শুক্রবার, ২১ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

যেভাবে লেখা হয়েছিল ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’

সোহেল সানি

যেভাবে লেখা হয়েছিল ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’

“ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ” গানটি এবং পবিত্র ঈদুল ফিতর যেন এক ও অভিন্ন সত্তা হয়ে গেছে।  আকাশে চাঁদের উঁকিঝুঁকি মানেই ঘরে ঘরে বেজে ওঠে গানটি। পবিত্র রমজান শেষে মুসলিম সম্প্রদায়ের মাঝে আনন্দ নিয়ে হাজির হয় হিজরি শাওয়াল মাসের ১ তারিখ। যেদিন সমগ্র মুসলিম বিশ্ব মেতে ওঠে সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতরে। আর বাঙালিদের জন্য এই ঈদের একটাই মাত্র আগমনী গান আছে। আর সেটা হলো- ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ। যার রচয়িতা বিদ্রোহী কবি-খ্যাত আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে সম্প্রচার করে থাকে রুনা লায়লার কণ্ঠে ধারণকৃত গানটি। একযোগে বহু শিল্পীর কণ্ঠেও শোনা যায়। দুনিয়ার বুকে থাকা প্রবাসী বাঙালি মুসলমানের কানেও বেজে ওঠে সুমধুর এই গান। গানটি ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে আকাশ-বাতাসকে করবে অনুরণিত আর আলোকচ্ছটা ছড়ায়ে দেবে মুহুর্মুহু আতশবাজির খেলা। কিন্তু গানটি লেখার একটা চরম ইতিহাস রয়েছে। যা আমাদের অনেকেরই অজানা।

সময়কাল ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দ। ধর্মান্ধ সাধারণ মুসলিম সমাজে কাজী নজরুল ইসলাম ‘কাফের’ বলে ধিক্কৃত ছিলেন। শুধু তাই নয়, শিক্ষিত মুসলমানরা তাঁকে ‘কাফের’ বলতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন না। আলেম ও মাওলানাদের সুরে সুরে তারাও কবি নজরুলকে ‘ইসলামের শত্রু’ হিসেবে চিহ্নিত করতেন। মাত্র ২১ বছর বয়সে লেখা ‘বল বীর বল উন্নত মম শির...’ শীর্ষক ‘বিদ্রোহ’ কবিতাকেও খোদা বা আল্লাহবিরোধী উন্মাদনা হিসেবে দেখেছিল তদানীন্তন মুসলিম সমাজ। হিন্দু প্রমিলাকে বিয়ে করা এবং হিন্দুদের ভজন ও শ্যামা সংগীত লেখার কারণে কবির প্রতি মুসলিম সমাজ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল।

তখন সংগীত শিল্পীদের মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা একেবারে হাতেগোনা। সেই হাতেগোনাদের মধ্যে ছিলেন আব্বাসউদ্দীন। কবি নজরুল ইসলামকে ধর্মান্ধ মৌলবাদীরা ‘কাফের’ ঘোষণা করায় দারুণ মর্মাহত ছিলেন তিনি। সুসম্পর্কের সুবাদে আব্বাসউদ্দীন কবির সঙ্গে দেখা করে বললেন- “কাজী দা, আপনি অন্তত দুটি ইসলামিক গানের রচয়িতা হোন। আমি গেয়ে দেব সে গান। আর সে গান নিশ্চয়ই মুসলিম সমাজে সৃষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাবে।” কবির মন সায় দিল। তবে একটা শর্ত জুড়ে দিয়ে বললেন, “ঠিক আছে আমি লিখব ইসলামিক গান, তবে তুমি যদি ভগবতী ভট্টাচার্যকে সম্মত করাতে পার।”

অর্থাৎ কলকাতার এইচএমভি রেকর্ডিংয়ের মালিক শ্রী ভট্টাচার্যকে সম্মত করাতে হবে। ভট্টাচার্য বাবু শিল্পবোদ্ধা হিসেবে উদারচিত্তের মানুষ ছিলেন। কিন্তু কলকাতার রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ বিষয়টি কীভাবে নেবে সেদিকটায় চিন্তামুক্ত হতে পারছিলেন না। শ্যামাসংগীত ও ভজনের তখন রমরমা বাজার। বিপুল জনপ্রিয়। মুসলিম সমাজে সংগীত তখনো নিষিদ্ধ আর ইসলামে তো একেবারেই হারাম। কোচবিহারের উদীয়মান ও জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী আব্বাসউদ্দীনের পীড়াপীড়িতে ভগবতী ভট্টাচার্য বললেন, “এমন ঝুঁকি কী করে নেয়া যায়? পুজোয় ধুমছে গান রেকর্ড বিক্রি হয়ে যায়, কিন্তু ঈদের সময় ইসলামিক কোনো গান যে বিক্রি হবে না-এটা নিশ্চিত। কারণ মুসলমানরা পয়সাকড়ি পাবে কোথায়?”

এসব বলে ভট্টাচার্য উপেক্ষা করতে চাইলেও আব্বাসউদ্দীন আশা ছাড়লেন না এবং শেষ পর্যন্ত সম্মত করাতে সমর্থ হলেন। এরপর খুশির খবরটি দিলেন কবি নজরুল ইসলামের মুখোমুখি হয়ে। এক বসায় কবি লিখে ফেললেন “ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ” শীর্ষক গানটি। কবি স্বকণ্ঠে সুর তুলে দিলেন আব্বাসউদ্দীনের কণ্ঠে। আব্বাসউদ্দীনের পুত্র শিল্পী মুস্তাফা জামান আব্বাসী এ প্রসঙ্গে স্মৃতিচরণা করেছেন বিভিন্ন সময়ে। আব্বাসউদ্দীন নিজের স্মৃতিকথায়ও লিখে গেছেন এ গানটি কীভাবে কোন পরিস্থিতিতে কবিকে দিয়ে লিখিয়েছিলেন। আব্বাসউদ্দীনকে গানটি লেখা শুরু করার আগেই কবি বলেছিলেন চা ও পান নিয়ে আসতে। চা পান করার পর মুখে পান চিবুতে চিবুতে গানটি লিখে ফেলেন। কবিকে দিয়ে সুরও করিয়ে নিলেন আব্বাসউদ্দীন। তারপর গাইলেন। রেকর্ড করা হলো। এরপর সে কী অবস্থা কলকাতার অলিগলিতে বাজতে থাকল গানটি।

মন্ত্রমুগ্ধের মতো মুসলমানরাও শুনল। কবি নজরুলকে ইসলামিক গান লিখতে এবার খোদ উৎসাহিত করলেন এইচএমভি রেকর্ডিংয়ের মালিক। ইসলামিক গান গাওয়ার মুসলমান শিল্পী কই? তাই তো হিন্দু শিল্পীরা মুসলমান নামে গান গাইতেন। যেমন গণি মিয়া নামে ধীরেন দাস; দেলোয়ার হোসেন নামে চিত্ত রায়; আমিনা বেগম নামে আশ্চর্যময়ী দাসী; সোনা মিয়া নামে গিরীন চক্রবর্তী প্রমুখ ইসলামিক গান গেয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। আর এভাবেই কাজী নজরুল ইসলামের ইসলামিক গানের যাত্রা। একদিন যে মুসলিম সমাজ তাঁকে ‘কাফের’ বলত; ইতিহাসের কী অদ্ভুত ফলশ্রুতি সেই মুসলিম সমাজই আজ কবি নজরুলকে ইসলামিক কবি হিসেবে আখ্যায়িত করছে।  কাজী নজরুল ইসলাম প্রকৃতপক্ষে অসাম্প্রদায়িক কবি। মানবতার কবি।  সাম্যের কবি।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট

সর্বশেষ খবর