আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। আজ যারা শিশু তাদের যদি আমরা সযত্নে, সুস্থ-সুন্দর পরিবেশে বিকাশ লাভের সুযোগ করে দিই, তাহলে ভবিষ্যতে তারা হবে এ দেশের এক একজন আদর্শ, কর্মক্ষম, সুযোগ্য নাগরিক। শিশুদের যদি আমরা সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারি তাহলে তারা অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিয়ে এ দেশকে অগ্রগতির দিকে নিয়ে যাবে।
দেশের জনসংখ্যার শতকরা ৪৫ ভাগই শিশু। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার এক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, বিশ্বে ১৬ কোটির মতো শিশুশ্রমিক রয়েছে। সারা বিশ্বের শিশুশ্রমিকদের মধ্যে শতকরা প্রায় পাঁচজনই এশিয়ার। বাংলাদেশে শিশুশ্রমিকরা প্রায় ৩৪৭ ধরনের অর্থনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িত। হোটেল থেকে শুরু করে লেগুনা হেলপার, ইট কিংবা কনস্ট্রাকশনের কাজে, হেন কাজ নেই যা শিশুদের দ্বারা করানো হয় না। শিশুদের দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করানো নতুন নয়। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংস্থা শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও এখনো বিশ্বে বন্ধ হয়নি শিশুশ্রম।
বাংলাদেশে কর্মরত শিশুশ্রমিকের সংখ্যা ১৭ লাখ ৭৬ হাজার ৯৭। ৯ বছরের ব্যবধানে দেশে এই শিশুশ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে ৭৭ হাজার ২০৩। এর আগে সর্বশেষ ২০১৩ সালে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা ছিল ১৬ লাখ ৯৮ হাজার ৮৯৪। বর্তমানে পাঁচ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশু ৩ কোটি ৯৯ লাখ ৬৪ হাজার ৫ জন। ২০২২ সালে দেশের ৩০ হাজার ৮১৬টি পরিবারের ওপর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) পরিচালিত জরিপ থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। বর্তমানে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুশ্রমিক রয়েছে ১০ লাখ ৬৮ হাজার ২১২ জন। ২০১৩ সালের জরিপে এ সংখ্যা ছিল ১২ লাখ ৮০ হাজার ১৯৫। ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুশ্রমিক কমেছে ২ লাখ ১১ হাজার ৯৮৩ জন। জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ ২০১৩ ও ২০২২-এর ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১৩ সালের তুলনায় ২০২২ সালে শ্রমজীবী শিশু ও শিশুশ্রমে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। গত ১০ বছরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির তুলনায় এই বৃদ্ধি সামান্য। তবে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুশ্রমিকের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।
শ্রমজীবী শিশুদের মধ্যে ২৭ লাখ ৩৪ হাজার ৪৪ জন ছেলে এবং ৮ লাখ ২ হাজার ৮৮৩ জন মেয়ে। আর শিশুশ্রমে নিয়োজিত ১৭ লাখ ৭৬ হাজার ৯৭ জনের মধ্যে ছেলেশিশু ১৩ লাখ ৭৪ হাজার ১৫৪ জন এবং মেয়েশিশু ৪ লাখ ১ হাজার ৯৪৩ জন। একইভাবে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত ১০ লাখ ৬৮ হাজার ২১২ জন শিশুর মধ্যে ছেলেশিশু ৮ লাখ ৯৫ হাজার ১৯৫ জন এবং মেয়েশিশু ১ লাখ ৭৩ হাজার ১৭ জন। বাংলাদেশে বাসাবাড়ি থেকে শুরু করে বিভিন্ন শিল্প-কারখানাতেই শিশু শ্রমিক খুঁজে পাওয়া যায়। দেশে জনসংখ্যার বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতির ফলে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। কলকারখানায় কাজ করা শিশুরা রাসায়নিক পদার্থ ও দূষিত পরিবেশের সংস্পর্শে আসে। ফলে কম বয়সেই চোখের অসুখ, ফুসফুসের নানা সমস্যা, এমনকি ক্যান্সারের মতো মরণরোগেরও শিকার হয়।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ও ইউনিসেফ পরিচালিত এক জরিপ থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে প্রায় ৩০১ ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে শিশুরা বিরামহীনভাবে শ্রম দিচ্ছে দিনের পর দিন। শিশুশ্রম মূলত দারিদ্র্যেরই ফল। সংসারের অভাব-অনটনের কারণেই শিশুরা অল্প বয়সেই শ্রমিক হতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এ শিশুদের ন্যূনতম বয়স ১৪ আর কিশোরদের বয়স ১৪-১৮ নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে ১৪ বছরের কম বয়সীদের কাজে নিয়োগ করা যাবে না। শিশুর অভিভাবক কাজ করানোর জন্য কারও সঙ্গে কোনো প্রকার চুক্তি করতে পারবেন না। এই আইন শুধু কাগজে কলমে দেখা যায় বাস্তবে এই আইনের প্রয়োগ খুবই কম দেখা যায়। এ সমস্যা দূরীকরণে সরকারি উদ্যোগ জরুরি। দরিদ্র্যতার পাশাপাশি অশিক্ষা, অনিশ্চয়তা আর অসচেতনতাও এর জন্য অনেকাংশে দায়ী। তাই সবার আগে প্রয়োজন সঠিক শিক্ষার প্রসার, সচেতনতা বৃদ্ধি ও দারিদ্র্য দূরীকরণ। এ ছাড়াও প্রয়োজন জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আনা ও সামাজিক সচেতনতা। প্রতিটি পরিবারে যদি এই সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি পায় তাহলে দেশে শিশুশ্রমিক সমস্যা দূরীকরণে বেগ পেতে হবে না। দেশের সরকারকে শিশুশ্রম আইনে সংশোধন এনে আরও কঠোর আইন প্রণয়ন করতে হবে। শিশুশ্রমে উৎসাহ প্রদানকারীদের আইনের আওতায় এনে শিশুশ্রমকে নিরুৎসাহিত করতে হবে। বাংলাদেশকে আগামী তিন বছরের মধ্যে শিশুশ্রম মুক্ত করতে ১৬টি মন্ত্রণালয় ও অনেক বেসরকারি সংস্থা কাজ করছে। ফলে আশা করা যায়, শিগগিরই বাংলাদেশ শিশুশ্রম মুক্ত দেশ হিসেবে পরিণত হবে।
বাংলাদেশের প্রতিটি শিশুর মৌলিক চাহিদা, যেমন- অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। আমরা যদি সব শিশুর মৌলিক চাহিদা মেটাতে পারি, তাহলে তাদের জীবিকার সন্ধানে দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হবে না।
ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে অকালে তাদের জীবনী শক্তি হারাতে হবে না। আরও বেদনাদায়ক হলো, এসব শিশুর অনেকে শ্রম দিয়েও মজুরি পায় না। এটি কেবল অমানবিক নয়, অমার্জনীয়ও। আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনা এমনভাবে সাজাতে হবে, যাতে দেশের প্রতিটি শিশুর মৌলিক চাহিদাগুলো মেটানো যায় এবং তারা নিজেদের যোগ্য ও সুস্থ নাগরিক হিসেবে গড়ার সুযোগ পায়। সেই সঙ্গে শিশুশ্রম বন্ধে যেসব আইন আছে, সেগুলোর যথাযথ প্রয়োগ জরুরি।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও প্রাক্তন প্রিন্সিপাল এম এইচ খান ডিগ্রি কলেজ, গোপালগঞ্জ