠিকই বলেছেন, স্যার, মাই লর্ড, হুজুর, ধর্মাবতার-এই সম্মানসূচক অনুষঙ্গগুলো প্রশাসনিক কাজের মধ্যে দ্রুত বিস্তার লাভ করেছিল সেই ঔপনিবেশিক সময়ে অর্থাৎ ইংরেজরা যখন প্রথম ভারতবর্ষে আসে। তবে এসব শব্দের উদ্ভব হয় ইউরোপে সেই সামন্তযুগে। ‘স্যার’ শব্দের উৎপত্তি ফরাসি দেশে, সেখানে জমিদার বা সামন্তপ্রভুদের প্রজারা সম্বোধন করত ‘স্যায়ার’ বলে, সেই ‘স্যায়ার’ শব্দটি কালক্রমে বারো শ শতকের দিকে ঢুকে পড়ে ইংরেজি ভাষায়। পৃথিবীতে সামন্ত ও ঔপনিবেশিকতার যুগ শেষ হলেও সেসব যুগের ভূতগুলো এখনো চেপে আছে আমাদের ঘাড়ে।

পাশ্চাত্যে আধুনিক যুগে ছাত্র-শিক্ষক, আমলা-প্রজাসহ অন্য সব সম্পর্ক সহজ, সাবলীল ও বন্ধুত্বপূর্ণ হয়ে আসছে; কিন্তু আমরা সেই পুরনো সংস্কৃতিতেই আটকে আছি। পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলোতে স্যার শব্দটিকে এখন অনেকটাই খেলো কিংবা হালকা করে ফেলা হয়েছে। সে জন্যই আমরা দেখি আমেরিকাতে রাগবি খেলার কোচকে যেখানে স্যার বলা অনেকটাই বাধ্যতামূলক, সেখানে সর্বোচ্চ পদের মানুষটি অর্থাৎ রাষ্ট্রপতিকে মাননীয় কিংবা মহামান্য তো দূরের কথা, তাকে শুধু সম্বোধন করা হয় মি. প্রেসিডেন্ট। উত্তরজীবনে প্রফেসর ফিল থমাসের সঙ্গে আমার সম্পর্ক এক অন্যরকম অন্তরঙ্গতায় পৌঁছেছিল। আইন পড়ার শেষ পর্যায়ে এসে ব্যারিস্টারিতে ভর্তি হওয়ার সময় তিনি আমার শিক্ষাজীবনের ওপর একটি প্রত্যয়নপত্র দিয়েছিলেন। এ কারণে আমি যে পাঁচটি ইনস্টিটিউটে আবেদন করেছিলাম সম্ভবত হাতে গোনা গুটিকয়েক ছাত্রের মতো আমিও পাঁচটি (একজন ছাত্র সর্বোচ্চ পাঁচটি ইনস্টিটিউশনে আবেদন করতে পারে) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ভর্তির আমন্ত্রণপত্র পেয়েছিলাম। এটি আমার জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনা। বেশ কয়েক বছর আগে প্রফেসর ফিল থমাস ঢাকায় এসেছিলেন। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট থেকে তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। আমি সেই সময় অসুস্থ বাবাকে নিয়ে ব্যাংককে ছিলাম বলে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি। বন্ধু ব্যারিস্টার জুনায়েদ ও অনুজপ্রতিম ব্যারিস্টার ইমতিয়াজ ফারুকের কাছে আমার অনেক খোঁজখবর নিয়েছিলেন বলে শুনেছিলাম। আমার সঙ্গে দেখা হয়নি বলে দুঃখও করেছিলেন।

দুই. ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য কার্ডিফ থেকে চলে এলাম লন্ডনে। যা হোক, লন্ডনে এসে আমি দ্রুতই শহরটিকে ভালোবেসে ফেললাম। চারদিকে অভিজাত উঁচু উঁচু হর্ম্য। নদী, প্রাসাদ, পার্লামেন্ট, শপিং মল কী নেই শহরটিতে। আধুনিক চাকচিক্যে ইউরোপের বোধকরি আর কোনো শহর এর সামনে দাঁড়াতে পারে না। তবে এর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী প্যারিস। লন্ডন যদি ব্যারিস্টারদের সেকেন্ড হোম বলে বিবেচিত হয়, তবে শিল্পীসাহিত্যিকদের জন্য ফার্স্ট হোম হচ্ছে প্যারিস। সাহিত্য, কবিতা, নন্দনতত্ত্ব, বিজ্ঞান, শিল্পকলায় কার চেয়ে কে এগিয়ে এই প্রতিযোগিতা চলছে যুগ যুগ ধরে এ দুটি শহরের মধ্যে। এহেন অসার প্রতিযোগিতায় দুই শহরকেই খুশি করে উপন্যাস লিখেছিলেন চার্লস ডিকেন্স “এ টেল অব টু সিটিস”। সেই সঙ্গে বিখ্যাত ফরাসি সাহিত্যিক বালজাক দুই শহরকে একসঙ্গে খুশি করতে স্টাইল ও ফ্যাশন সম্পর্কে একটি অসাধারণ কথা বলেছিলেন সেই কবে, যা আজও সমান সত্য বলে বিবেচিত হয়- “What is French Fashion in London is English Fashion in Paris” অর্থাৎ লন্ডনে যা ফরাসি ফ্যাশন হিসেবে চলে, সেটাই আবার প্যারিসে চলে ইংরেজি ফ্যাশন বলে। সেসব কথা থাক, বড় বড় ইমারত, প্রাসাদ, পার্লামেন্ট, শপিং মল ঘুরে বেড়িয়ে আমি যখন আত্মপ্রসাদের স্বগতোক্তি করছি যে, লন্ডনের সবকিছু দেখে ফেলেছি, সেই সময় এক অগ্রজ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, মোহাম্মদ আল ফায়াদের বিখ্যাত শপিং মল ‘হ্যারোডস’ দেখেছি কিনা। আমি বললাম, না দেখিনি। তিনি পরামর্শ দিলেন সেই শপিং মলটি একদিন ঘুরে দেখতে। হাতে সময় নিয়ে একদিন সকাল সকাল চলে গেছি বিখ্যাত সেই শপিং মল হ্যারোডস দেখতে। শপিং মলের মূল ফটকটি দিয়ে প্রবেশ করতেই চিরাচরিত সুসজ্জিত বেশভূষার একজন দারোয়ান মাথাটি ঈষৎ নিচে নামিয়ে হাত দুটি সম্প্রসারিত করে বলতে লাগলেন, ‘আসুন স্যার আসুন, ভিতরে আসুন’। প্রথম দর্শনেই লোকটিকে আমার বেশ পরিচিত বলে মনে হলো। ভিতরে প্রবেশ করে এক দোকান পরিচারিকাকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, শপিং মলের মূল প্রবেশমুখে যে দারোয়ানটি দাঁড়িয়ে আছে তাকে বেশ চেনাচেনা লাগছে। উনি কি মোহাম্মদ আল ফায়াদের সহোদর? দোকানি স্মিত হেসে আমাকে বললেন, আপনি ঠিকই ধরেছেন স্যার, তবে উনি মোহাম্মদ আল ফায়াদের সহোদর নন। উনি স্বয়ং হ্যারোডসের মালিক মোহাম্মদ আল ফায়াদ। মোহাম্মদ আল ফায়াদকে আমি বেশ ভালো করেই চিনতাম। কারণ সেই সময়টায় মোহাম্মদ আল ফায়াদ ও বিখ্যাত জাঁদরেল এক ব্রিটিশ এমপি নীল হ্যামিল্টনের মধ্যে ঘুষ আদান-প্রদানের একটি মোকদ্দমা চলছিল। ফলে সেই সময়ে প্রায়ই ফায়াদ ও নীল হ্যামিল্টনের ছবি ব্রিটেনের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকাগুলোতে বেশ বড় বড় সাইজে ছাপা হতো। দোকান পরিচারিকার কাছ থেকে যখন জানলাম, দারোয়ানটি আসলে স্বয়ং মোহাম্মদ আল ফায়াদ, তখন খানিকটা নির্বুদ্ধিতা ভর করল আমার মাথায়। আমি দু-তিনবার করে হ্যারোডস শপিং মলে প্রবেশ করলাম ও বের হলাম। শুধু মোহাম্মদ আল ফায়াদের মুখ থেকে ‘স্যার, প্লিজ ভিতরে আসুন...’ কথাগুলো বারবার শোনার জন্য। ঘোরাঘুরি শেষ করে অপরাহ্ণে পাতাল রেলে যখন বাড়ি ফিরে যাচ্ছিলাম, ট্রেনে বসে নিজের বোকামির কথা চিন্তা করে নিজেই অপ্রস্তুত ও হেয়প্রতিপন্ন হচ্ছিলাম এই ভেবে যে, উত্তপ্ত রোদেলা দুপুরে মোহাম্মদ আল ফায়াদ নিজে দারোয়ান সেজে যতই ‘স্যার’ ‘স্যার’ বলুক; বেলা শেষে কিন্তু তিনি হাজার কোটি টাকার মালিক। আর আমি সেই কপর্দকশূন্য এক আইনের ছাত্র।

তিন. সম্ভবত ঘটনাটি ১৯১৫ সালের জানুয়ারির একেবারে প্রথম দিকের। ইন্ডিয়ান কংগ্রেস পার্টির সভা হচ্ছে কলকাতায়। কংগ্রেসের মধ্যমণি গোপাল কৃষ্ণ গোখলে একটি টেবিল পেতে চেয়ারে বসে দলীয় নানা কাজের ফর্দ তৈরিতে ব্যস্ত। এমন সময় জনৈক ব্যারিস্টার সন্তর্পণে একটি ভিজিটিং কার্ড ধরিয়ে দিলেন গোখলের হাতে এবং বললেন, স্যার, আমি এসেছি গুজরাটের রাজকোট থেকে। মাথাটি না তুলেই ভিজিটিং কার্ডটিতে চোখ বোলালেন গোখলে। কার্ডটিতে স্পষ্ট লেখা রয়েছে, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, ব্যারিস্টার-এট-ল, ইনার টেম্পল’। গোখলে কার্ডটি দেখার সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে এক গভীর আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরলেন গান্ধীকে। গান্ধী ও গোখলে দুজন দুজনার পরম বন্ধু। ১৯১২ সালে গোখলে সাউথ আফ্রিকা ঘুরে এসেছেন গান্ধীর আমন্ত্রণে। তাঁর অহিংস আন্দোলনের দারুণ ভক্ত তিনি। অন্যদিকে গান্ধী তার শুভানুধ্যায়ী, পরামর্শক ও পথপ্রদর্শক হিসেবে বিবেচনা করেন গোখলেকে। গান্ধী গুজরাটের রাজকোট থেকে ছুটে এসেছেন কলকাতায়, নিজেকে কংগ্রেসের কোনো কাজে লাগে কিনা সেই বিবেচনায়। প্রথমেই গান্ধী লক্ষ্য করলেন যে, সভাটিতে এত মানুষের সমাগম অথচ পয়ঃনিষ্কাশন ও স্যানিটারি সুবিধার বেহাল অবস্থা। অন্যদিকে কলকাতায় তখন মেথর সম্প্রদায়ের ধর্মঘটের কারণে শৌচাগারগুলো উপচে পড়ছিল মানুষের মল ও বিষ্ঠায়। গান্ধী লক্ষ্য করলেন, যে ভবনটিতে পার্টির ক্যাম্প করা হয়েছে, সেই ভবনটির বারান্দায় পর্যন্ত কেউ কেউ পুরীষ ত্যাগ করে রেখেছে। দুর্গন্ধে তাই সেখানে টেকাই মুশকিল। কংগ্রেসের দলীয় কর্মীদের উদ্দেশে তিনি বললেন, ‘ভাইসব, ভারতমুক্তির আগে আসুন আমরা এই দুর্গন্ধময় নোংরা বর্জ্য থেকে মুক্ত হই।’ রেকর্ডপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, এই কাজে সেদিন কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসেননি, তাঁকে একাই করতে হয়েছিল সব কাজ। কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর প্রথম আলো উপন্যাসে লিখেছিলেন ত্রিপুরা মহারাজের অবৈধ পুত্র ভরতসিং নোংরা পরিষ্কারের এই কাজে গান্ধীকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছিলেন। এ ঘটনা থেকে হয়তো মনে হতে পারে, জীবনে এই প্রথম হয়তো তিনি সবাইকে অবাক করে দেওয়ার জন্য এই কাজে লিপ্ত হয়েছিলেন। আসলে কিন্তু তা নয়, তিনি যখন মাত্র ১২ বছরের কিশোর, তাঁর রাজকোটের বাড়িতে যে মহিলাটি তাদের শৌচাগার পরিষ্কার করত তার নাম ছিল উকা, গান্ধীর মা গান্ধীকে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলতেন, গান্ধী যদি উকাকে স্পর্শ করে তবে তাঁকে সমস্ত রাত ঘরের বাইরে কাটাতে হবে এবং তাঁকে স্নান সেরে তবেই ঘরে প্রবেশ করতে হবে। সেসব কথার উত্তরে কিশোর গান্ধী তার মাকে বলেছিলেন, রামায়ণে গুহাকা নামে এক চন্ডালকে রাম যখন আলিঙ্গন করেছিলেন, তাতে রামের জাত গিয়েছিল কি না। কিশোর গান্ধীর মুখে এসব কথা শুনে গান্ধীর মা পুতলিবাই আর কোনো কথা বলতে পারলেন না। দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকার সময়ও গান্ধী তার নিজ ঘরের নোংরা পুরীষ তিনি নিজেই পরিষ্কার করতেন এবং ভার্যা কস্তুরবাকে তিনি উৎসাহ জোগাতেন এই কাজ করতে। কিন্তু তার স্ত্রী অসন্তোষ প্রকাশ করলে তিনি তাকে ভর্ৎসনা করতেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় ধাঙড়গিরি কিংবা ঝাড়ুদার হিসেবে গান্ধীর বেশ নামডাক ছিল। সেখানে তাঁর বন্ধুবান্ধবরা প্রায়ই তাকে দুষ্টুমি করে মেথর গান্ধী বলে ডাকতেন। সে দেশে প্রথমবার যখন তাঁকে গারদে পোরা হলো, তিনি স্বেচ্ছায় সেখানকার শৌচাগারের বর্জ্য পরিষ্কার করতে চাইলেন। এর পর থেকে জেল কর্তৃপক্ষ তাঁকে দিয়েই সব সময় জেলের মলমূত্র পরিষ্কার করাতেন। ভারতেও তিনি কংগ্রেস কিংবা অন্যান্য সভা-সমিতিতে স্থাপিত অস্থায়ী শৌচাগারগুলোর নোংরা বর্জ্য নিজে উদ্যোগী হয়ে পরিষ্কার করতেন।

চার. কয়েক দিন আগে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষককে ‘স্যার ডাকতে বাধ্য করার’ অভিযোগ উঠেছে রংপুরে জেলা প্রশাসক (ডিসি) চিত্রলেখা নাজনীনের বিরুদ্ধে। এর প্রতিবাদে বুধবার (২২ মার্চ) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেন বেরোবির অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক উমর ফারুক। বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। সমাজের কিছু বিবেকবোধসম্পন্ন মানুষ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিবাদ জানায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে মাঝে মধ্যেই কিছু আমলাদের দেখা যায় এ ধরনের উদ্ভট আচরণ করতে। কেন তারা এমনটি করেন?

আমি মূলত একজন গল্পকার। মানুষের মনস্তত্ব আমার লেখার প্রধান উপজীব্য। সে আলোকে বলতে গেলে বলতে হয় বেশির ভাগ আমলাই আসেন নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে (আমি নিজেও মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা একজন মানুষ এবং আমার বাবা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন আমলা ছিলেন) তো তারা বা তাদের পরিবার জীবন পরিক্রমায় বহু মানুষ দ্বারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মানুষের নিগৃহের স্বীকার হয়েছেন কিংবা সেগুলো দেখে বেড়ে উঠেছেন। এ জন্য তারা নিজেরা যখন কোনো চেয়ারে বসেন তখন সচেতনভাবেই হোক কিংবা অবচেতনভাবেই হোক সে সবের প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করেন। আমি মনে করি আমলাদের এমন আচরণ সে সবেরই বহির্প্রকাশ।

এ বিষয়ে সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বলেন, জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী নিজে এ বিষয়ে কথা বলেছিলেন। তিনি খুব সঠিকভাবেই বলেছিলেন, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের স্যার বলার বাধ্যবাধকতা নেই। প্রতিমন্ত্রী এটা বলার পরও গণকর্মচারীরা কেন সেটা অনুসরণ করছেন না, এ বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী কোনো উদ্যোগ নেবেন কি না জানা দরকার। সাবেক এ সচিব প্রশ্ন তোলেন, সরকারি কর্মচারীরা কি ভুলে যাচ্ছেন, তাঁদের বেতন-ভাতা জনগণের ট্যাক্সের টাকায় হয়? আমারও সেই একই প্রশ্ন- দেশের একজন সেবক হয়ে তারা কীভাবে আশা করেন দেশের মালিকরা তাদের স্যার বলে সম্বোধন করবে। তবে সব আমলাই যে এ ধরনের মনমানসিকতা সম্পন্ন সেটা বলার সুযোগ নেই। সাহিত্যিক শহীদুল জহির ২০০১ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে উপসচিব ছিলেন। একজন নামি লেখক সেই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের উপসচিব কিন্তু তবুও তিনি নিভৃতে থাকতেই বেশি পছন্দ করতেন। বছর দুয়েক আগে আমি ও কবি জুননু রাইন একবার গিয়েছিলাম ডিআইজি মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়ার দফতরে। আমার একটি ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে। ডিআইজি সাহেব পেশায় পুলিশ হলেও নেশায় লেখক।  আমার সমস্যা শুনে আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন- ‘কী আর বলব ভাই, পুলিশকে আমি নিজেও ভয় পাই।’ পুলিশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা অথচ বলছেন এ ধরনের কথা! আমি এবং জুননু দুজনেই-থ।

লেখক : গল্পকার ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী

ই-মেইল :  [email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর