অহংকার। মানব হৃদয়ের সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাধি। অহংকারকে আরবিতে ‘উম্মুল আমরাজ’ তথা সব রোগের মূল বলে অভিহিত করা হয়। অহংকার মানুষকে ধ্বংস করে দেয়। মানুষকে তুচ্ছ মনে করা, হেয়প্রতিপন্ন করা, মানুষের ওপর ধন-দৌলত ও বংশমর্যাদার দাম্ভিকতা এবং সত্যকে গ্রহণ না করে অন্যায়ভাবে বিতর্ক করাই হচ্ছে অহংকার। নিজেকে অন্যের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও মর্যাদাবান এবং অন্যকে ছোট ও তুচ্ছ মনে করাকে আরবিতে কিবর আর বাংলায় অহংকার বলে।
অহংকার শয়তানের বৈশিষ্ট্য। অভিশপ্ত ইবলিশ শয়তান সর্বপ্রথম আল্লাহতায়ালা ও তাঁর সৃষ্টির সঙ্গে অহংকার করেছিল। অহংকার ইবলিশ শয়তানকে ধ্বংসের অতল গহ্বরে নিক্ষেপ করেছে। অহংকার এটা আল্লাহতায়ালা ব্যতীত অন্য কারও জন্য শোভা পায় না। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সুমহান আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই গৌরব আমার পোশাক এবং অহংকার আমার চাদর। অতএব যে তা নিয়ে আমার সঙ্গে কাড়াকাড়ি করবে তাকে আমি শাস্তি দিয়ে ছুড়ে দেব।’ [মুসনাদে আহমাদ]
পবিত্র কোরআনুল কারিমের বিভিন্ন জায়গায় অহংকারের নিন্দাবাদ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না।’ [সুরা লুকমান, ৩১ : ১৮]
অহংকারী ব্যক্তিকে আল্লাহ ধ্বংস করে দেন, তার প্রভাব-প্রতাপ নস্যাৎ করে দেন ও তার জীবনকে সংকুচিত করে দেন। যে ব্যক্তি অহংকার করতে চায় ও বড়ত্ব দেখাতে চায় আল্লাহ তাকে লাঞ্ছিত করেন। সাইয়িদুনা আলী (রা.) বলেন, ‘মানুষের কীসের এত অহংকার, যার শুরু এক ফোঁটা রক্তবিন্দু দিয়ে আর শেষ হয় মৃত্তিকায়!’
মুতাররিফ ইবনে আবদুল্লাহ (রহ.) ছিলেন বিখ্যাত এক বুজুর্গ। মুহাল্লাব নামক এক লোক তার পাশ দিয়ে রেশমি কাপড় পরে দম্ভভরে হেঁটে যাচ্ছিল। বুজুর্গ তাকে বললেন : এভাবে হাঁটছ কেন? সে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেয়- আপনি জানেন, আমি কে? মুতাররিফ (রহ.) উত্তরে যা বলেছিলেন তা প্রতিটি মানুষের মনে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মতো। তিনি বলেছিলেন- তোমার সূচনা পুঁতিগন্ধময় বীর্যে, সমাপ্তি গলিত লাশে আর এ দুয়ের মাঝে তুমি এক বিষ্ঠাবাহী দেহ। (তাফসিরে কুরতুবি, সুরা মাআরিজের ৩৯ নম্বর আয়াতের তাফসির দ্রষ্টব্য)
রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অহংকার নামক এই ভয়াবহ আত্মিক ব্যাধি থেকে বাঁচতে তাঁর প্রিয় উম্মতকে বিভিন্নভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যার অন্তরে অণু পরিমাণ অহংকার থাকবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।’ এক লোক বলল, ‘মানুষ তো ভালোবাসে যে, তার পোশাক সুন্দর হোক ও তার জুতা সুন্দর হোক (তাহলে)? তিনি বললেন, ‘আল্লাহ সুন্দর, তিনি সৌন্দর্যকে ভালোবাসেন। (সুন্দর পোশাক ও সুন্দর জুতা ব্যবহার অহংকার নয়, বরং) অহংকার হলো, সত্যকে প্রত্যাখ্যান করা এবং মানুষকে তুচ্ছজ্ঞান করা।’ [সহিহ মুসলিম : ৯১, তিরমিজি : ১৯৯৮, আবু দাউদ : ৪০৯১, ইবনে মাজাহ : ৫৯, আহমাদ : ৩৭৭৯]
আমর ইবনে শোয়াইব তার পিতা থেকে, তিনি তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন :
‘কেয়ামতের দিন অহংকারীদের ছোট ছোট পিপীলিকার ন্যায় মানুষের আকৃতিতে হাশরের ময়দানে উপস্থিত করা হবে। অপমান ও লাঞ্ছনা তাদের চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলবে। তাদের জাহান্নামের একটি জেলখানায় একত্রিত করা হবে, যার নাম হবে বুলাস। আগুন তাদের চতুর্দিক থেকে ঢেকে ফেলবে। জাহান্নামিদের শরীরের ঘাম তাদের পান করতে বাধ্য করা হবে।’ [সুনানে তিরমিজি : ২৪৯২]
অহংকারীর ঠিকানা জাহান্নাম। আল্লাহ রব্বুল আলামিন বলেন, ‘সুতরাং, তোমরা দ্বারগুলো দিয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করো, সেখানে স্থায়ী হওয়ার জন্য; দেখো অহংকারীদের আবাসস্থল কত নিকৃষ্ট।’ [সুরা নাহল, ১৬ : ২৯]
অহংকারী ব্যক্তিকে আল্লাহতায়ালা পছন্দ করেন না। তিনি অহংকারী ব্যক্তিকে অনেক নেয়ামত থেকে বঞ্চিত রাখবেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘দুনিয়াতে যারা অন্যায়ভাবে অহংকার প্রকাশ করে, তাদের আমি অবশ্যই আমার নিদর্শনাবলি থেকে বিমুখ রাখব।’ [সুরা আরাফ : ১৪৬]
তাই আসুন, অহংকারের মতো ভয়াবহ এই ব্যাধি থেকে বাঁচার সর্বাত্মক চেষ্টা করি। নিজের প্রতি আল্লাহর সীমাহীন দয়া ও অনুগ্রহের কথা সব সময় হৃদয়ে জাগরূক রাখি। আমি কীভাবে অহংকার প্রদর্শনের দুঃসাহস দেখাব, যখন আমার আপাদমস্তক দয়াময় মহান আল্লাহর অনুগ্রহের সাগরে ডুবে আছে। আল্লাহর দেওয়া নেয়ামত গ্রহণ করে অহংকার প্রদর্শন নিচু মানসিকতা ও চূড়ান্ত নির্লজ্জতা বৈ কিছু নয়। আল্লাহ আমাদের সবাইকে অহংকারের মতো ভয়াবহ ধ্বংসাত্মক এই ব্যাধি থেকে হেফাজত করুন।
লেখক : খতিব, আউচপাড়া জামে মসজিদ টঙ্গী, গাজীপুর